১৪ জানুয়ারি ২০২৪, রবিবার, ৩:৫৬

নির্বাচন ও আরো কিছু কথা

-মীযানুল করীম

 

বাসার কাছেই একটি ভোটকেন্দ্র। কিন্তু এবার হাতে হাতে কোনো ভোটার স্লিপ পাইনি। অন্যান্যবার হাতে পায়ে ধরার মতো অবস্থায় এই ভোটার স্লিপ দেয়া হতো। ভোটার স্লিপে ভোটারের ছবি ও ভোটার নাম্বার থাকত। এবার হয়তো মনে করেছে ভোটের দরকার বা কি! এ জন্য ভোটার স্লিপের মূল্য নেই। পরে শুনলাম, বাসায় দারোয়ানের কাছে নাকি দিয়ে গিয়েছে ভোটার স্লিপ। ভোটার স্লিপের দরকার নেই, এজন্য ওরা জনে জনে পৌঁছায় নাই।

একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের কলামিস্ট নির্বাচনের পরদিনই লিখেছেন, ‘নির্বাচন’ শব্দটি শুনতে ভালোই লাগে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে নির্বাচন বলতে আমরা যা বুঝি, সেটা কি হয়েছে? বিএনপির মতো একটি বড় রাজনৈতিক দল ও দলটির সমর্থকগোষ্ঠী নির্বাচনের বাইরে থেকে গেছে। ফলে এবারের নির্বাচনকে কোনো অর্থেই অংশগ্রহণমূলক বলা যাবে না।’ এই কলামিস্ট আরো লিখেছেন, ‘একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে হলে সব দলের অংশগ্রহণ থাকতে হবে এবং ভোটারের উপস্থিতি বেশি থাকতে হবে। এ দুটোর কোনোটিই এবারের নির্বাচনে দেখা গেল না।’

এবারের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। আর টেনেটুনে এটাকে অংশগ্রহণমূলক বলা গেলেও, প্রতিযোগিতামূলক ছিল না। সব ছিল কেবল ভোটার ছাড়া। নির্বাচন কমিশনের হিসেবেই বেলা ৩টা পর্যন্ত সারা দেশে ভোট পড়েছে ২৬.৩৭ শতাংশ। ম্যানিপুলেশন ছাড়া ২৪-২৫ শতাংশের বেশি ভোটার পাওয়ার কথা না। রাতে নির্বাচন কমিশন বলেছে, ভোট পড়েছে সারা দেশে ৪০ শতাংশের মতো। আর আওয়ামী লীগ চেয়েছে ৫১ শতাংশ, যা হয়নি। শেষ পর্যন্ত ভোটার টানতে ক্ষমতাসীনরা ব্যর্থ হয়েছে। উপরোক্ত কলামিস্ট তার লেখা শেষ করেছেন এই ভাষায়, ‘সবদিক মিলিয়ে এবার সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার একটা নির্বাচন হলো। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী আরেকবার আইনগতভাবে ক্ষমতায় থাকার বৈধতা পেতে যাচ্ছে। কিন্তু তারা নৈতিক বৈধতার সঙ্কটে পড়ছে।’

ভোটের আগের দিন দেখলাম, সন্ধ্যার একটু আগে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট একজন কি যেন খেতে খেতে যাচ্ছেন। আমার বাসার কাছের ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একটা ট্রেনিংও হলো। কিন্তু শুধু ভোটারের অভাব। এ যেন ‘যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়া পড়শির ঘুম নাই’ এর মতো। টিভিতে বারবার প্রচার করা হয়েছে নির্বাচন কমিশনের একটি বিজ্ঞাপন ‘নির্বাচন আচরণবিধি মেনে চলুন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়তা করুন।’ আসলে ক্ষমতাসীন দলই নিয়ম মানে নাই। কথায় বলে, ‘আপনি আচরি ধর্ম; অপরে শেখাও।’ প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতানেত্রীরা মানুষকে ভোট দিতে আহ্বান জানিয়েছেন। ভালো কথা, ‘কিন্তু ভোটার যত কম হবে, তত তাদের সুবিধা। ভোটার বেশি আসলে ইচ্ছামতো করা যায় না।

টিভিতে বারবার নির্বাচনের একই ছবি, একই খবর প্রচার করা হয়েছে। মহিলাদের লাইন দেখানো হয়েছে, কিন্তু পুরুষদের লাইন দেখা যায়নি। বিরোধীদল বলেছে, এটি ডামি ভোটারের লাইন। মহিলাদের মধ্যে হাতে শাঁখা, কপালে টিপসহ বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকজনই বেশি ছিল। টিভির খবরে জাতীয় পার্টির প্রধান জিএম কাদের বলেছেন, ‘আমাদের কোরবানি করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন নেতৃত্ব যা চেয়েছে, তাই হয়েছে।’ অর্থাৎ নেতৃত্বের ইচ্ছায় নৃত্য করতে হয়েছে।

ক্ষমতাসীনদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একজন মিত্র, জিএম কাদেরের কথা থেকে বুঝা যায়, গত ৭ তারিখে এ দেশে কী হয়েছে। আসলে নির্বাচনকে সবসময় প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে হয়। এজন্যই বলা হয়, ‘ Without Confrontration, there is no progression..' এদেশে বিএনপি ছাড়া নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে না, এটা সবার জানা কথা। আওয়ামী লীগের এ নির্বাচনে জিতে কোনো লাভ নেই। নির্বাচনকে টেকসই হতে হয়। নয়তো, বিকৃত গণতন্ত্র ও হাইব্রিড গণতন্ত্রের তকমা বহন করে চলতে হবে। সরকার একদিকে ডিজিটাল করতে চায় সব কিছুকে। অন্যদিকে, গণতন্ত্র নির্বাচন থেকে দিন দিন নির্বাসনে চলে যাচ্ছে। মানুষ মুখ টিপে হাসে। এটাই সরকারের ‘ডিজিটাল গণতন্ত্র’।

আসলে ভোটাধিকার শুধু স্বাধীনতা নয়; এটা সরকারের দায়িত্ব ও জনগণের অধিকার। অথচ, এবার নির্বাচন এমন হয়েছে যে, প্রার্থীর রকমফের ছিল। খাঁটি, ভাড়া করা, ডামি, জোটসঙ্গী, মুরগি প্রার্থী, বিক্রি হওয়ার মতো প্রার্থী ইত্যাদি হরেক কিসিমের প্রার্থীর হইচই। সুষ্ঠু নির্বাচন জনগণের অধিকার। আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশনগুলো এতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন চায় না। সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র এ দেশে আসবে না। ভোট শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হলেই সুষ্ঠু হয় না- এ কথাটাও মনে রাখা দরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হয় না। নির্বাচনকে হতে হবে অংশগ্রহণমূলক, প্রতিযোগিতাপূর্ণ, স্বাধীন, সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও টেকসই, তথা গণতান্ত্রিক। এই নির্বাচন বিএনপি, জামায়াত ছাড়া শুধু আওয়ামী লীগ দিয়ে সম্ভব নয়। এ নির্বাচনের জন্য লড়াই করতে হবে। নয়তো যত হাঁকডাক চলুক, নির্বাচন টেকসই হবে না। নির্বাচন হবে নির্বাচনের মতো, রাশিয়া বা উত্তর কোরিয়ার মতো নয়। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয়, সেজন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। ক্ষমতাসীনদের মনে রাখতে হবে, ‘এই দিন, দিন নয়, আরো দিন আছে; এই দিন নিয়ে যাবে ঐ দিনের কাছে।’ নির্বাচন কমিশনকেও তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। ক্ষমতাসীন দল ও সরকারকেও তার দায়িত্ব পালন করতে হবে।

আমাদের দেশের ভোটাররা প্রধানত পুরুষ। কিন্তু টিভিতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানো একাধিক ছবিতে দেখা যায়, মহিলা ডামি ভোটারদের লাইন; পুরুষরা গেল কই? চট্টগ্রামের মিরসরাইতে ভোটের দিন বেলা বাড়ার সাথে সাথে ভোটকেন্দ্র ভোটারশূন্য হয়ে পড়ে। টিভিতে আরো দেখা যায়, অনেকে শিশুসন্তানকে নিয়ে সেদিন ভোটকেন্দ্রে গেছেন। অথচ ওরা ভোটার নয়। আসল ভোটার কয়জন গেছেন, সেটাই প্রশ্ন। ঢাকাতে হরতালের মধ্যেও সাধারণত গাড়ি চলে। অথচ নির্বাচনে এই রাজধানীতেই ভোটার কম গেছেন। এটা বিদেশী পর্যবেক্ষকরাও স্বীকার করেছেন। তা না হলে ভোট দেয়া ২৫ শতাংশ ভোটার ৪০ শতাংশ হয় না।

গণতন্ত্রে নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনভাবে এতে প্রার্থীদের বাছাই করতে হবে। জনগণই ঠিক করবে, জনপ্রতিনিধি কারা হবেন। সঠিক প্রার্থী বাছাই করা নাগরিকদের সবার দায়িত্ব। বিনা চাপে এই বাছাইয়ের কাজ সম্পন্ন করতে হয়। অথচ আমাদের দেশের সরকার ব্যর্থ হয়েছে এই কাজ করতে। তারা ও সরকারি দল মিলে নানাভাবে চাপ দিয়েছে মানুষকে প্রার্থী বাছাই করতে, যেন নিয়ম হয়ে গেছে ‘আমার ভোট আমি দেবো, তোমার ভোটও আমি দেবো।’ অথচ এটা হওয়ার কথা ছিল না। এই ‘অতি দরদে’র দৌরাত্ম্য বর্তমানে বেশি দেখা যাচ্ছে। এদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া দরকার; কিন্তু সরকারই এদের অর্থহীন প্রশ্রয় দিচ্ছে, তাই এই দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে নিষ্কৃতি মিলছে না।

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/806165