১৩ জানুয়ারি ২০২৪, শনিবার, ৩:২৩

রাতে ঢাকার সড়ক যেন উন্মুক্ত বাসস্ট্যান্ড

 

রাজধানীর আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড। সম্প্রতি রাত দেড়টার দিকে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার দুই পাশে ফুটপাত ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো সারি সারি লোকাল বাস। শুধু লোকাল বাসই নয়, কয়েকটি দূরপাল্লার বাসও পার্ক করা। আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন সরকারি কর্মকর্তাদের কলোনির দক্ষিণ দিক থেকে শুরু করে নীলক্ষেত মোড় পর্যন্ত এক কিলোমিটারের বেশি রাস্তায় দেওয়ান, বিকাশ, ঠিকানাসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানির শতাধিক বাস দাঁড় করানোয় সড়কের দুই-তৃতীয়াংশই দখল হয়ে গেছে। ফলে সরু রাস্তায় সাবধানে চলতে হচ্ছে অন্য যানবাহনকে।

রাত ২টার দিকে গুলিস্তান এলাকায় গিয়েও একই দৃশ্যের অবতারণা লক্ষ্য করা যায়। ফায়ার সার্ভিসের প্রধান কার্যালয়ের সামনে থেকে শুরু করে ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে বাসের সারি। এই এলাকার রাস্তায় বাস বেশি হওয়ায় রাস্তা আরও সরু হয়ে গেছে। এসব বাসের ফাঁক-ফোকরে ভবঘুরে ও মাদকাসক্তদের অবস্থান।

শুধু আজিমপুর কিংবা গুলিস্তান নয়, সম্প্রতি রাজধানীর তেজগাঁও লিঙ্ক রোড, রহিম মেটাল বটতলা, শহীদ তাজউদ্দীন রোড, মিরপুর কিডনি ফাউন্ডেশন থেকে মিরপুর কলেজের পেছনের শাখা সড়ক হয়ে শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামের মোড়, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে তিন রাস্তার মোড়, পুরান ঢাকার সদরঘাটে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে, গাবতলী, শ্যামলী, কল্যাণপুর, কমলাপুর, মহাখালীসহ একাধিক জায়গায় রাত ১২টার পর শত শত বাস পার্কিং অবস্থায় দেখা যায়। রাস্তাগুলো যেন হয়ে পড়েছে উন্মুক্ত বাসস্ট্যান্ড। সড়কের পাশে রাখা বাসের মধ্যে অনেক রাত পর্যন্ত হেলপার ও চালকরা আড্ডা দেন। অভিযোগ আছে, পার্ক করা বাসের ভেতর বা আড়ালে অনেক সময় চলে মাদক সেবন। রাতের নির্জন রাস্তায় পার্ক করা বাসের আড়ালে পথচারীদের ধরে নিয়ে ঘটে ছিনতাইয়ের ঘটনাও।

একাধিক বাসের লাইনম্যান জানান, স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি এবং পুলিশকে ম্যানেজ করে এসব বাস রাখা হয়। প্রতি রাতে বাসপ্রতি তাদের চাঁদা দিতে হয় ১২০ টাকা। যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, রাজধানীতে বাস আছে সাড়ে পাঁচ হাজারের কিছু বেশি। এসব গাড়ির মধ্যে ঢাকা শহরে অন্তত তিন হাজার গাড়ি রাখা হয় বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। বাসপ্রতি ১২০ টাকা করে তোলা হলে প্রতি রাতে সাড়ে ৩ লাখ টাকার বেশি চাঁদা উত্তোলন হয়। মাসের হিসাবে সে টাকার অঙ্ক দাঁড়ায় ১ কোটি ৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ বছরে শুধু রাজধানীতে বাস পার্কিংয়ে চাঁদাবাজি হয় ১২ কোটি ২৯ লাখ টাকা।

২০১৯ সালে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) করা পার্কিংয়ের খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, ওয়াটার ট্যাঙ্কার, লরি ইত্যাদি যানবাহনের জন্য রাতে শুধু স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত সড়কে নির্দিষ্ট ফির ভিত্তিতে পার্কিংয়ের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া গণপরিবহনের নিবন্ধনের অনুমতি দেওয়ার আগেই পার্কিংয়ের স্থান নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানিগুলো নামমাত্র জায়গা দেখিয়ে বিআরটিএ থেকে বাসের অনুমোদন নিচ্ছে।

বাস মালিকরা বলছেন, গাড়ির সংখ্যা বেশি হওয়ায় কিছু বাস রাস্তায় রাখতে হয়। এ ছাড়া রাস্তায় পার্কিংয়ের জন্য কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দিতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। প্রজাপতি পরিবহনের এমডি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাস রাখেন গাড়ির মালিকরা। এখানে কোম্পানির কিছু করার নেই। মালিকরা সড়কের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পাহারাদারদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে গাড়ি রাখেন।’ বিকাশ পরিবহনের চেয়ারম্যান হারুন-আর রশিদ বলেন, ‘বাইপাইল নবীনগরে আমাদের পার্কিং। আমরা সেখানে গাড়ি রাখি। সকালে যাওয়ার জন্য কয়েকটি গাড়ি আজিমপুরের রাস্তায় রাখা হয়। আবার কিছু ড্রাইভার টাকা-পয়সা না দিয়ে ক্যাশ নিয়ে গাড়ি ফেলে রেখে চলে যান।’

এ বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘রাজধানীতে টার্মিনাল নেই, তাই সড়কে বাস রাখা হয়। টার্মিনাল থাকলে এ সমস্যা হবে না।’ রুট পারমিটের সময় পার্কিংয়ের জায়গা দেখানোর আইন রয়েছে– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই আইন ব্রিটিশ আমলের। ওই আইনের কার্যকারিতা নেই।

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখি বাসের অনুমোদনের সময় রাজনৈতিক প্রভাব এবং সুপারিশের মতো ঘটনা ঘটে। সে ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান না করেই অনুমোদন দিয়ে দেয়। এগুলো নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে এবং যথাযথ জবাবদিহি নিশ্চিত না করতে পারলে কাগুজে নীতিমালা সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কোনো কাজে আসবে না।’

ট্রাফিক তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) শাহেদ আল মাসুদ বলেন, ‘ঢাকার ভেতরে টার্মিনালে যে জায়গা, বাসের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। তাই রাস্তার ওপর গাড়ি রাখতে দিতে হয়। তাছাড়া রাতে সড়কে গাড়ির চাপও কম থাকে। তবে আমরাও বারবার বলে আসছি, এ ধরনের টার্মিনাল শহরের প্রান্তসীমায় নিয়ে গেলে ভালো হয়।’

সার্বিক বিষয়ে বিআরটিএ রোড সেইফটি বিভাগের পরিচালক মাহবুব-ই রব্বানী বলেন, ‘সড়কে গাড়ি থাকার কথা নয়। পরিবহনের রুট পারমিট দেওয়ার জন্য আট সদস্যের কমিটি আছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কমিটির কাছে দিলে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।’

https://www.samakal.com/capital/article/217786