১০ জানুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ১১:১৮

নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি : যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য

যা ঘটছে তার প্রতি নজর রাখছেন জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব

 

বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর বলেছে, হাজারো রাজনৈতিক নেতাকর্মী গ্রেফতার ও নির্বাচনের দিন অনিয়মের খবরে আমরা উদ্বিগ্ন। এই নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ না করা পরিতাপের বিষয়।
গতকাল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার এক বিবৃতিতে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগের মাসগুলোতে এবং নির্বাচনের দিন সহিংসতার নিন্দা জানায় যুক্তরাষ্ট্র। সহিংসতার এসব ঘটনা বিশ্বাসযোগ্যভাবে তদন্ত করে অপরাধীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহিত করছি। আমরা সব রাজনৈতিক দলকে সহিংসতা পরিহার করার আহ্বান জানাচ্ছি।

মিলার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণ এবং গণতন্ত্র, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার ও বাকস্বাধীনতার প্রতি তাদের আকাক্সক্ষাকে সমর্থন করে। যুক্তরাষ্ট্র লক্ষ করেছে, ৭ জানুয়ারি সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করেছে। হাজারো বিরোধী নেতাকর্মী গ্রেফতার ও নির্বাচনের দিন অনিয়মের খবরে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ ছিল না বলে অন্যান্য পর্যবেক্ষকের অভিমতের সাথে যুক্তরাষ্ট্র একমত। নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ না করা পরিতাপের বিষয়।

 

মুখপাত্র বলেন, সামনের দিনগুলোতে মুক্ত ও অবাধ ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে বাংলাদেশের অভিন্ন ভিশন এগিয়ে নিতে, বাংলাদেশে মানবাধিকার ও নাগরিক সমাজকে সমর্থন দিতে এবং দু’দেশের জনগণের মধ্যে সম্পৃক্ততা ও অর্থনৈতিক বন্ধন গভীরতর করার অংশীদাতিত্বের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে।

অন্য দিকে বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মানদণ্ড অনুযায়ী হয়নি, গণতান্ত্রিক হয়নি বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্য সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে, ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে আমরা অবগত। এই নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেনি। কাজেই বাংলাদেশের জনগণের হাতে ভোট প্রদানের জন্য সব বিকল্প উপস্থিত ছিল না। নির্বাচনের আগে ও নির্বাচন চলাকালে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। আমরা এর নিন্দা জানাই। রাজনৈতিক অঙ্গনে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কোনো স্থান নেই।

বিবৃতিতে বলা হয়, গণতান্ত্রিক নির্বাচন নির্ভর করে বিশ্বাসযোগ্য, অবাধ ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার ওপর। মানবাধিকার, আইনের শাসনের প্রতি সম্মান ও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অন্যতম অপরিহার্য উপাদান। নির্বাচনের সময়কালে এই মানদণ্ডগুলো ধারাবাহিকভাবে মেনে চলা হয়নি। আমরা ভোটের আগে বিরোধী দলের বহু সদস্যের গ্রেফতারে উদ্বিগ্ন।

যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ একটি ঐতিহাসিক ও গভীর বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ উল্লেখ করে এতে বলা হয়, দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে টেকসই রাজনৈতিক সমঝোতা ও সক্রিয় নাগরিক সমাজ গড়ে তোলার পরিবেশ তৈরি করা অপরিহার্য। আমরা আশা করি, সব রাজনৈতিক দল তাদের মতভিন্নতাকে পাশে রেখে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে এক হয়ে কাজ করবে। আমরা এই প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করতে সর্বদা প্রস্তুত রয়েছি।

যা ঘটছে, তার প্রতি নজর রাখছেন জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব : বাংলাদেশের পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে জাতিসঙ্ঘ। বাংলাদেশে যা ঘটছে, তার প্রতি নজর রাখছেন জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। গতকাল সোমবার জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের মুখপাত্রের কার্যালয়ের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন সংস্থাপ্রধানের সহযোগী মুখপাত্র ফ্লোরেন্সিয়া সোতো নিনো।

ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিক তার করা প্রশ্নে বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে জয় পাওয়ার দাবি করেছেন শেখ হাসিনা। যদিও এমন এক পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে, যেখানে হাজার হাজার মানুষ ও বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে কি মনে করে জাতিসঙ্ঘ?

জবাবে সহযোগী মুখপাত্র ফ্লোরেন্সিয়া সোতো নিনো বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতির দিকে তারা নজর রাখছেন। সেখানে যা ঘটছে, তার দিকে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবও নজর রাখছেন। বিরোধীদের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তের বিষয়টি তিনি জানেন। ভিন্নমত-সমালোচনা দমনসহ বিরোধী নেতাদের গ্রেফতারের সব অভিযোগের বিষয়ে তিনি অবগত।

সহযোগী মুখপাত্র আরো বলেন, নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের সময় সহিংসতার ঘটনার খবরে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব স্পষ্টতই উদ্বিগ্ন। তিনি সবপক্ষকে সবধরনের সহিংসতা পরিহার করতে বলেছেন। মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি যাতে পূর্ণ শ্রদ্ধা দেখানো হয়, তা নিশ্চিতে সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। সেখানে গণতন্ত্র সুসংহত ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য এটি অপরিহার্য।

বাংলাদেশের সব মানুষের ভবিষ্যৎ এখন ঝুঁকির মুখে : গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে অঙ্গীকার রক্ষা করতে বাংলাদেশের সদ্য নির্বাচিত সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে গত রোববারের নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের ওপর সহিংসতা ও দমন-পীড়নের ঘটনা পীড়াদায়ক। এই নির্বাচন সামনে রেখে বিগত মাসগুলোতে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে নির্বিচার আটক বা ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। এ ধরনের কৌশলগুলো সত্যিকার অর্থে প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য সহায়ক নয়। বাংলাদেশের সব মানুষের ভবিষ্যৎ এখন ঝুঁকির মুখে।

গত সোমবার রাতে দেয়া বিবৃতিতে তিনি আরো বলেন, আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দেশের সব নাগরিকের মানবাধিকার যেন সম্পূর্ণভাবে বিবেচনায় নেয়া হয় তা নিশ্চিত করা এবং দেশে একটি সত্যিকার অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য আবশ্যক শর্তগুলো পূরণে জোরদার পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ করছি। ভোট সামনে রেখে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা গণগ্রেফতার, হুমকি, গুম, ব্ল্যাকমেল ও নজরদারি- এসব পন্থা অবলম্বন করেছেন বলে খবর রয়েছে। আর এসবের কারণেই দেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নির্বাচন বর্জন করেছে। অগ্নিসন্ত্রাসের মতো রাজনৈতিক সহিংসতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটেছে বলেও খবর রয়েছে। বিরোধীরা অগ্নিসন্ত্রাস চালিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে গুরুত্বপূর্ণ নেতাসহ প্রায় ২৫ হাজার বিরোধী নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে উল্লেখ করে টুর্ক বলেন, গত দুই মাসে হেফাজতে থাকা অবস্থায় অন্তত ১০ জন বিরোধী নেতাকর্মী মারা গেছেন বা তাদের হত্যা করা হয়েছে বলে খবর রয়েছে। এতে আটক অবস্থায় নির্যাতন বা গুরুতর পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অনেক মানবাধিকারকর্মীকে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। অনেকে দেশ ছেড়েছেন। বিশেষত নভেম্বরেই কয়েক ডজন গুমের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, এসব ঘটনার স্বাধীন তদন্ত হতে হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের স্বচ্ছ ও ন্যায় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। নির্বাচনের প্রচার ও ভোটের দিন বিধি লঙ্ঘন ও সব অনিয়মের পুঙ্খানুপুঙ্খ ও কার্যকর তদন্ত করতে হবে।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার বলেন, ‘‘অনেক ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র অর্জিত হয়েছে। এটা যেন এখন লোকদেখানো হয়ে না পড়ে। বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে ‘রোল মডেল’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি, দেশের রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও এটার প্রতিফলন ঘটবে।’’

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/805257