৬ জানুয়ারি ২০২৪, শনিবার, ১১:৫৭

বিএনপিসহ বিরোধী দলের ১৭৫৩ নেতাকর্মীর কারাদণ্ড

‘একদলীয় শাসন কায়েমের উদ্দেশ্যে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দমন পীড়ন করা হচ্ছে’

 

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঢাকার আদালতগুলোতে গত প্রায় পাঁচ মাসে ১১৩ মামলায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলের এক হাজার ৭৫৩ জন নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। কারাগারে রয়েছেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতারা। ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের আগে ও পরে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব:) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মায়াজ্জেম হোসেন আলাল, মজিবুর রহমান সরোয়ার, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দনি চৌধুরী এ্যানীসহ প্রায় ২৪ হাজার নেতাকর্মী। নিম্ন আদালত ও উচ্চ আদালতে জামিন আবেদন করে এখনো তারা জামিন পাননি।
অপর দিকে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান এক বছর যাবৎ, সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার ২৮ মাস যাবৎ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ২৮ মাস যাবৎ ও ঢাকা মহানগরী উত্তর জামায়াতের আমির সেলিম উদ্দিন ৯ মাস যাবৎ কারাগারে আছেন। সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী ৩১ মাস যাবৎ কারাগারে আটক রয়েছেন। তারা সবাই জামিন লাভের পর তাদের নামে নতুন নতুন মামলা দিয়ে মুক্তির পথ রুদ্ধ করা হয়েছে বলে জামায়াত নেতাদের আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন।

আইনজীবীদের অভিযোগ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে ভিন্ন মত ও পথের মানুষদেরকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েমের উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করছে। যার ফলে আগামী ৭ জানুয়ারি বিরোধী দল ও ভোটারবিহীন একটি তামাশার নির্বাচন হতে যাচ্ছে। আইনজীবীদের দাবি, সম্প্রতি নিম্ন আদালতে রাজনৈতিক মামলাগুলো তড়িঘড়ি করে রায় দেয়া হচ্ছে। মামলা নিষ্পত্তি করতে গিয়ে ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম, ফৌজদারি কার্যবিধি সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। কোনো কোনো মামলায় রাত ৯টা পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ, আসামির অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য নেয়া এমনকি ছয় কার্যদিবসে চার্জ গঠন, সাক্ষ্যগ্রহণ, যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন, ৩৪২ মামলার রায় ঘোষণার কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এই ঘটনা নজিরবিহীন।

আইনজীবীদের অভিযোগ রাজনৈতিক নেতাদেরকে ক্রিমিনাল মামলার আসামি সাজিয়ে বিচারের নামে তাদেরকে অপমান অপদস্থ করা হচ্ছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়ার পরও জাতীয় নেতাদেরকে মাসের পর মাস কারাগারে আটক রাখা হয়েছে।
বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল জানিয়েছেন, সরকার ২৮ অক্টোবরের তিন দিন আগে থেকে এবং ২৮ অক্টোবরের পরে বিএনপির ২৪ হাজার, ২৮১ জন নেতাকর্মীদেরকে অন্যায়ভাবে কারাগারে অন্তরীণ করেছে। গত পাঁচ মাসে মোট ১১৩টি মামলায় সর্বমোট এক হাজার ৭৫৩ জন বিএনপি নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। অপর দিকে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আরো প্রায় ১০০ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে এবং এসব মামলা কয়েক হাজার নেতাকর্মী আসামি বলে বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল জানিয়েছেন। তিনি জানান, বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আরো প্রায় শতাধিক মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলমান রয়েছে। তবে এসব মামলায় বিএনপির নেতাকর্মীদের পক্ষে ডিফেন্স আইনজীবীরা প্রয়োজনীয় আইনিসহায়তা দিতে পারছেন না, তাড়াহুড়া করা হচ্ছে।

তিনি আরো জানান, ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত এক লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি মামলায় বিএনপি ও বিএনপির সহযোগী গণসংগঠনগুলোর ৫০ লাখের বেশি নেতাকর্মী-সমর্থকদের আসামি করা হয়েছে।

বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল অভিযোগ করেন, একদলীয় শাসন কায়েমের উদ্দেশ্যেই বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দমন- পীড়ন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার আদালত ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্র হত্যার পথ সুগম করছে। সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে ভিন্ন মত ও পথের মানুষদেরকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েমের উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করছে। যার ফলে আগামী ৭ জানুয়ারি বিরোধী দল ও ভোটারবিহীন একটি তামাশার নির্বাচন হতে যাচ্ছে।

সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব:) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, মেজর (অব:) মো: হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ শাহজাহান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবীবুর রহমান, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মায়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিব-উন-নবী খান, তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী, স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল আলম, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম নীরব, বর্তমান সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনামুল হক, বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার ও ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সাবেক সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর। এ ছাড়া ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আবদুল কাদের ভূঁইয়া, রাজীব আহসান ও হাবিবুর রশীদ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান প্রমুখ রয়েছেন দণ্ডপ্রাপ্তদের তালিকায় রয়েছেন।

অপর দিকে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদকে একটি মামলায় কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

সম্প্রতিক সময়ে যেসব মামলায় সাজা হয়েছে, সেসব রাজনৈতিক মামলা মামলা বলে দাবি করেছে বিএনপি। দলটির আইনজীবী নেতারা বিভিন্ন সময় বলেছেন, মাঠের রাজনীতিতে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখতে পারেন, এমন নেতাকর্মীদের সাজা হচ্ছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের রাজনীতি থেকে বিতাড়ন করাই সরকারের উদ্দেশ্য।

তবে বিএনপি নেতাদের এমন দাবি সত্য নয় বলে দাবি রাষ্ট্রপক্ষের। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, মামলাজট কমাতে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে পুরনো মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখানে বিএনপি কোনো লক্ষ্যবস্তু নয়।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সিনিয়র অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, সরকার বিচার বিভাগের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এ ধরনের কর্মকাণ্ড করছে। তিনি বলেন, সরকার ২৮ অক্টোবরের জনসমাবেশের ভয় পেয়ে দমন-পীড়ন শুরু করেছে। তারই অংশ হিসেবে গায়েবি মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের জেলে দিচ্ছে। উচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত গ্রামেগঞ্জে মানুষের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালাচ্ছে। ভৌতিক মামলা দিয়ে জেল জরিমানা করা হচ্ছে। তারা ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে একটি নাটক করতে যাচ্ছে। এই ৭ জানুয়ারির নির্বাচন দেশে বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে না।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/804100