৫ জানুয়ারি ২০২৪, শুক্রবার, ১১:৩০

ফ্যাসিবাদ শুধু গণতন্ত্র নয় রাষ্ট্রবিনাশী

-ড. মুহম্মদ রেজাউল করিম  

 

ফ্যাসিবাদ এমন এক মতবাদ যাতে বিশ্বাসী শাসক সহজাতভাবে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে। ভিন্নমত দমন এ মতবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এটি ব্যক্তির ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং সহজাত গুণ প্রত্যাখ্যান করে। ফ্যাসিবাদী শাসক নাগরিকের চিন্তা, মত প্রকাশকে অপরাধ মনে করে। ব্যক্তি-স্বাধীনতা করে সঙ্কুুচিত। এ মতবাদে বিশ্বাসী শাসক কখনো দানবীয় হয়ে ওঠে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসন ধ্বংস হয়। ক্রমে একদলীয় শাসনব্যবস্থার দিকে ধাবিত হয়।

ফ্যাসিবাদের উর্বর ভূমি ইউরোপ হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। পেরুর আলবার্তো কেনিয়া ফুজিমোরি (১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত পেরুর রাষ্ট্রপতি ছিলেন), ফিলিপাইনের ফার্দিনান্দ মার্কোসকে (১৯৬৫ থেকে ১৯৮৬ মেয়াদে ফিলিপাইনের রাষ্ট্রপতি) ফ্যাসিবাদী শাসক হিসেবে অভিহিত করা হয়।

 

আমাদের দেশেও সাম্প্রতিক সময়ে ফ্যাসিবাদের উত্থান লক্ষ্যণীয়। উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থানে নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। মূলত যেকোনো উগ্র মতাদর্শ কর্তৃত্ববাদের দিকে যায়। এই উগ্র মতবাদে বিশ্বাসীগোষ্ঠী অন্য জাতিগোষ্ঠীর চেয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে। এ জাত্যাভিমান বা উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তা বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের মূল ভিত্তি। এ নতুন ফ্যাসিবাদী চিন্তা কখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, কখনো উন্নয়ন, কখনো কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন নামে বাংলাদেশে হাজির করা হয়েছে। এক ভয়ঙ্কর বিনাশী শক্তি কায়েম হয়েছে যার মাধ্যমে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়েছে। ভিন্নমতের প্রতি এ শক্তির বিন্দুমাত্র সহিষ্ণুতা নেই। ফলে কখনো আইনই হয়ে ওঠে দমনের হাতিয়ার। বিরোধী দল নির্মূলে আদালতের মাধ্যমে সাজা দেয়ার সে মহোৎসব এখন চলছে বাংলাদেশে।

ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থায় মানুষ সত্য বলতে ভয় পায়। জনগণ প্রতিবাদ করতে ভয় পায়। এ রেজিমে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। ভয়ের সংস্কৃতি চালু করে।

বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগীরা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত হাজার হাজার বিএনপি- জামায়াত নেতাকর্মী খুন হয়েছেন, প্রায় এক হাজার নেতাকর্মী গুম হয়েছেন। এ সবই করা হয়েছে শুধু ভয়ের সংস্কৃতি চালু করতে। যাতে ভয়ে সাধারণ জনগণ মুখ খোলার সাহস না পায়। গত কয়েক বছরে বস্তুনিষ্ঠ বেশ কয়েকটি ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ভিন্নমত দমনের চেষ্টা এখনো অব্যাহত। জার্মানিতে যেমন নাৎসিবাদ প্রতিষ্ঠায় ভিন্নমত নির্মূল করা হয়েছিল। বর্তমান সরকার গণতন্ত্রের নামে একদলীয় শাসনব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে যার পরিণতি নব্য বাকশাল! উচ্চ আদালতের দোহাই দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করা হচ্ছে। আবার নিজেদের পুষ্ট অনেক দলকে নিবন্ধন দিচ্ছে। সভা-সমাবেশের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করছে। বিভিন্ন নজরদারি সরঞ্জাম কিনে নাগরিকের গোপনীয়তা ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার ওপর আঘাত হানছে।

ফ্যাসিস্ট শক্তি বিভিন্ন কালাকানুন তৈরি করে বিরোধীদের দমন করে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট, বিশেষ ক্ষমতা আইন, সন্ত্রাস দমন আইন ইত্যাদি বাংলাদেশের বর্তমান ফ্যাসিস্ট রেজিমের হাতিয়ার। নাগরিক অধিকার হরণের জন্য ফ্যাসিস্ট শক্তি এসব কালাকানুন ব্যবহার করছে।

ফ্যাসিবাদে বিশ্বাসীগোষ্ঠী অহঙ্কারী হয়ে ওঠে। তখন আর কাউকে তারা তোয়াক্কা করে না। অহংবাদ: ইগোইজম, অর্থাৎ নিজের সত্তা বা অস্তিত্ব ব্যতীত অন্য কিছুকে স্বীকার না করা কর্তৃত্ববাদের চূড়ান্ত ফসল। কোনো শাসক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষ যখন শাসিতের মতামতের ধার না ধেরে একচ্ছত্রভাবে শাসনকাজ চালিয়ে যায় তখন তার বা তাদের শাসনকে বলে কর্তৃত্ববাদ (ডিক্টেটরশিপ)। কর্তৃত্ববাদ সর্বদাই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের স্বার্থে প্রতিপক্ষের ওপর সার্বিক নিষ্পেষণ চাপিয়ে দেয়।

আজকের বিশ্বায়নের যুগে প্রতিদিনই সব কিছু দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রতিযোগিতারও শেষ নেই। গঠনমূলক ও ধ্বংসাত্মক দুটোই আছে। মানুষ বর্বর থেকে আধুনিকতায় আর অসভ্যতা থেকে সভ্যতায় উত্তীর্ণ। ব্যক্তি, সমাজ, দল ও রাষ্ট্রের সব কিছুই অবস্থাভেদে পাল্টে যাচ্ছে।
ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও যেমন ঘটেছে পরিবর্তন, সমাজ সভ্যতা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাতেও প্রাসঙ্গিক যৌক্তিক পরিবর্তন এসেছে। এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যতিক্রম ঘটিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিশ্বের তাবৎ বিষয় পরিবর্তন হলেও নিজেদের বদলাতে পারেনি দলটি। আসলে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় কঠিন কাজ হচ্ছে নিজেকে পাল্টানো।

মানুষের চিন্তা-চেতনা কর্মকাণ্ড সব কিছুই মানুষ পরিচালনা করছে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে। কিন্তু আওয়ামী লীগের রয়ে গেছে আগের মতোই। বাকশালী চেতনা, একনায়কতান্ত্রিক মানসিকতা, স্বৈরাচারী অবয়ব, উচ্ছৃঙ্খলতা ও উগ্র ভাষা সবই তারা সযতেœ লালন করছে আজো।

মানুষ দুনিয়াতে আর যাই করুক না কেন, সীমা অতিক্রম করলে আল্লাহ তায়ালা আর কাউকে ছাড় দেন না।
তবে ফ্যাসিবাদীরা দু’টি শক্তিকে খুব ভয় পায়। ১. ঐক্যের শক্তি ও ২. চারিত্রিক শক্তি। মানুষ নীতি ও নৈতিক অবস্থান থেকে ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থায় মানুষ মানবিক গুণাবলি প্রকাশ করতে পারেন না। সঙ্গত কারণে চিন্তাশীল, রুচিসম্মত, ক্রিয়াশীল মানুষ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। মানুষের জ্ঞানের বিকাশ, বুদ্ধির চর্চা, নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে একটি মুক্ত, স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশের কোনো বিকল্প নেই। তবে ফ্যাসিস্টরা সহজে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে চায় না।


যেমন ইউরোপ থেকে ফ্যাসিবাদ নির্মূলে দু’টি বিশ্বযুদ্ধ হতে হয়েছে। ফ্যাসিবাদ হটাতে দল-মত ব্যক্তিগত বিরোধের ঊর্ধ্বে উঠে সবাইকে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। গণ-আন্দোলন শুরু করতে হবে, যার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট শক্তির পরাজয় ঘটবে। একই সাথে নতুন বাংলাদেশ রচনা করা সম্ভব হবে।

 

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/803764/