৫ জানুয়ারি ২০২৪, শুক্রবার, ১১:২৯

চারদিকে ক্লাউনের ভিড়

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

 

এখন জাতীয় সংসদের তথাকথিত পাতানো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই সরকারের অধীনে গত পনেরো বছরে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পর্যন্ত সবকিছুই ছিল পাতানো। এর অধিকাংশ নির্বাচনই কুশীলবরা সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের সদস্য। অন্যরা যে কেউ ছিল না এমনও নয়। কিছু কিছু ছিল।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো ছিল রাজনৈতিক দলের বাইরে। যোগ্য, সৎলোক যাতে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারে তার জন্যই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় মার্কার প্রচলন ছিল না। সংসদ নির্বাচনে দলীয় মার্কার প্রচলন যেমন ছিল তেমনি ছিল হাঙ্গামা, হানাহানি, খুনোখুনি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যক্তির নামে যত না ভোট চাওয়া হয় তার চেয়ে বেশি ভোট চাওয়া হতো মার্কার নামে। তার ফাঁক দিয়েই বরাবরই কিছু যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে আসতেন। তাতে জাতীয় সংসদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেতো। কিছু জ্ঞান ও যুক্তির কথা আলোচিত হতো। আইন প্রণেতারা আইনের খুঁটিনাটি দিক নিয়ে জাতীয় সংসদে বিস্তারিত আলোচনা করতেন। সরকারি দল ও বিরোধী দলে নির্বাচিত কিছু শিক্ষিত ব্যক্তি। তাদের আলোচনায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠতো জাতীয় সংসদ। 

এখন সংসদে এরূপ আলোচনা হয় না বললেই চলে। এখন সংসদ এক ব্যক্তির  আঙ্গুলি হেলনে পরিচালিত হয়। বেছে বেছে এমন সব লোকদের নির্বাচিত করে আনা হয়, যাদের নিজস্ব কোনো মত নেই। পড়াশোনা তো নেইই। যে যত বড় মাস্তান তার কদর ততটাই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখন নীতিনৈতিকতা উঠে গেছে। যে যত বড় আর্থিক অনিয়মকারী তার কদর তত বেশি। এক এক মন্ত্রী গত পাঁচ বছরে দশ গুণ পনেরো গুণ সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। তাকে জিজ্ঞাসা করার কেউ নেই। কেমন করে তিনি এতো সম্পত্তির মালিক হলেন, যে কথা কেউ তাকে জিজ্ঞেস করছেন না। বনানীতে ১৮০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন ৪শত টাকায়। হলফনামায় যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তা থেকে বোঝা যায় লুণ্ঠনের কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছে সরকার দেশকে। 

 দেশ এখন কার্যত লুটেরাদের রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো বিনিয়োগকারী ব্যাংকগুলোকে ফোকলা করে ফেলেছেন। অস্তিত্ব নেই এমন জায়গাজমিকে সম্পদ দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লোন দেয়া হচ্ছে। এক এস আলম গ্রুপই শুধুমাত্র সিঙ্গাপুরে পাচার করে নিয়ে গেছে ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি। আদালতের নির্দেশে এ নিয়ে তদন্তের উদ্যোগ চেম্বার আদালতে থামিয়ে দেয়া হয়েছে। আট জানুয়ারি পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো তদন্ত চলবে না। টিআইবি বলেছে, এই সরকারের পনেরো বছর ব্যাংকগুলো থেকে ৯৩ হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, টিআইবি দেখাক, কোথা থেকে কে কে এই টাকা পাচার করেছে।  এ প্রশ্ন করার কোনো অবকাশ  ছিল না। কারণ টিআইবি রিপোর্টের সঙ্গে তথ্য-প্রমাণ দিয়ে দিয়েছে। ও রকম প্রশ্ন না করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেন, তাহলে বিষয়টা ন্যায্য হতো। কিন্তু না মন্ত্রীরা এখন বলেন, অপরাধীকে ধরে এনে দেন, আমরা ব্যবস্থা নেব। তাই যদি হয় তাহলে আপনারা ঠ্যাংগের ওপর ঠ্যাং রেখে মন্ত্রীত্ব করছেন কিভাবে। একজন মন্ত্রীর বিদেশে ২০৩০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। টিআইবি সেই মন্ত্রীর নাম প্রকাশ করতে চায়নি। কিন্তু কাদের টিআইবিকে চ্যালেঞ্জ করলে তার নাম প্রকাশ করে দেয় টিআইবি। তিনি হলেন ভূমি মন্ত্রী সাইদুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ। এই সম্পদ তিনি তার হলফনামায় প্রকাশ করেননি। এক যুক্তরাজ্যেই রয়েছে তার ৮টি রিয়াল এস্টেস্ট কোম্পানি। আর টিআইবির কাছেও রয়েছে ভূমিমন্ত্রীর সম্পদ সংক্রান্ত এই তথ্য। একথা প্রকাশিত হওয়ার পর খামোশ হয়ে গেছেন ওবায়দুল কাদের। তিনি আর কোনো কথা বলেননি। এস আলম সম্পর্কে মিনমিনে গলায় বলা হয়েছিল বিষয়টি আদালত করেছে। আমাদের কি করার আছে?

১৯৬৪-৬৫ সালের দিকে পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল, “আর চিন্তা নাই, ছারপোকা মারার যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে।” দাম দুই টাকা আর পরিবহন খরচ আট আনা। বিরাট ঘটনা আমরা চার-পাঁচ বন্ধু চাঁদা দিয়ে সেই যন্ত্রের অর্ডার দিলাম। চার-পাঁচদিন পর আমাদের হাতে এলো একটি সুদৃশ্য প্যাকেট। তার ভেতরে সুন্দর মসৃন ছোট ছোট সমান মাপের দুই টুকরো কাঠ। সঙ্গে নীল এক টুকরো কাগজ। তাতে লেখা “ছারপোকা ধরে এক টুকরো কাঠের উপর রেখে আর এক টুকরো কাঠ দিয়ে চাপ দিন। ছাড়পোকার মৃত্যু অনিবার্য। প্রায় একই রকম ভ-ামী এখন জাতীয়ভাবে চলছে। মন্ত্রী-এমপিরা কখন কি বলছেন, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। ৬৪-৬৫ সালে যে প্রতারক কোম্পানি এমন প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিল এখন সর্বত্র একই ধরনের ফাঁদ। সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে কেউ প্রশ্ন করেনি। বিদেশে তিনি এতো টাকা কি করে পাঠালেন, কি করে বিনিয়োগ করলেন। 

যাই হোক, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে দলীয়ভাবে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছেন। ইউনিয়ন পদের সদস্য পদের জন্য এখন মার্কাই প্রধান। সেখানেও মার্কার রাজনীতি ঢুকিয়ে দিয়ে খুনোখুনির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমন দেশ ও গণতন্ত্র বিরোধী পদক্ষেপের কথা আগে কেউ চিন্তাও করেনি। ফলে ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনেও এখন খুনোখুনি হচ্ছে। 

এখন নির্বাচন কমিশনে ঠুটো জগন্নাথদের ভিড়, মেরুদ-াহীন সরকারি নির্দেশে পরিচালিত নির্বাচন কমিশন এখন অসবরপ্রাপ্ত আমলাদের আশ্রয় কেন্দ্র। অনেকে ঠাট্টা করে বলেন, এটি আওয়ামী লীগের নির্বাচন কমিশন শাখা। এরা সরকার যেভাবে বলেন সেভাবেই বান্দরের খেলার মতো ডুগডুগি বাজিয়ে নাচতে থাকে। ফলে এরা ন্যূনতম বিশ্বাস যোগ্যতা ও সম্মান হারিয়ে ফেলেছে। নির্বাচন কমিশন কি বললো না বললো পাবলিক সেটা নিয়ে থোড়ায় পরোয়া করে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে একটি তথাকথিত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। তাতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী যেই হোক কলাগাছ ডাবগাছ সবাই বিনা প্রতিদ্বিন্দ্বিতায় পাশ করেছিলো। সেই তথাকথিত নির্বাচন ১৫৩ জনকে বিনাভোটে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছিলো।

পৃথিবীর ইতিহাস এরকম ঘটনাই ছিলো প্রথম। হিটলারেরও নির্বাচনে জিততে ভোটাভুটি করতে হয়েছিলো। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সে ভোট বর্জন করেছিলো বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। এমনকি আওয়ামী লীগের বিটিম বলে পরিচিত কুখ্যাত এরশাদ ও সে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছিলো। কিন্তু সরকার এরশাদের উপর ভারতের চাপ সৃষ্টি করে সে মনোনয়ন পত্রগুলো প্রত্যাহার না দিখেয়ে বহাল দেখায়। এবং কিছু আসনে জাতীয় পার্টিকে বিজয়ী ঘোষণা করে তাদের দিয়ে তৈরি করে এক গৃহপালিত বিরোধী দল। বিরোধীদল হলে জাতীয় পার্টি থেকে বেশ কয়েক জনকে মন্ত্রী করা হয়। এরশাদকে করা হয় মন্ত্রীর পদ মর্যাদায় শেখ হাসিনার বিশেষ দূত। তারপর এরশাদ চেপে যান

তখন থেকেই সরকারের পা চাটা কিছু মিডিয়ার লোকজন এই বলে সমালোচনা করতে থাকে যে, নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপি বড় ভুল করলো। তাদের বক্তব্য হলো বিএনপি যদি আট দশটা সিটও পেতো তা হলে সংসদ  কাঁপিয়ে দিতে পারতো। এই সব বেহায়া সরকারের উচ্ছিষ্ট ভোগী“ মিডিয়া ব্যক্তিত্ব” বিএনপির বিরুদ্ধে তাদের প্রচার চালিয়ে যেতে থাকে। 

এরপর আসে ২০১৮ সালের আর এক তথাকথিত নির্বাচন। প্রশাসন ও পুলিশ মিলে আগের রাতেই ৬ শতাংশ ভোট কেটে ব্যালট বাক্স ভরে রাখে। নানা সমালোচনার মুখে এই নির্বাচন বিএনপি অংশগ্রহণ করে এবং তাদেরকে মাত্র ৫ টি আসনে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

কিন্তু সরকারের উচ্ছিষ্টভোগী মিডিয়া, দালালেরা বলতে থাকেন যে, এই পাঁচটি আসন দিয়েই ৩২৫ জনের বিরুদ্ধে বিএনপির লড়ে যাওয়া উচিত। বিশ^ব্যাপী একথা প্রচার হয়ে যায় যে বাংলাদেশে দিনের ভোট রাতেই হয়ে যায়। আর নির্বাচনের নামে এখানে চলে প্রহসন। এর মধ্যে এসে গেছে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদের তথাকথিত নির্বাচন। পশ্চিমা দুনিয়া দাবি করতে থাকে যে অবাধ সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দিতে হবে। এনিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে মুখোমুখি শেখ হাসিনা সরকার। তারা বাংলাদেশকে একঘরে করার জন্য স্যাংশন ভিসা নিষেধাজ্ঞা ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দিতে বসেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এমনিতেই তলানিতে তার উপর এসব নিষেধাজ্ঞা এলে দেউলিয়া হয়ে যাবে অর্থনীতি। গামের্ন্টসের লক্ষ্য লক্ষ্য শ্রমিক বেকার হবে। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা এখনকার চাইতেও ভয়াবহ রূপে নেবে। 

এই নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপি জামায়াত সহ সমমনা ডান বাম দলগুলো। ফলে বিএনপির উপরে পৈশাচিক নির্যাতন চালাচ্ছে সরকার। প্রথম, দ্বিতীয় তৃতীয় সারির সকল নেতা কর্মীকে আটক করে জেলে ভরা হয়েছে। শেখ হাসিনা নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখানোর জন্য নিজেদের দলীয় গঠনতন্ত্র লংঘন করে নৌকার বাইরে দলীয় নেতা কর্মীদের প্রার্থী হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এখন নৌকা ও আওয়ামী স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংঘাত সংঘর্ষ চলছে। ইতিমধ্যে প্রাণ গেছে কমপক্ষে চার জনের। নির্বাচনটা এমনভাবে সাজানো হয়েছে নৌকা হোক, স্বতন্ত্র হোক, জাতীয় পার্টি হোক, যেই জিতুক সেই হবে আওয়ামী লীগের লোক। বেশি সংক্যক লোককে ভোটদান কেন্দ্রে হাজির করার জন্য সরকার বহুরকম কুৎসিত পথ অবলম্বন করেছে। এর মধ্যে কিংস পার্টি খ্যাত মেজর জেনারেল সৈয়দ ইব্রাহিম ও সাবেক আমলা বিএনপি থেকে পদত্যাগকারী শমসের মবিনকে কুমির ছানা হিসাবে দেখানোর জোর প্রচেষ্টা চলছে। সরকারের নতুন থিওরি বেশি লোক আনতে পারলেই সে নির্বাচন হবে অংশগ্রহণমূলক। পৃথিবীর কেনো গণতান্ত্রিক দেশ এই গোঁজামিলের নির্বাচন মানছে না। তৈমুর ইব্রাহিম ও শসসের মবিন ক্লাউনের মতো নাচছে। 

এই পরিস্থিতিতে যদি ৭ জানুয়ারির তথা কথিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ও তা কোনো স্থায়ী রূপ পাবে বলে কেউ বিশ্বাস করে না।

https://www.dailysangram.info/post/545168