৪ জানুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১০:০৪

চট্টগ্রামে তীব্র গ্যাসসঙ্কট : চুলা না জ্বলায় খাবার জোগাতে হিমশিম

 

- ৩ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ
- পাম্প হাউজে অচলাবস্থা

 

শীত না আসতেই বন্দর নগরী চট্টগ্রামে গ্যাসসঙ্কট তীব্র রূপ নিয়েছে। মহেশখালী থেকে এলএনজির সরবরাহ কমে যাওয়ায় চট্টগ্রামের শিল্প-কারখানা, বাসাবাড়ি ও সিএনজি স্টেশনে গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসসঙ্কটতো আছেই। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চট্টগ্রামে এলএনজির সরবরাহ ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট কমে গেছে। এর ওপর বোরো মৌসুম সামনে রেখে বহুজাতিক কাফকো ও রাষ্ট্রায়ত্ত সিইউএফএল সার কারখানা দু’টিতে পুরোদমে গ্যাস সরবরাহ দিতে হচ্ছে। ফলে বন্ধ রাখা হয়েছে তিনটি গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র। বাসাবাড়িতে রাতে-দিনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় খাবার জোগাতেই নগরজুড়ে হাহাকার পড়ে গেছে।

এমনিতেই চাহিদার তুলনায় বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহের, যা মিলছে তাও চট্টগ্রামের গ্যাস সরবরাহ অনেকটাই আমদানিকৃত এলএনজিনির্ভর হয়ে পড়েছে। কিন্তু মহেশখালীতে স্থাপিত দু’টি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে একটির (জাহাজের) রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ড্রাইডকিং করতে গিয়েই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। সূত্র মতে, দৈনিক ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি পাইপলাইনের মধ্যে আসার কথা থাকলেও বর্তমানে তা পাঁচ শ’ মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে। ফলে এতদিন পাইপলাইনে আসা এলএনজির মধ্যে চট্টগ্রামের জন্য ২৭০ মিলিয়ন ঘনফুট রেখে বাকিটা পাঠানো হতো। কিন্তু সরবরাহ কমে যাওয়ায় চট্টগ্রামের জন্য এলএনজির বরাদ্দও কমে যায়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এলএনজির পাশাপাশি গ্যাসক্ষেত্রগুলোর গ্যাসের জোগান রয়েছে। ফলে সেখানে সঙ্কট তীব্র হয় না। কিন্তু চট্টগ্রাম অঞ্চলের গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পুরোপুরি এলএনজি নির্ভরতা চট্টগ্রামের মানুষকে বেশ ভোগাচ্ছে। দুই দিন ধরে তীব্র গ্যাসসঙ্কটে নাগরিকরা গাড়ি নিয়ে সিএনজি স্টেশনে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছে। বাসাবাড়ির দুরবস্থাতো আছেই।

গ্যাসের চাপ সঙ্কটের তীব্রতায় নাগরিক দুর্ভোগ চরমে। গ্যাসের চাপ সঙ্কটে গত এক সপ্তাহ ধরে বিস্তীর্ণ এলাকার বাসাবাড়ির রান্নাবান্না প্রায় বন্ধই বলা চলে। ফলে উচ্চ ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক সামগ্রী যেমন রাইস কুকার, ইলেকট্র্রিক কেটলি, ইনডাকশন কুকার, ওয়াটার হিটার, মাইক্রোওভেন ইত্যাদির ব্যবহার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায়ও এসবের ব্যবহার মারাত্মক চাপ বাড়িয়েছে। কিন্তু গ্যাসসঙ্কটে আবার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকায় বিদ্যুৎ বিভাগ চাহিদানুযায়ী বিদ্যুতের জোগানও মিলছে না।

পেট্রোবাংলার তথ্যানুযায়ী গতকাল বুধবার চট্টগ্রামের গ্যাসনির্ভর রাউজান তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৮০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার পৃথক দু’টি ইউনিট, শিকলবাহা ৪০ মেগাওয়াট ও ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাস সরবরাহ দিতে না পারায় শাটডাউনে (বন্ধ) ছিল।
পেট্রোবাংলার তথ্যানুযায়ী গতকাল চট্টগ্রামে ২৪৩.৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেয়া হয়। এর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ১৮৫ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে গ্যাস সরবরাহ দেয়া হয় মাত্র ২৩.৭ মিলিয়ন ঘনফুট। এছাড়া বহুজাতিক সার কারখানা কাফকোকে ৪০.৮ মিলিয়ন ঘনফুট, রাষ্ট্রায়ত্ত সিইউএফএলকে ৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট এবং আবাসিক ও অন্যান্য বাণিজ্যিক গ্রাহক মিলে ১৩৪.২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সররবাহ দেয়া হয়। কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানির (কেজিসিএল) অপারেশন ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী আমিনুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, এমনিতেই সারা দেশে চাহিদার তুলনায় গ্যাসের সরবরাহ কম। পাশাপাশি ভাসমান এলএনজি স্টেশনের একটির (জাহাজ) ম্যানটেন্যান্সজনিত কারণে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়েছে। ফলে একটি এলএনজি স্টেশনের সরবরাহ দিয়েই চলতে হচ্ছে। ওই কম সরবরাহ দিয়েই কোনো রকমে চলছিল। কিন্তু এর ওপর গত কয়েক দিনে সরবরাহ আরো কমানো হলে পরিস্থিতি নাজুক পর্যায়ে পৌঁছে। এর বাইরে সামনে বোরো মৌসুম থাকায় দু’টি সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ পুরোদমে স্বাভাবিক রাখতে হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি গ্যাস রেশনিং করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে। পুরো সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে মাস দুয়েক লেগে যেতে পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর প্রতি চট্টগ্রাম চেম্বারের আহ্বান : বৃহত্তর চট্টগ্রামে শিল্প ও আবাসিক খাতে চলমান গ্যাস সঙ্কট ও গ্রাহক ভোগান্তি নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি ওমর হাজ্জাজ। গতকাল বুধবার এক পত্রের মাধ্যমে চেম্বার সভাপতি এ আহ্বান জানান। চেম্বার সভাপতি পত্রে বলেন, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০০-৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও আমরা এর বিপরীতে মাত্র ২৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের জোগান পেয়ে আসছি। জোগানকৃত এ গ্যাসের মধ্যে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ঘনফুটের অধিক গ্যাস কেবলমাত্র দু’টি সার কারখানা ও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। অবশিষ্ট গ্যাস নগরীর বিশালসংখ্যক আবাসিক গ্রাহক, শিল্পকারখানা ও সিএনজি স্টেশনে বিভিন্ন কৌশলগত পদ্ধতি অবলম্বন করে বণ্টন করা হচ্ছে। এতে করে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে শিল্পকারাখানা ও নগরীর বিশাল জনগোষ্ঠী সংবলিত আবাসিক খাত মারাত্মক গ্যাস সঙ্কটের সম্মুখীন হচ্ছে। পত্রে আরো উল্লেখ করা হয়- সম্প্রতি চট্টগ্রামে সরবরাহকৃত ২৮০ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মেঘনা ঘাটে বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতে দেয়ার নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এমন সময়ে যদি আরো ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস অন্য একটি অঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দেয়া হয় তাহলে গ্যাস সঙ্কটের কারণে চট্টগ্রামবাসীর চলমান এ ভোগান্তি আরো তীব্র আকার ধারণ করবে এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের সর্বস্তরের ব্যবসায়ী ও জনসাধারণের মধ্যে চরম অসন্তোষ, হতাশা ও নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে। তিনি শিল্পায়নের প্রধান নিয়ামক নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিতকরণসহ জনসাধারণের ভোগান্তি নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর প্রতি বিশেষ অনুরোধ জানান।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/803644