৩ জানুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ৩:০০

ভুলে ভরা পাঠ্যবই

‘কৈশোরের কথামালা’য় আপত্তি

 

বছরের প্রথম দিন প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দিয়েছে সরকার। নতুন বই পেয়ে খুশি খুদে শিক্ষার্থীরা। তবে বাংলাদেশে নতুন বই মানেই যেন ভুল থাকবেই। আর কারিকুলাম যদি নতুন হয় তবে এ ভুলের সংখ্যা হয় অগণিত।
এবার প্রাথমিক স্তরে দ্বিতীয় শ্রেণী আর মাধ্যমিকে অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে নতুন কারিকুলামে বই দেয়া হয়েছে। এসব বইয়ে নানা ভুলভ্রান্তি, বাক্য গঠনে অসঙ্গতির তথ্য পাওয়া গেছে।

আবার অষ্টম শ্রেণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক পরিবর্তনের বিষয়গুলোকে তুলে ধরা হয়েছে খুবই ‘খোলামেলা’ ভাষায়। যেখানে আপত্তিকর অনেক শব্দ রয়েছে। যা নিয়ে চরম আপত্তি জানিয়েছেন শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা। ঢাকা পোস্ট
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছর থেকে নতুন কারিকুলামে বই দেয়া শুরু হয়। ওই বছর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর ২২টি বইয়ে ৪২১টি ভুল-ভ্রান্তির সত্যতা পায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ভুলগুলো সংশোধন করে এপ্রিল মাসে এনসিটিবির ওয়েবসাইটে সংশোধনী দেয়া হয়। শিক্ষকরা সংশোধিত সিলেবাসে বাকি বছর শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেন। তড়িঘড়ি করে নতুন কারিকুলাম চালুর কারণে এমনটি হয়েছে বলে দাবি করা হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।

যেসব ভুল পাওয়া গেছে

এবার সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীতে নতুন কারিকুলামের বই দেয়া হয়েছে। এসব বইয়ে বড় ধরনের ভুল না পেলেও বানান, বাক্য গঠনে অসঙ্গতির মতো বিষয় পাওয়া গেছে। যদিও নতুন বইগুলোতে লেখা হয়েছে ‘বাংলা একাডেমির যে বানান নীতি রয়েছে তা অনুসরণ করে’।
নবম শ্রেণীর শিল্প ও সংস্কৃতি বইয়ের ভূমিকায় সহযোগিতা বানান লেখা হয়েছে সহযোগীতা। এখানে ‘‘ি’’-এর স্থলে ‘‘ ী’’ ব্যবহার করা হয়েছে।

একইভাবে এই বইয়ের ণত্ব বিধান ও ষত্ব বিধান মানা হয়নি। যেমন ‘ভূখণ্ড’ কে লেখা হয়েছে ‘ভাতখণ্ড’।
পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়- বাক্যটি এই বইয়ে ১৫ বার ব্যবহার হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ বার ‘পৃখিবী’ লেখা হয়েছে। এখানে ‘থ’ স্থলে ‘খ’ অক্ষর লেখা হয়েছে। আরেক জায়গায় প্রাতিষ্ঠানিকের পরিবর্তে প্রাতিষ্ঠানিক, পাকিস্তানকে লেখা হয়েছে পকিস্তান।

অষ্টম শ্রেণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে সুস্থ বানান লেখা হয়েছে সুস্থ্য। ‘য’ ফলা ব্যবহার করা হয়েছে, যা ভুল। এ ছাড়া বাক্য গঠনেও অনেক ভুল ও অসঙ্গতি ধরা পড়েছে।

এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, অষ্টম ও নবম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকের পাণ্ডুলিপি তাড়াহুড়ো করে লেখা হয়েছে। এজন্য কিছু ভুল থাকতে পারে। ভুলগুলো চিহ্নিত করার পর সংশোধন করে আগামীতে আবার বই ছাপানো হবে। বড় ধরনের কোনো ভুল পাওয়া গেলে তা কারেকশন আকারে শিক্ষকদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে। তারা সেই মোতাবেক শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাবেন।

অষ্টম শ্রেণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে আপত্তিকর অধ্যায়
অষ্টম শ্রেণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে ‘কৈশোরের কথামালা’ অধ্যায়ে ১৬টি পৃষ্ঠা রয়েছে। প্রত্যেক পৃষ্ঠায় কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো খোলামেলাভাবে আলোচনা করা হয়েছে। একটি ছেলে ও একটি মেয়ের নির্দিষ্ট বয়সের পর তাদের শারীরিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো কীভাবে হয় তা গল্প দিয়ে বোঝানো হয়েছে। গল্পের পর তাদের কুইজ-উত্তর লেখার অপশন রাখা হয়েছে।
শিক্ষাবিদরা শিক্ষার্থীদের শারীরিক পরিবর্তনের এ বিষয়গুলো আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোকে স্বাগত জানালেও যে ভাষায় তা উপস্থাপন করা হয়েছে তা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। তারা বলছেন, এই অধ্যায়টা কিশোর-কিশোরীদের বয়স উপযোগী হয়নি। এমনকি যেসব ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা আমাদের দেশের পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার সাথে যায় না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘আমরা পাঠ্য পুস্তকের মাধ্যমে বয়ঃসন্ধিকালের শিক্ষা দেব, এটা যেমন ঠিক তেমনি সেটা যেন আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট, পরিবেশ পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিক বিষয়ের সাথে মিল রেখে হয় সেটাও দেখা উচিত। কিন্তু অষ্টম শ্রেণীর বইয়ের একটি অধ্যায়ে বিষয়টিকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা খুবই দৃষ্টিকটু ও আপত্তিকর।’

তিনি বলেন, ‘কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক গঠন ও পরিবর্তনের বিষয়গুলো যেসব ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য তো নয়ই, বরং একধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে। এসব অধ্যায় যখন একজন পুরুষ শিক্ষক মেয়ে শিক্ষার্থীকে পড়াবেন কিংবা একজন নারী শিক্ষক যখন ছেলেদের পড়াবেন তখন তিনি কি ক্লাসে পড়াতে পারবেন?’

সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক রাখাল রাহা বলেন, ‘পাঠ্যবইয়ে ভুল কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। সেটা বাক্যগত হোক বা বানানগত। কারণ, একজন শিক্ষার্থী পাঠ্যবইয়ের শব্দ ও বাক্যগঠন সারা জীবন অনুসরণ করে। বারবার এসব ভুল হওয়ার কারণ যারা বানান বা বাক্যগুলো লিখেছেন বা দেখেছেন তারা হয়তো যথাযথভাবে এগুলো দেখছেন না অথবা তাদের অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে।’

কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, ‘এখানে লজ্জার কিছু নেই। বিষয়টা প্র্যাকটিক্যাল হচ্ছে, সেটা লুকিয়ে পড়িয়ে তো লাভ নেই। তাই সরাসরি পড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। যেহেতু কিশোর-কিশোরীদের জানাতে চাই, তাই লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। তবে ভাষাগত বিষয়গুলোতে যদি কোনো আপত্তি উঠে থাকে তা আমরা সংশোধন করব, সেই সুযোগ তো থাকছেই।’

কৈশোরের কথামালা অধ্যায়ে যা আছে
এই অধ্যায়ে কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক পরিবর্তনজনিত নানা বিষয় উঠে এসেছে। ১৬ পৃষ্ঠার এ অধ্যায়জুড়ে মেয়েদের মাসিক বা ঋতস্রাব, কিশোরদের শারীরিক পরিবর্তনের বিষয়ে ‘খোলামেলা’ বাক্য লেখা হয়েছে।

যেমন- ৭৭ পৃষ্ঠায় মেয়েদের মাসিক বিষয়ে বলা হয়েছে, মাসিক বা ঋতুস্র্র্র্র্র্র্রাব মেয়েদের জীবনে স্বাভাবিক একটি বিষয়। প্রতি মাসে জরায়ু থেকে রক্তক্ষরণকে মাসিক বলে। প্রত্যেক মেয়ের বয়ঃসন্ধিকালের একটি সময়ে ঋতুস্রাব শুরু হয়। কার কখন শুরু হবে, সেটি নির্ভর করে তার শারীরিক গঠন, পুষ্টি এবং বংশগতির বৈশিষ্ট্যের উপর। সাধারণত ১০-১৬ বছরের মধ্যেই প্রতিটি মেয়ের মাসিক শুরু হয়ে যায়। যদি কারো স্তনের বিকাশ শুরু হওয়ার তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে মাসিক শুরু না হয় অথবা ১৬ বছর পার হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। ঋতুস্র্র্র্রাবকালীন হালকা ব্যথা হওয়াটা স্বাভাবিক।

এ ছাড়া, শরীরে হরমোনের প্রভাবে মেয়েদের জরায়ুর সংকোচন প্রসারণ হয়ে থাকে। যার ফলে এই ব্যথা হয়ে থাকে। অনেক সময় দেখা যায় এই ব্যথার কারণে কেউ কেউ দিনের স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না। তলপেটে গরম সেঁক দিলে ব্যথার উপশম হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে মাথাব্যথা, ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব বা বমি করা ইত্যাদি লক্ষণও থাকতে পারে।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণীর এক ছাত্রীর মা বলেন, ‘বয়ঃসন্ধিকালে একটি ছেলে বা মেয়ের কী কী পরিবর্তন হয় তা এমনিতেই শিখতে পারে। বয়সের তালে তালে সে শিখে যায়। এ ছাড়া পরিবারও শেখাতে পারে। এটার জন্য বইয়ের একটি অধ্যায়ে মনের মাধুরি মিশিয়ে লিখে শেখাতে হয় না। শারীরিক, দৈহিক ও মানসিক কী পরিবর্তন হবে; সেটা অভিভাবক লক্ষ্য রাখবে। তার মন কখন উতাল-পাতাল হবে সব কি বইয়ে শেখানোর জিনিস? এগুলো জীবন চক্রের মধ্য দিয়ে সে এমনিতেই শিখে যাবে।’

 

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/803382