২ জানুয়ারি ২০২৪, মঙ্গলবার, ১১:৩৬

রাজধানীজুড়ে গ্যাস সংকট

 

দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র আড়াই হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের কাছাকাছি। বিপুল পরিমাণ এ ঘাটতির কারণে শিল্প-কারখানার উৎপাদন ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিকল্প জ্বালানি দিয়ে কারখানা সচল রাখতে গিয়ে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। গতবছর সরকার নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দেওয়ার কথা বলে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছিল। অন্যদিকে উৎপাদন কমে যাওয়ায় শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা সীমিত হওয়ায় তাদের আয়ও কমেছে। একারণে অনেক শিল্পকারখানার মালিকরা ঠিকমতো শ্রমিকদের বেতন দিতে পারছেন না। গ্যাস সংকটের কারণে এখন রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় চুলা জ্বলছে না। একই পরিস্থিতি শিল্পে। গ্যাসের অভাবে স্বাভাবিক সময়ের মতো কারখানা চালানো যাচ্ছে না, কমছে শিল্পের উৎপাদন। পরিবহন খাতও ভুগছে গ্যাস সংকটে। কিন্তু এখন গ্যাস পাচ্ছি না। কারখানার উৎপাদন অনেক কমে গেছে। গ্যাস না পেলেও অনেককে গ্যাসের নিয়মিত বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে এলপিজি সিলিন্ডার কিংবা অন্য উপায়ে রান্নার জন্য বাড়তি ব্যয়ও করতে হচ্ছে। প্রয়োজনীয় চাপে এবং চাহিদামতো গ্যাস না পাওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বছরের অন্যান্য সময় গ্যাসের সংকট বেশি থাকলেও শীতকালে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে ব্যবহার কমে যাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি মেলে। কিন্তু এবার শীতের শুরুতেই ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, নরসিংদী, ময়মনসিংহসহ অন্যান্য এলাকার বিভিন্ন কারখানাতেও ভয়াবহ গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। প্রতিবছর শীতকালে রাজধানীসহ আশপাশের জেলা গুলোতে গ্যাস সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। এ বছরও গ্যাস সংকটের কারণে রাজধানীর কোনো কোনো এলাকায় গ্যাসের চাপ কম, কোথাও সারাদিন চুলা জ্বলে মিটমিট করে, আবার কোথাও জ্বলছেই না চুলা। এতে করে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাসিন্দারা। গ্যাস সরবরাহ কম থাকার কারণে নিয়মিত গ্যাসের চাপ কম থাকছে, মোহাম্মদপুর, কামরাঙ্গীচর, মহাখালী, পল্লবী, কাফরুল, শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১০, রায়েরবাগ, ভূতের গলি, গ্রিনরোড, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান, মগবাজার, বাসাবো, আরামবাগ, লালবাগ, যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা, মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা ও মুগদাসহ উত্তরার বিভিন্ন এলাকায়। এসব এলাকায় গ্যাসের সংকট চলছে প্রতিদিনই। এছাড়া, যেসব এলাকায় গ্যাস রয়েছে, সেখানেও স্বল্প চাপ বিরাজ করছে। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শহরের বাসিন্দারা। এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌ. মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্ ইনকিলাবকে বলেন, গ্যাসের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কিছুটা কম আছে। সাধারণত শীতে গ্যাসের চাহিদা বেশিই থাকে। এলএনজির একটা টার্মিনাল বন্ধ থাকায় সরবরাহ কমে গিয়েছিল। তবে আমরা তা বাড়ানোর চেষ্টায় কাজ করছি। আশা করছি দ্রুতই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

 

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, কোথাও ৬ ঘণ্টা, কোথাও ১২ ঘণ্টা পুরোপুরি বন্ধ থাকছে কারখানা। বাকি সময়েও গ্যাসের চাপ কম থাকছে। এতে উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমে গেছে। কারখানায় গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার অনুরোধ জানিয়ে গত ৫ ডিসেম্বর পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছে নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে ওই চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয়। এ ছাড়া ব্যবসায়ী নেতারা পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের সঙ্গে সরাসরি দেখা করেও তাদের সমস্যার কথা জানিয়েছেন।

তিতাস সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে তিতাস গ্যাসের আবাসিক সংযোগ সংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ ৫৮ হাজার। এছাড়া, বাণিজ্যিক সংযোগ প্রায় ১২ হাজারের মতো। যার মধ্যে প্রায় ১৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। সেখানেও সরবরাহ হচ্ছে, ফলে ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। যে কারণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন গ্যাস সংকট দেখা যাচ্ছে। আপাতত গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর কোনো উপায় তাদের হাতে নেই। আগামী ২০২৬ সাল নাগাদ ৪৬টি কূপ খনন ও সংস্কারের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তাতে সফল হলে ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট নতুন গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা কূপে গ্যাসের সন্ধানও মিলেছে। পাশাপাশি আরও এলএনজি আমদানির জন্য সরকার যে চুক্তি করেছে তাতেও ২০২৬ সালের আগে নতুন গ্যাস আমদানির কোনো সুযোগ নেই। ২০২৬ সালে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবে। তবে আশঙ্কার বয়েছে একাধিক কর্মকর্তা এ তথ্য জানান। তারা বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী কূপ খনন ও সংস্কার করে কাক্সিক্ষত গ্যাস পাওয়া যাবে কি না, সেটা এখনই বলা মুশকিল। তাছাড়া নতুন করে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি করতে যে বিপুল পরিমাণ ডলার দরকার সেটি জোগাড় করা না গেলে আমদানি ব্যাহত হবে। এ সময়ে দেশের পুরনো কূপ থেকে গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি চাহিদাও বেড়ে যেতে পারে। ফলে চলমান সংকট কতটা দূর হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের ৫৬৭টি পোশাক ও ডায়িং কারখানা পৌনে দুই মাস ধরে গ্যাস সংকটে ভুগছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মো. নুরুল আলম ইনকিলাবকে বলেন, কোথায় গ্যাস সংকট?’ শিল্প-কারখানাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে গ্যাস সংকট চলছে। প্রতিকার চেয়ে ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে পেট্রোবাংলাকে সম্প্রতি চিঠিও দিয়েছে এমন উত্তর শুনে জ্বালানি সচিব আপনি সরাসরি দেখা করুন। পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলেন, দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমতে থাকায় এমনিতেই দেশে গ্যাস সংকট। তার ওপর আবার দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য একটি বন্ধ রয়েছে। চলতি সেচ মৌসুমের কথা চিন্তা করে বৃহৎ সার কারখানাগুলোতেও গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। ফলে গ্যাস সংকট বেড়ে গেছে। দেশের অন্যতম রপ্তানি খাত নিট শিল্প ক্রান্তিলগ্ন পার করছে বলে মন্তব্য করে বিকেএমইএ তাদের চিঠিতে উল্লেখ করেছে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এমনিতেই পুরো শিল্প খাতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এর সঙ্গে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং গ্যাসের সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। গ্যাস সংকটের কারণে কারখানা চালু রাখা যাচ্ছে না। একটি মধ্যম মানের কারখানায় প্রতিদিন ৬ থেকে ৮ লাখ টাকার বাড়তি ডিজেল ব্যবহার করতে হচ্ছে। আর প্রথম সারির কারখানায় এর পরিমাণ ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকার মতো। কিন্তু অনেক কারখানার মালিকের বিপুল পরিমাণ এ ডিজেল কেনার সামর্থ্য নেই। নিট শিল্পে প্রায় ১৫ লাখ শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। আর পরোক্ষভাবে কাজ করছেন আরও ৭০ হাজার মানুষ।

বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান,গ্যাস সংকট এখন চরমে। তিতাস বা সরকার কোন বিবেচনায় একটা জোনের টোটাল গ্যাস বন্ধ করে দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র আর সার কারখানায় দিচ্ছে সেটা বোধগম্য নয়। পুরো নারায়ণগঞ্জ জোনে গ্যাস বন্ধ। ২৪ ঘণ্টায় আমরা গ্যাস পাচ্ছি না। গত সপ্তাহে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে চিঠিও দিয়েছি। তিনি আরো বলেন,পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমরা কয়েকজন গিয়ে দেখাও করেছি। কিন্তু কেউ কোনো আশ্বাস দিতে পারেনি। ২০২৬ সালের আগে এ সংকট সমাধানের কোনো উপায় তাদের কাছে নেই। সরকার নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দেওয়ার কথা বলে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছিল। আমরা সেটা মেনে নিয়েছি। কিন্তু এখন গ্যাস পাচ্ছি না। কারখানার উৎপাদন অনেক কমে গেছে। সময়মতো পণ্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না। শিপমেন্ট শিডিউল ফেইল করার কারণে বায়াররা (ক্রেতা) ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে অর্ডার ক্যানসেল করে দেওয়ার কথা বলেছে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক হোসেন মেহমুদ বলেন,যেদিন ২২ ঘণ্টা পর্যন্ত গ্যাস পাওয়া যায় না। গ্যাস থাকলেও এর চাপ এতই কম থাকে, যা দিয়ে উৎপাদন করা যায় না। এতে পণ্যের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে। অপচয় পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। গ্যাস সংকটের কারণে ৪০ শতাংশ উৎপাদন কমে গেছে। বিএসআরএমের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেন গুপ্ত বলেন, চাহিদার তুলনায় আমরা ৬০ শতাংশের মতো গ্যাস পাচ্ছি। বাকি চাহিদা মেটাতে ফার্নেস অয়েল এবং ডিজেল মিশ্রণ করে উৎপাদন ঠিক রাখতে হচ্ছে। গ্যাসের দাম ৩০ টাকা, সেখানে তেলের দাম ১০৫ টাকা। এ কারণে অনেক ব্যয় বেড়ে গেছে।

সিএনজি স্টেশনগুলোতেও গ্যাসের টান পড়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে স্টেশনগুলোতে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু বর্তমানে সংকটের কারণে অন্য সময়েও ঠিকমতো গ্যাস পাওয়া যায় না। আবার গভীর রাতে যখন গ্যাস থাকে তখন পরিবহনে গ্যাস নেওয়ার ক্রেতার সংখ্যা একেবারেই কমে যায় বলে জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।

এ বিষয়ে সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভারশন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর বলেন, সরকার ঘোষিত বন্ধের সময়ের বাইরেও গ্যাসের অভাবে সকাল ৭টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত বেশিরভাগ স্টেশন বন্ধ থাকে। প্রায় দুপুরের দিকে আর মাঝরাতে কিছুটা গ্যাস পাওয়া গেলেও কাক্সিক্ষত চাপ থাকে না। লোকসান দিতে দিতে অধিকাংশ স্টেশন বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

রাজধানীর বাসাবো এলাকার রফিমোহাম্মদ বলেন, শীত আসার পর থেকে ঠিকমতো দিনের বেলায় রান্না হয় না, যা রান্না করার রান্না করতে হয় রাতে, সেগুলোই আমরা সারাদিনে খাই। ভাত-তরকারি গরম করার গ্যাসও থাকে না বলতে গেলে। যে কারণে গরম করার কাজ আমরা এখন ওভেনে করছি।তাতে বিদ্যুৎ বিলও আসছে অনেক। প্রতিদিন ভোরের দিকে গ্যাস চলে যায়, আর ফিরে আসে বিকেল ৩টার পর।

https://dailyinqilab.com/national/article/628336