২ জানুয়ারি ২০২৪, মঙ্গলবার, ১১:৩০

বছরের প্রথম দিনেই দূষিত শহরের তালিকার শীর্ষে ঢাকা

ঢাকার বায়ুমানে তেমন উন্নতি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষ দশে থাকা ঢাকার বাতাসের মান আজও খুবই অস্বাস্থ্যকর। ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম দিন বায়ুদূষণের শীর্ষে নাম এসেছে বাংলাদেশের রাজধানীর।  ভৌগোলিক কারণে প্রতিবছর শীতের সময় ঢাকার বায়ুদূষণ বাড়লেও এবার শীত শুরুর বেশ আগে থেকেই রাজধানীর বাতাসে দূষণের পরিমাণ বেড়ে গেছে এবং দূষণের দিক থেকে প্রায়ই প্রথম হচ্ছে। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারের সূচকে গত দুই মাসে ঢাকা একাধিকবার ৩০০’র বেশি একিউআই স্কোর নিয়ে সর্বোচ্চ দূষিতের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ৫ কারণে বায়ু দূষণে শীর্ষেই থাকছে ঢাকা: নির্মাণকাজ, ইটভাটা ও শিল্প কারখানা, যানবাহন, বর্জ্য পোড়ানো, ট্রান্স-বাউন্ডারি এয়ার পলিউশন ইত্যাদি। রাজধানী ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে বায়ুদূষণের কবলে। এখানকার বাতাসের গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায় এবং বর্ষাকালে কিছুটা ভালো থাকে। ২০১৯ সালের মার্চে পরিবেশ অধিদফতর ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঢাকার বায়ু দূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণাধীন ধুলো। এ অবস্থায় শিশু, প্রবীণ ও অসুস্থ রোগীদের বাড়ির ভেতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। এ পরিমাণে বায়ুদূষণ গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।

বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) সূচক অনুযায়ী, গতকাল সোমবার সকাল নয়টায় ২৪৪ স্কোর নিয়ে দূষিত শহরের শীর্ষে অবস্থান করছে ঢাকা। অর্থাৎ এখানকার বায়ু ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ পর্যায়ে রয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারতের কলকাতা। শহরটির স্কোর ২৩২। অর্থাৎ সেখানকার বায়ুর মানও খুবই অস্বাস্থ্যকর। সূচকে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে চীনের চেংদু। শহরটির স্কোর হচ্ছে ২১৬। মানে সেখানকার বায়ুর মানও খুবই অস্বাস্থ্যকর। এছাড়া ২১৪ স্কোর নিয়ে ভারতের দিল্লি চতুর্থ এবং ঘানার আক্রা ২০৯ স্কোর নিয়ে পঞ্চম স্থানে আছে। প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটুকু নির্মল বা দূষিত সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয়। সেই সঙ্গে তাদের জন্য কোন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে তা জানায়। বাংলাদেশে একিউআই নির্ধারণ করা হয় দূষণের পাঁচটি ধরনকে ভিত্তি করে-বস্তুকণা (পিএম১০ ও পিএম২.৫), এনও২, সিও, এসও২ এবং ওজোন (ও৩)। স্কোর শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকলে বায়ুর মান ভালো বলে বিবেচিত হয়। ৫১ থেকে ১০০ হলে মাঝারি বা সহনীয় ধরা হয় বায়ুর মান। সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয় ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর। ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়। স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া ৩০১-এর বেশি হলে তা দুর্যোগপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। 

পরিবেশকর্মী আলমগীর কবির দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, রাস্তা ও ভবন নির্মাণ বা মেরামতের সময় ধুলাবালি যেন বাতাসের সঙ্গে যেন মিশে না যায়, সেজন্য নির্মাণ স্থানে যথাযথ অস্থায়ী ছাউনি বা বেষ্টনী দেয়ার নিয়ম রয়েছে। সেইসাথে, বেষ্টনীর ভেতর ও বাইরে নির্মাণ সামগ্রী (মাটি, বালি, রড, সিমেন্ট ইত্যাদি) যথাযথভাবে ঢেকে রাখা এবং দিনে কমপক্ষে দুইবার স্প্রে করে পানি ছিটানোর কথা বলা আছে এতে। এছাড়া, নির্মাণাধীন রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখে বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা করা, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামত করা এবং নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে পরিবহন করার কথাও বলে অধিদপ্তর।

তিনি বলেন, ভবন ও রাস্তাঘাট নির্মাণের ক্ষেত্রে যদি কেউ এইসব নিয়ম পালন না করে, সেক্ষেত্রে ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করার পাশাপাশি জরিমানা আরোপ করতে পারবে সিটি করপোরেশন বা ভ্রাম্যমান আদালত। 

দূষণবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ক্যাপস-এর ‘দেশব্যাপী (৬৪ জেলার) বায়ু দূষণ সমীক্ষা ২০২১’ অনুযায়ী, ঢাকার আশেপাশের প্রায় ১২০০ টি ইটভাটা, ছোট-বড় কয়েক হাজার শিল্প কারখানা আছে, যেগুলো দূষণের অন্যতম কারণ। শহরের যে কোনো রাস্তায় কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই দেখা যাবে, চারপাশকে কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে বিকট শব্দে ছুটে চলছে বিভিন্ন ফিটনেসবিহীন যানবাহন, বিশেষ করে বাস ও ট্রাক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে এখনো অবলীলায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি ঘুরে বেড়াতে পারছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং ট্র্যাফিক পুলিশদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে।

বুয়েটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, ঢাকা শহরে যে পরিমাণ বাস চলে, তার সত্তর শতাংশেরই আয়ুষ্কাল শেষ। লক্কড়-ঝক্কড় বাসগুলো চলছে, এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো মনযোগ নাই। ঢাকায় এখন কমপক্ষে সাড়ে চার হাজার বাস চলছে কিন্তু সেসবের সত্তর শতাংশেরই কোনো ‘ইকোনমিক লাইফ’ অর্থাৎ ‘অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল’ নেই।

ময়লার স্তূপ যেখানে থাকে, সেখানে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। অনেকসময় এই মিথেন গ্যাসের দুর্গন্ধ থেকে বাঁচার জন্য পরিচ্ছন্ন কর্মীরা আগুন জ্বালায়। আবার, অনেক বাসাবাড়িতে বা মহল্লায় বর্জ্য পোড়ানোকে সেরা সমাধান হিসেবে ভাবা হয়। এই বিষয়ে অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা শহরের অন্তত ৫০ টি স্থানে বর্জ্য পোড়ানো হয়। এই বর্জ্য পোড়ানো একটি ভুল ধারণা।

এটির কারণে যে বায়ু দূষণ হয়, এটি মানুষের মাথায় থাকে না। বাংলাদেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুরবস্থার কথা তুলে ধরে বেলার মিজ হাসান বলেন, আমার মনে হয়, আমাদের ৫২ বছরে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত হচ্ছে ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট খাত।

বর্ষাকালে বাংলাদেশের বায়ু ভালো থাকলেও জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারির দিকে দিল্লি, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশসহ ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে ‘ট্রান্স-বাউন্ডারি ইফেক্ট’ হিসেবে বাংলাদেশে দূষিত বায়ু প্রবেশ করে। এটিকে বলে ট্রান্স-বাউন্ডারি এয়ার পলিউশন বা আন্তঃমহাদেশীয় বায়ু দূষণ। আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক বলেন, দিল্লি খুব দূষিত প্রদেশ। শীতকালে বাতাস দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ হয়ে উচ্চচাপ বলয় থেকে ঐ বাতাস বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

https://www.dailysangram.info/post/544926