২ জানুয়ারি ২০২৪, মঙ্গলবার, ১১:২৭

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ‘অনৈতিক’ কর্মকাণ্ডের পাহাড় ॥ উপেক্ষার নীতি সংশ্লিষ্টদের!

 

* নির্বাচনী হলফনামায় তথ্য গোপনের বিষয় উপেক্ষা

* প্রার্থীর সম্পদের পাহাড় জমলেও জবাবদিহিতামুক্ত

* দলের পদাধিকারী বিদ্রোহী প্রার্থী হলেও তা উপেক্ষা

* ধরেবেঁধে এনে হলেও ভোটার উপস্থিতি দেখানো

* বিভিন্ন নাগরিক সুবিধাকে চাপ হিসেবে কাজে লাগনো

* তৃণমূলে পরস্পরকে হুমকি-ধমকি

সরদার আবদুর রহমান: আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিচিত্র রকমের পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক নানান ‘অনৈতিক’ কর্মকা-ের বিষয়ে অভিযোগের পাহাড়ও জমে উঠেছে। তবে এসব বিষয়কে উপেক্ষা করে সরকার ও নির্বাচন কমিশন (ইসি) যেকোনো প্রকারে নির্বাচনের দিনটি অতিক্রম করার কৌশল নিয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের অভিমত।

নির্বাচনে প্রার্থীতা চূড়ান্ত হওয়ার পর এযাবৎ মোটাদাগে বেশকিছু ‘দৃশ্য’ প্রকাশিত হতে দেখা যায়। বিএনপি ত্যাগ করলেই জামিনে মুক্তি ও নৌকার মনোনয়ন লাভ এবং হলফনামায় তথ্য এড়িয়ে যাওয়া, বিদেশে অবস্থিত সম্পদের তথ্য গোপন করা, একেকজন প্রার্থীর সম্পদের পাহাড় জমলেও জবাবদিহি থেকে বেঁচে যাওয়া, দলের পদাধিকারী বিদ্রোহী প্রার্থী হলেও তা উপেক্ষা করা, ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাস-সংঘাতকে নির্বাচনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রমাণ হিসেবে মনে করা, ধরেবেঁধে এনে হলেও ভোটার উপস্থিতি দেখানো, বিভিন্ন নাগরিক সুবিধাকে চাপ হিসেবে কাজে লাগানো, তৃণমূলে পরস্পরকে হুমকি-ধমকি প্রভৃতি বিষয় ‘অনৈতিক’ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

দলবদলের পুরস্কার : বিশ্লেষকরা উল্লেখ করেন, গণতন্ত্রের কথিত নতুন ধারায় দলবদলে রাজি হলেই, অর্থাৎ বিএনপির সঙ্গ ছাড়লেই জামিনে মুক্তি ও নৌকার মনোনয়নÑদুটোই যে মেলে, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর তার প্রমাণ। বিএনপিতে থাকাকালে তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাকে জেলে ঢোকানো হলো। আবার রাতারাতি মুক্তি দিয়ে নৌকার মনোনয়ন পর্যন্ত দেয়া হলো। তার নির্বাচনী হলফনামায় সেই মামলার উল্লেখ পর্যন্ত থাকলো না। দলবদল করে এই পুরস্কার এবং বিশাল ছাড় প্রদান রাজনৈতিক মহলে বিপুল ও বিরূপ আলোচনার জন্ম দিলেও সেনিয়ে সংশ্লিষ্টদের কোনো হেলদোল নেই।

বিদেশে মন্ত্রীর সম্পদ! : এই নির্বাচনের প্রার্থী একজন মন্ত্রীর বিদেশে হাজার আড়াই কোটি টাকার সম্পদ থাকার অভিযোগ প্রকাশিত হওয়ার পর এনিয়ে তোলপাড় চলছে। তবে সেটিও এযাবৎ এড়িয়ে যাওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। এসব সম্পদের কোনো তথ্য নির্বাচনী হলফনামায় উল্লেখ না করায় তার প্রার্থীতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এর ফলে আরো কোনো কোনো প্রার্থীর ক্ষেত্রে এমন যে ঘটেনি তাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। 

প্রার্থীদের সম্পদের পাহাড়! : সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রার্থীদের দেয়া হিসাব বিশ্লেষণ করে কোটিপতি ও শত কোটিপতিদের একটা তালিকা করে। এতে দেখা যায়,  আওয়ামী লীগের ৮৭ শতাংশ প্রার্থী কোটিপতি। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রায় ৪৭ শতাংশ কোটিপতি। এবারের নির্বাচনে প্রতাপশালী ও সম্পদশালী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের। জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের প্রায় ২২ শতাংশ কোটিপতি। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগানধারী জাসদের ১০ শতাংশ প্রার্থী কোটিপতি। শ্রমিকশ্রেণির রাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করা ওয়ার্কার্স পার্টির কোটিপতি প্রার্থীর হার ১৭ শতাংশ। টিআইবি কোটিপতির হিসাব করেছে নগদ ও ব্যাংকে জমা টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ, সোনাসহ বিভিন্ন অস্থাবর সম্পদের ভিত্তিতে। জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মতো স্থাবর সম্পদ এই হিসাবে আসেনি।

‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী বলে কিছু নেই! : দলের গঠনতন্ত্র মোতাবেক কোনো ব্যক্তি দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে পৃথক কোনো অবস্থান নিলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ স্বাভাবিক রীতি। পূর্ববর্তী জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনসমূহে এজন্য অসংখ্য দলীয় নেতা-কর্মীকে ‘বিদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে দল থেকে হয় বহিষ্কার অথবা কোনো না কোনো মাত্রার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে। বিশেষত বর্তমান সরকারি দলের এই অবস্থান কিছুদিন আগেও দেখা যায়। কিন্তু এবার ব্যতিক্রমীভাবে দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ভোট করাকে জায়েজ করা হয়েছে। এতে গঠনতন্ত্রের লংঘনকে উপেক্ষা করা হয়েছে। যে কারণে দলীয় টিকিটে ২৬৩ জনকে মনোনয়ন দিলেও দলের ২৬৯ জনকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। দলের গঠনতন্ত্রে দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়া সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়ার কথা থাকলেও এবং অতীতে এ অপরাধে শত শত দলীয় নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হলেও এসব প্রার্থীর অনেকেই দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি অব্যাহত রেখেছেন। ফলে এই নির্বাচনে ‘বিদ্রোহী’ বলে আর কিছু থাকছে না। গণতন্ত্রকে নতুন রূপ দেয়ার এটি একটি তরিকা কি-না সে প্রশ্ন বিশ্লেষকদের। 

সহিংসতা তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রমাণ! : বিরোধী দল নির্বাচনে না থাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা জমছিল না। এটি তীব্র করতেই ঘরের লড়াইকে মাঠে গড়ানো হয়েছে বলে ভাষ্যকাররা ‘সন্দেহ’ করছেন। এরই মধ্যে কয়েকজনের প্রাণহানি, সংঘর্ষ ও অসংখ্য আহত হওয়া, প্রচারকেন্দ্র পোড়ানো ও ভাঙচুর প্রভৃতির তালিকা দীর্ঘ হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনকে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনের মানসিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

ধরেবেঁধে ভোটার উপস্থিতি বৃদ্ধি! : নির্বাচনে দলের অংশগ্রহণ প্রতিনিধিত্বমূলক না হলে বা প্রশ্নবিদ্ধ হলে ধরেবেঁধে এনে হলেও ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে বলে পর্যবেক্ষকরা অভিমত প্রকাশ করেন। এ ক্ষেত্রে বৈধ, অবৈধ বা নীতিনৈতিকতার কোনো বালাই নেই। রাষ্ট্রের হাতে যতো রকম হাতিয়ার আছে, তার সবই প্রয়োগ করার চিন্তাভাবনা চলছে বলে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। প্রান্তিক ও বিপন্ন মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতা বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়ে হলেও ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে হাজির করার নতুন নজির তৈরি করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের কেউ কেউ হুমকি দিয়েছেন, ভোটকেন্দ্রে যারা যাবেন না, তারা তাদের কোনো সেবা পাবেন না। যেমন, ভোট দিতে কেন্দ্রে না এলে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন ভাতাভোগীদের কার্ড বাতিলের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মাগুরার শালিখা উপজেলার একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আ’লীগের সভাপতি। গত ২৩ ডিসেম্বর শালিখা উপজেলার আ’লীগের প্রার্থীর এক নির্বাচনী সভায় তিনি এ হুঁশিয়ারি দেন। তাঁর বক্তব্যের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে বলতে শোনা যায়, “যারা নির্বাচনের দিন ৭ তারিখে ভোটকেন্দ্রে আসবেন, তাঁদের আমরা চেনবো। প্রত্যেকের নামের পাশে টিক (চিহ্ন) দেয়া থাকবে। ওই টিকের খাতা সন্ধ্যার সময় আমি আমার কাছে নিয়ে নেবো। আটটা সেন্টারের (কেন্দ্রের) প্রতিটির ভোটার লিস্ট (তালিকা) আমার কাছে জমা হয়ে যাবে রাতের বেলায়। পরের দিন আমরা যাচাই-বাছাই করবো যে কোন বন্ধু আপনারা ভোট দিতে আসেন নাই। তাদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না।” ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, কৃষকের মাঝে সার এবং বীজ বিতরণ করি। আপনারা টিসিবির মাল পাচ্ছেন না? টিসিবির মাল নেন, এই জামাত হোক, বিএনপি হোক আর যেই হোক, প্রত্যেক বন্ধুকে সেন্টারে আসতি হবে। আর যদি না আসে, টিসিবির মালও পাবে না। একচুলও কোনো সুযোগ-সুবিধা পাবে না। সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত (হবে)।”

তৃণমূলে হুমকি-ধমকি : ভোটকেন্দ্রে কারা আসবে আর কারা আসবে না তাও নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে তৃণমূলে এবিষয়ে নানাপ্রকার হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্নস্থানে। গণমাধ্যমে এসম্পর্কিত রিপোর্ট প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হচ্ছে। এবিষয়ে নামকাওয়াস্তে কিছু ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়। তবে আইনগত ব্যবস্থার কথা প্রকাশ পায়নি। একটি নমুনা: গত ২৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার মুড়াপাড়া ইউনিয়নে “নৌকায় ভোট না দিলে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস বন্ধ করে দেয়া হবে”- একজন ছাত্রলীগ নেতার এমন হুমকিমূলক একটি বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট না দিলে ভোটারদের বাড়ির পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বন্ধের এই হুমকি দেন ঐ নেতা। আ’লীগের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী উঠান বৈঠকে এই কথা বলেন তিনি। পনের সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে নেতাকে বলতে শোনা যায়, “নৌকা মার্কায় আপনাদের ভোট দিতে হবে। এটা আপনারা মনে রাইখেন। নয়তো আপনাদের এই যে পানি আছে, বিদ্যুৎ আছে, গ্যাস আছে, এগুলো কিন্তু কিছু থাকবো না। এগুলা কিচ্ছু থাকবো না, ঠিক আছে? আপনারা একটা জিনিস মনে রাখবেন। নৌকায় ভোট না দিলে খবর আছে।”

বিরোধীদের পা ভেঙে দেয়ার হুমকি : যারা নৌকা প্রতীকের বিরোধিতা করছেন, ৭ জানুয়ারির পর নৌকার আশপাশে দেখলে তাদের পা ভেঙে দেয়ার হুমকি দেন আ’লীগের এক নেতা। গত ২৫ ডিসেম্বর পঞ্চগড় সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের কাজীরহাট বাজারে আ’লীগ মনোনীত প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যালয় উদ্বোধনের সময় তিনি একথা বলেন। ইতোমধ্যে এই বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। 

অন্য মার্কার লোক এলাকায় ঢুকতে না পারে : লালমনিরহাট-১ আসনের নৌকার সমর্থক একজন ইউপি চেয়ারম্যান ‘অন্য প্রার্থীর সমর্থকদের এলাকায় ঢুকতে না দেয়া’র হুমকি দেন। তার এমন বক্তব্যের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থীর মিছিলে হামলা ও তাঁর দুটি নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুরের অভিযোগ করা হয়। গত ২৬ ডিসেম্বর দোয়ানী উচ্চবিদ্যালয় মাঠে আ’লীগের নির্বাচনী জনসভায় তিনি বলেন, “আমি গড্ডিমারীর মানুষকে আজ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় পাহারা বসাতে অনুরোধ করছি। নৌকা ছাড়া অন্য কোনো মার্কার লোক যেন এ এলাকায় ঢুকতে না পারে।”

https://www.dailysangram.info/post/544946