১ জানুয়ারি ২০২৪, সোমবার, ৫:৩০

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একদলীয় ও একপাক্ষিক

 

* মাসে ৯২ মামলায় ১৫১২ বিরোধী নেতাকর্মীর সাজা

* ২০২৩ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৭৩ নারী, হত্যার শিকার ৩৩

* নির্যাতনে মৃত্যু ২৯২ ১৪২ আত্মহত্যা করে

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে একদলীয় এবং একপাক্ষিক বলে অভিহিত করে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারপারসন আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেছেন, নির্বাচনে একটা দলের নির্বাচন হচ্ছে। আওয়ামী লীগের জোটে যারা আছে তারাই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এছাড়াও আসক জানায়, চলতি (২০২৩) বছর সারাদেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫৭৩ জন। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৩ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৫ জন।

গতকাল রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে আসক আয়েজিত ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২৩: আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক সাংবাদিক সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারপারসন আইনজীবী জেড আই খান পান্না, আসকের সিনিয়র সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির, সমন্বয়ক তামান্না হক রীতি।

সাংবাদিক সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে ২০২৩ সালের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবেদন তুলে ধরেন আসক নির্বাহী পরিচালক ফারুক ফয়সাল। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগৃহীত তথ্যে তৈরি প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, নি¤œ আদালত সাজা দেয়ার ঘটনা লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। ঢাকায় গত ৫ মাসে ৯২ মামলার সাজা হয়েছে অন্তত ১ হাজার ৫১২ জন সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর।

এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে জেড আই খান বলেন, নির্বাচনের পর সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এটা আমি আশা করি। রাজনৈতিক নেতারা মুক্তি পাবেন। অন্যথায় রাজনৈতিক ও মানবিক অধিকার লঙ্ঘিত হবে। এটা অত্যন্ত লজ্জাজনক যে আমরা ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। বিভিন্ন সময় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘন ও স্বাধীন মত দমনে নিবর্তনমূলক আইনে সমালোচনা করে তিনি আরও বলেন, মত প্রকাশে স্বাধীনতা রোধ করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সরকারের সমালোচনা করা যাবে না এটা মোটেও ঠিক না।

লিখিত বক্তব্যে ফারুখ ফয়সাল বলেন, চলতি বছর ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১২৯ জন। এরমধ্যে ধর্ষণের চেষ্টার পর হত্যা করা হয় তিনজনকে, ধর্ষণের চেষ্টার কারণে আত্মহত্যা করেন ৩ জন। নির্যাতন, উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন হয়রানি: আসকের তথ্যমতে, চলতি বছর যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ১৪২ জন নারী। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ১২২ জন পুরুষ। এছাড়া উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন নারী। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ ও উত্ত্যক্তকরণের প্রতিবাদ করতে গিয়ে খুন হয়েছেন ৪ জন নারী ও ৪ জন পুরুষ।

পারিবারিক নির্যাতন ও যৌতুক: আসকের তথ্য অনুসারে, চলতি বছর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫০৭ জন নারী। এর মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন ২৯২ জন ও আত্মহত্যা করেছেন ১৪২ জন। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৪২ জন নারী।  এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৬৪ জন এবং আত্মহত্যা করেন ৬ জন নারী।

গৃহকর্মী নির্যাতন ও এসিড নিক্ষেপ: আসকের তথ্য অনুসারে, চলতি বছর ৩২ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মারা যায় ৬ জন ও রহস্যজনক মৃত্যু হয় একজনের। অন্যদিকে এসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ১০ জন নারী।

শিশু অধিকার: চলতি বছর শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পরে হত্যা, ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে নিহত হয় কমপক্ষে ৪৮৪ জন শিশু। এছাড়া বিভিন্নভাবে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় কমপক্ষে ১০১২ জন শিশু। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩১৪ জন শিশু, ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ১১৭ জন শিশু এবং বলৎকারের শিকার হয়েছে ৭৫ জন ছেলে শিশু।

স্বাস্থ্য অধিকার: চলতি বছর ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। চলতি বছর ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৬৯৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। যেখানে গত ২৩ বছরে ডেঙ্গুতে দেশে মারা গেছেন ৮৬৮ জন।

আসকের ১৫ সুপারিশ: দেশের মানবাধিকার রক্ষায় ১৫ দফা সুপারিশ জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সুপারিশের মধ্যে রয়েছেÑ

১. রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা যে কোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যেমন- বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-, গুমের অভিযোগ, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এখতিয়ার বহির্ভূত আচরণ ইত্যাদির অভিযোগ উঠলে তা দ্রুততার সাথে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে হবে এবং সম্পৃক্তদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শাস্তি প্রদান করতে হবে।

২. এ পর্যন্ত সংঘটিত সকল বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের অভিযোগ তদন্তে নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। ৩. দেশের যে কোন নাগরিককে আটক বা গ্রেফতারের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সম্পূর্ণভাবে মেনে চলতে হবে এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

৪. মিথ্যা মামলা বা গায়েবি মামলা সংক্রান্ত যে অভিযোগসমূহ উঠেছে সেগুলো আমলে নিয়ে অভিযোগের যথাযথ নিষ্পত্তি নিশ্চিত করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ৫. নাগরিকের সমবেত হওয়ার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের অধিকার যথাযথভাবে চর্চা করার পরিবেশ তৈরি এবং জনদুর্ভোগ এড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি ভিন্নমত প্রকাশকারীদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ কিংবা কোনো ধরনের ভীতি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকতে হবে। ৬. আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পেশাদারীত্বের আওতায় রেখে তাদের কর্ম-পরিধি নিশ্চিত করতে হবে।

৭. নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করতে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক আইনগুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে। পাশাপাশি অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌন হয়রানি রোধে কার্যকর ব্যবস্থ্যা গড়ে তোলার জন্য তদন্ত সাপেক্ষে আইন অনুযায়ী দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

৮. ধর্মীয় উত্তেজনা তৈরি করে কোনো সহিংসতার ঘটনা না ঘটে তার জন্য পর্যাপ্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ধরনের কর্মকা-ের সাথে জড়িতদের সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিজ বিশ্বাস ও রীতি চর্চার অধিকার এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ৯. মানবাধিকারকর্মী ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ দ্রুততার সাথে সংশোধন করতে হবে। কমিশনের প্রধান ও সদস্যদের নিয়োগের জন্য একটি উন্মুক্ত ও অংগ্রহণমূলক পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। ১০. পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি সমতলের আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার এবং সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রার  সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

১১. কাক্সিক্ষত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানবাধিকার সুনিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ১২. দেশে সুস্থ রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করার মাধ্যমে নাগরিকদের অধিকার ভোগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ১৩. সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের কর্মস্থলে পরিবারসহ বাধ্যতামূলক অবস্থানের জন্য পূর্বের ন্যায় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ১৪. অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা ও সহযোগিতায় বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে জরুরি হেল্পলাইন নম্বর চালুসহ অন্যান্য কল্যাণমূলক ব্যবস্থা বিস্তৃত করতে হবে। ১৫. রাজনৈতিক দলগুলো যেন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তিতে এবং সমঝোতার মাধ্যমে সকল সমস্যা সমাধান করে, সে ব্যাপারে সকল পক্ষকে দায়িত্বশীল হতে হবে।

https://www.dailysangram.info/post/544836