৩১ ডিসেম্বর ২০২৩, রবিবার, ১:৫৬

বছরজুড়ে ১৪ ভাইরাসে নাস্তানাবুদ মানুষ

 

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলায় ১৪ রোগের ২৬টি প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এর মধ্যে সর্বোচ্চ প্রাদুর্ভাব ছিল নিপাহ ভাইরাসের। ১২ মাসে সাত জেলায় আটবার এ ভাইরাসের বিস্তার মিলেছে। 

২০২১ সালে চার রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল ১১ বার। ওই বছর সবচেয়ে বেশি প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়ার। এ হিসাবে দুই বছরের ব্যবধানে দেশে বিভিন্ন রোগের সংখ্যার দিক থেকে প্রাদুর্ভাব বেড়েছে সাড়ে ৩ গুণ। মূলত মৌসুমি রোগ বা ভাইরাসের হঠাৎ বৃদ্ধিকে প্রাদুর্ভাব (আউটব্রেক) বলা হয়। 

২০২৩ সালে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যু বছরজুড়ে থাকায় এ ভাইরাসকে প্রাদুর্ভাবের মধ্যে গণনা করা হয়নি। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ রোগকে মহামারি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। 

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) রোগের প্রাদুর্ভাব-সংক্রান্ত বার্ষিক রিপোর্টে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটি দেশের প্রতিটি প্রাদুর্ভাবের তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে। পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) কাছে জমা দেয়। আন্তর্জাতিক সংস্থা দুটি রোগের প্রাদুর্ভাব পর্যালোচনা করে নানা সুপারিশ করে থাকে। তাদের দেওয়া সুপারিশের ভিত্তিতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে বাংলাদেশ।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের মতো বাংলাদেশও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া বেড়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবন, জীবিকা ও স্বাস্থ্যের ওপর। কয়েক বছর ধরে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। তবে করোনা মহামারির মধ্যে মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, বাইরের খোলা খাবার না খাওয়া, হাত ধোয়ার অভ্যাস বেড়ে যাওয়ায় রোগের প্রাদুর্ভাব কম ছিল। করোনা নিয়ন্ত্রণে আসার পর মানুষ আগের অবস্থানে ফিরেছে। ফলে আবার রোগের প্রাবল্য বাড়ছে। 

আইইডিসিআরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিদায়ী  বছরে সবচেয়ে বেশি প্রাদুর্ভাব ছিল নিপাহ ভাইরাসের। গত এক বছরে সাত জেলায় আটবার এ রোগের বিস্তৃতি দেখা দিয়েছে। এই রোগে আক্রান্তের ৭১ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রাদুর্ভাব ছিল ডায়রিয়ার। এ বছর পাঁচবার এ রোগের দাপট দেখা যায়। প্রায় তিন  লাখ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত এবং শতাধিকের বেশি মৃত্যু হয়। 
এ ছাড়া আরও ছিল তড়কা (অ্যানথ্রাক্স), করোনাভাইরাস, টাইফয়েড জ্বর, চিকেন পক্স, মেনিনজাইটিস, চোখের ভাইরাস, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডিপথেরিয়া, নবজাতক শিশুদের শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতা, প্যানডেমিক ইনফ্লুয়েঞ্জা, জলাতঙ্ক, লেপ্টোস্পাইরোসিস ও ইবোলা।

২০২১ সালে ডায়রিয়া, করোনা, খাদ্যে বিষক্রিয়া ও মস্তিষ্কের প্রদাহ বেশি দেখা যায়। ২০২২ সালে ১২টি রোগের ২৪ বার প্রাদুর্ভাব ঘটে। শুধু দেশেই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বজুড়ে নানা রোগের আকস্মিক বিস্তার ঘটেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, পুষ্টিহীনতাসহ তাপমাত্রাজনিত শারীরিক জটিলতায় ২০৩০ সালের পর থেকে বিশ্বে প্রতিবছর ২ লাখ ৫০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

ডব্লিউএইচওর তথ্য অনুসারে, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া বাড়ায় মানুষের স্বাস্থ্যে নানাভাবে প্রভাব পড়ছে। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ভাইরাসজনিত জ্বর জিকাসহ মশাবাহিত বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস নতুন করে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়াচ্ছে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা ও ভারী বৃষ্টি মশার প্রজনন বাড়ানোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। 

ডব্লিউএইচওর তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালে বিশ্বে শনাক্ত হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল ৫ লাখ। এই সংখ্যা ২০১৯ সালে এসে দাঁড়ায় ৫০ লাখে। বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এ বছর রেকর্ড গড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন অকল্পনীয় প্রভাব ফেলেছে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবেও। ২০২২ সালে আগের বছরের চেয়ে ৫০ লাখ বেশি ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত বছর বন্যার পর পাকিস্তানে ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা ৪০০ গুণ বেড়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ঘুমিয়ে যাওয়া জীবাণুকে জাগিয়ে দিচ্ছে, এক ঋতুর রোগ অন্য ঋতুতে নিয়ে যাচ্ছে বা ঋতুর সীমা অতিক্রম করে সারা বছরই রোগ থাকছে। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া, জিকা, নিপাহ ভাইরাস, পুষ্টিহীনতা বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এ ছাড়া মানুষের জীবনধারার পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, খাদ্য ও অন্যান্য সম্পদের অপচয়, কীটপতঙ্গবাহিত রোগ ও প্রতিরোধযোগ্য অসংক্রামক ব্যাধির (ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসরোগ ইত্যাদি) বিস্তার ঘটাচ্ছে। মানুষ-প্রাণীর ক্রমবর্ধমান ঘনত্ব ও ঘনিষ্ঠতা, পরিবেশের প্রতিরক্ষাসক্ষমতা ক্রমবর্ধমান হারে ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া প্রভৃতি কারণে প্রাণী ও প্রকৃতি থেকে নতুন নতুন রোগজীবাণু বা ভাইরাস মানবদেহে ঢুকছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড হেলথ প্রমোশন ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. ইকবাল কবীর বলেন, ডেঙ্গু মৌসুমি রোগ ছিল। এখন বছরজুড়ে দেখা যাচ্ছে। এই ভাইরাসের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে। এর প্রধান কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। দেশে ০.১ ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়লে এডিস মশার প্রজননক্ষমতা শতগুণ বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এই পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে অচিরেই দেশে জিকা, ইয়েলা ফিভারের মতো জটিল মশাবাহিত রোগ জায়গা করে নেবে। এ জন্য আমরা দেশের জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব রাখার ব্যবস্থা করছি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার কাজ করছে।

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, রোগের প্রাদুর্ভাব ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে করোনা মহামারির মতো কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ ব্যবস্থাপনায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করা জরুরি। সমস্যাগুলোকে জরুরি বিষয় হিসেবে না দেখলে আগামীতে অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে।

 

https://samakal.com/bangladesh/article/215757