৩১ ডিসেম্বর ২০২৩, রবিবার, ১:৫৩

বছরের আলোচিত ‘চরিত্র’ ডলার

 

২০২৩ সালের শুরু থেকেই দেশে ডলারের সংকট ছিল তীব্র। আর বছর শেষ হচ্ছে ডলার সংকট নিয়েই। এ অবস্থায় বছরের অন্যতম আলোচিত চরিত্র হয়ে উঠে ডলার। ব্যবসায়ী, বিদেশে উচ্চ শিক্ষা ও চিকিৎসাপ্রার্থী অনেককেই ডলারের জন্য হাহাকার করতে দেখা গেছে। বছর জুড়ে খোলা বাজারেও ছিল ডলার সংকট। কোথাও ডলার পাওয়া গেলেও নগদে তা কিনতে গ্রাহকদের গুনতে হয়েছে বাড়তি দাম। খোলাবাজারে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে ডলারের দর ওঠে ১২৮ টাকায়। ডলার সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে আমদানি। যার প্রভাব পড়েছে সবকিছুর ওপর। সমস্যা সমাধানে একাধিক পদেক্ষপ নেয়া হলেও তা খুব বেশি কাজে আসেনি।

তবে বছরের শেষ সময়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে ডলারে।

গত আগস্ট মাসে হঠাৎ বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় নগদ ডলার। চাহিদা আর জোগানের সংকটে প্রতি ডলারের জন্য গুণতে হয় ১২৫ টাকা পর্যন্ত। বাতিল করা হয় ৭ মানি এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স। একে অপরের ওপর দোষারোপ আর দর বেঁধে দেয়ার প্রতিযোগিতা চলে দিনের পর দিন। অন্যদিকে সংকট বাড়তে থাকায় বছরের শেষ প্রান্তিকে আবারো উত্তপ্ত হয় ডলারের বাজার। 

সূত্রমতে দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকট চলছে। এর পাশাপাশি নির্ধারিত দামে ডলার কেনাবেচা নিশ্চিত করতে অভিযান শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সঙ্গে যোগ দেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। এর মধ্যেই ডলারের দর নিয়ে কারসাজি করে ১০ ব্যাংক। শাস্তি হয় ৬ ব্যাংকের এমডির। সরিয়ে দেয়া হয় এসব ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের। এ ছাড়া বিশেষ অভিযানে বেশি দামে ডলার বিক্রির অপরাধে বেশকিছু মানিচেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত ও সিলগালা করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে ভয়-আতঙ্কে পরিচিত ছাড়া কারও কাছে ডলার বিক্রি করছেন না মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে খোলাবাজারে ডলারের সংকট দেখা দেয়। বিদেশগামী লোকদের নগদ ডলারের প্রধান উৎস এই খোলাবাজার। তবে এখন খোলাবাজারে এসে অনেকেই নগদ ডলার পাচ্ছেন না। ফলে খোলাবাজারে ডলারের দাম ওঠে ১২৮ টাকায়, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ দর। 

এদিকে ডলার সংকটের সমাধানে নেয়া হয় নানান পদক্ষেপ, তবে কোনো পদক্ষেপই কাজে আসেনি। ডলারের দর বেঁধে দেয়ার কাজটিও ব্যাংকের ওপরে ছেড়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবুও সংকট কাটে না, খোলাবাজারে নগদ ডলারের প্রবাহ থেকেই যায়। ভিন্ন পদক্ষেপ হিসেবে প্রথমবারের মতো ডলারের দাম তিন ধাপে কমানো হয়। এতে টাকার বিপরীতে ডলারের অবমূল্যায়ন করা হয় কৌশলে। 
সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রত্যাশিত রেমিট্যান্স কম ও রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি বিল বেশি হওয়ায় কমতে থাকে দেশের রিজার্ভ। গত দেড় বছর ধরে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েই চলছে। দেশের বাজারে ডলারের দর নির্ধারণ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ গত ১৪ই ডিসেম্বর ২৫ পয়সা কমিয়ে ডলার কেনাবেচার নতুন দর ঠিক করেছে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস এসোসিয়েশন (বাফেদা)। এর ফলে ডলার কিনতে সেবা খাতসহ সবধরনের রপ্তানি আয়, বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স, আন্তঃব্যাংকে কেনা ডলারের বিনিময় হার হবে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। আর বিক্রির (আমদানি, আন্তঃব্যাংক, বিদেশে অর্থ প্রেরণ) ক্ষেত্রে ডলারের বিনিময় হার হবে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা।
গত অক্টোবর-নভেম্বরে রাজধানীর মতিঝিল, দিলকুশা ও পল্টন এলাকার একাধিক একচেঞ্জ হাউস ঘুরে দেখা যায়, অলস সময় পার করছে মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো। ক্রয়-বিক্রয়ের দাম লেখা আছে বোর্ডে, কিন্তু ডলার নেই। বিক্রেতারা জানান, নির্ধারিত দামে তারা কিনতে পারছেন না, তাই বিক্রিও বন্ধ। তবে কঠোর গোপনীয়তার মধ্যদিয়ে কোথাও পাওয়া গেলেও নগদ ডলার কিনতে গ্রাহকদের গুনতে হচ্ছে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা। বর্তমানে ডলার কিনতে হচ্ছে ১২৫ টাকার বেশি দরে। এ ছাড়া ডলার সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে পণ্য আমদানি। এতে বাজারেও সংকট তৈরি হচ্ছে। ডলারের দরের প্রভাব বাজারজুড়ে। 

এদিকে সারা বছর সংকট থাকলেও বছরের শেষ সময়ে এসে ডলারে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। তবে সংকট কমেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গত ৩০শে নভেম্বর মোট রিজার্ভ ছিল ২৫.০২ বিলিয়ন ডলার, যা আইএমএফ’র হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী ১৯.৪০ বিলিয়ন ডলার। তবে ৭ই ডিসেম্বর রিজার্ভ কমে ২৪.৬৬ বিলিয়ন ডলারে নামে, যা বিপিএম৬ অনুযায়ী ১৯.১৩ বিলিয়ন ডলার। এরপর ১৪ই ডিসেম্বর রিজার্ভ আরেকটু কমে হয় ২৪.৬২ বিলিয়ন, তবে বিপিএম৬ অনুযায়ী এবার বেড়ে ১৯.১৬ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। এরপর গত বুধবার রিজার্ভ বেড়ে হয় ২৬.০৪ বিলিয়ন এবং বিপিএম৬ অনুযায়ী ২০.৬৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। আইএমএফ’র ঋণের কিস্তি ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) থেকে বাজেট সহায়তা এবং বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ ছাড় হওয়ার ফলে রিজার্ভ বেড়েছে।

এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী, চলতি ডিসেম্বরের শেষে বাংলাদেশকে নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ ১৭.৭৮ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৭৭৮ কোটি ডলারে উন্নীত করতে হবে। তবে বুধবার নিট রিজার্ভ ছিল ১৬ বিলিয়ন ডলারের কিছুটা বেশি। রিজার্ভ বাড়াতে গত বৃহস্পতিবার কয়েকটি ব্যাংক থেকে ২০ কোটি ডলারের কিছু বেশি ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার দায় পরিশোধের হিসাবে থাকা ডলার কিনেও রিজার্ভ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আইএমএফ’র ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি আমাদের রিজার্ভকে কিছু সময়ের জন্য স্থিতিশীল রাখবে। তবে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা বাবদ শত কোটি ডলারের বেশি একসঙ্গে পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ আবার কমে যাবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত ব্যাংকগুলোকে ডলার সাপোর্ট দিচ্ছি। আবার কিছু ব্যাংক থেকে ডলার কিনছি।

https://mzamin.com/news.php?news=90839