৩১ ডিসেম্বর ২০২৩, রবিবার, ১:১৫

কারা হেফাজতে বিএনপি নেতাদের মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে

 

ফিরে দেখা ....২০২৩

নাছির উদ্দিন শোয়েব: কারা হেফাজতে বিএনপি নেতাদের মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতার অভিযোগে শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক ধরপাকড়। একদিকে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগে বিভিন্ন থানায় মামলা দেয়া হচ্ছে, অন্যদিকে পুরানো মামলারও বিচার দ্রুত শেষ করা হচ্ছে। বিএনপির অভিযোগ এসব মামলায় ইতোমধ্যে তাদের ২০ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দলটির মহাসচিবসহ কয়েকডজন শীর্ষ নেতাও। কারাবন্দী বিএনপি নেতা-কর্মীরা সুচিকিৎসা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করে আসছিলেন অনেকের স্বজন। এছাড়াও বন্দীরা কারাগারে মানবিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। 

এরই মধ্যে ২৮ অক্টোবর থেকে গত দুই মাসে কারাগারে বিএনপির অন্তত সাত নেতা-কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ গত বৃস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) রাতে কাশিমপুর কারাগারে অসুস্থ হয়ে মারা যান বিএনপি নেতা মো. ফজলুর রহমান কাজল। তিনি রাজধানীর মুগদা থানা শ্রমিক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। কারাগারে মৃত্যু হওয়া বিএনপি নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-মো. ফজলুর রহমান কাজল, আসাদুজ্জামান হিরা খান, মতিবুল ম-ল, মনিরুল ইসলাম ও গোলাপুর রহমান।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) নভেম্বরের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, গত অক্টোবর মাসে কারা হেফাজতে মোট ১৬ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে আটজন হাজতি আর বাকিরা কয়েদি। সেপ্টেম্বরে এ সংখ্যা ছিল ১০ জন। এছাড়াও অক্টোবরে পুলিশি হেফাজতে দুইজন এবং পুলিশের ধাওয়া খেয়ে আরও একজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এমএসএফের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, কারা হেফাজতে মারা যাওয়া ১৬ জনের মধ্যে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সাতজন, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে চারজন, ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন, রাজবাড়ি কারগারে দুইজন, কুমিল্লা কারাগারে একজন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে একজনের মৃত্যু হয়। সব কারাবন্দীকে বাইরের হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। এমএসএফ আরো জানায়, কারা হেফাজতে মৃত্যু ছাড়াও নোয়াখালী জেলা কারাগারে সাজাপ্রাপ্তকে অপর এক কয়েদি কলম দিয়ে দুই চোখে আঘাত করে। কক্সবাজারের সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা এক নারী হাজতি পালিয়ে যান। অপর একটি ঘটনায় বগুড়া জেলা কারাগারের একটি কালভার্টের নিচের ড্রেন থেকে এক কারারক্ষীর লাশ উদ্ধার করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিভিন্ন সময় বিরোধী রাজনীতিক দলের বহু নেতাকর্মী  গ্রেফতার হয়েছেন। কারাবন্দী কয়েকজন স্বজনের অভিযোগ, আটকের পর নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়া বন্দীদের কারাগারে নেয়ার পর উন্নত চিকিৎসা দেয়া হয় না। এমন কয়েকজন বন্দী রয়েছেন তারা আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। অনেকেই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, বক্ষ ব্যাধি ও হার্টের রোগী এবং বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন। গ্রেফতারের আগে তারা নিয়মিত চিকিৎসা সেবা নিতেন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জীবন যাপন করতেন। কন্দ্রীয় কারাগারে একটি হাসপাতাল থাকলেও সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। হাসপাতালে পর্যাপ্ত সিট নেই। তাৎক্ষনিক জরুরি চিকিৎসা দেয়ার প্রয়োজন হলে সে ব্যবস্থা করা যায় না। অভিযোগ রয়েছে, বন্দীদের কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে শুরুতে গুরুত্ব দেয় না কারা কর্তৃপক্ষ।  

বিএনপি মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানিয়েছেন, গত বৃহস্পতিবার গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন রাজধানীর মুগদা থানা শ্রমিক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ফজলুর রহমান কাজল। রাত সাড়ে ১০টায় তার মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, গত ২৬ অক্টোবর গায়েবি মামলায় কাজলকে গ্রেপ্তারের পর কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়েছিলো। ২৬ ডিসেম্বর কারাগারে অসুস্হ হয়ে পড়লে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে হৃদরোগ হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে মারা যান তিনি। এই মৃত্যুকে হত্যাকান্ড বলে অভিহিত করে এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও উপযুক্ত বিচার দাবি করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। 

এরআগে গত ২৫ ডিসেম্বর ঢাকার কেরানীগঞ্জ কারাগারে শফী উদ্দিন (৭২) নামে বন্দী বিএনপি নেতার মৃত্যু হয়। তিনি গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলায় দুর্গাপুর ইউনিয়নের রাওনাট পূর্ব পাড়া ডোয়াইপাখুরি ২ নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি ছিলেন। শফী উদ্দিনের ছেলে মো. সুহেল জানান, গত ২৬ অক্টোবর রাতে কাপাসিয়া থানা-পুলিশ তার বাবাকে ডোয়াইপাখুরীর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর ২০২২ সালের ১৬ নভেম্বর দায়ের হওয়া বিস্ফোরক মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে গাজীপুর আদালতে পাঠায়। পুলিশ তার ১০ দিনের রিমান্ড চায়। অসুস্থ ও বয়োবৃদ্ধ শফী উদ্দিনকে আদালত জামিন এবং রিমান্ড না দিয়ে কারাগারে পাঠান। তিনি দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগে ভুগছিলেন। কারা হেফাজতে গাজীপুর সদর ও ঢামেক হাসপাতালে এর আগে কয়েক দফা চিকিৎসা নিয়েছিলেন। 

এদিকে গত ১ ডিসেম্বর কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় আসাদুজ্জামান হিরা খান (৪৫) নামে আরেক বিএনপি নেতার মৃত্যু হয়। আসাদুজ্জামান হিরা গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার ধামলই গ্রামের গিয়াস উদ্দিন খানের ছেলে। তিনি  উপজেলার কাওরাইদ ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। শ্রীপুর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান লিটন জানান, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ শেষে ফেরার পথে শ্রীপুর রেলস্টেশন আসাদুজ্জামানকে আটক করে। পরে তার বিরুদ্ধে বিস্ফোরক মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এর ডেপুটি জেলার স্বপন কুমার ঘোষ বলেন, আসাদুজ্জামানকে বিস্ফোরক মামলায় গত ২৯ অক্টোবর গাজীপুর জেলা কারাগারে নেওয়া হয়। পরে ১০ নভেম্বর কাশিমপুর কারাগারে আনা হয়।

অন্যদিকে গত ২০ ডিসেম্বর নওগাঁ কারাগারে বন্দী বিএনপির এক নেতার মৃত্যু হয়। সকালে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সকাল ৯টার দিকে তার মৃত্যু হয়। মারা যাওয়া ওই নেতার নাম মতিবুল ম-ল (৫৫)। তিনি জেলার পতœীতলা উপজেলার নজিপুর পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। একটি নাশকতার মামলায় গত ২৭ নভেম্বর থেকে নওগাঁ কারাগারে ছিলেন তিনি। জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার মতিবুলের মতো কারাগারে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাদের সুচিকিৎসা নেওয়া হচ্ছে না। আমরা মতিবুলের মৃত্যুর সঠিক কারণ জানার জন্য তদন্ত দাবি করছি।

অফরদিকে গত ১১ ডিসেম্বর রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বিএনপির এক নেতা মারা যান। অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই নেতার নাম মনিরুল ইসলাম (৫২)। তিনি গোদাগাড়ীর কাঁকনহাট পৌরসভার কাঁকনহাট স্টেশন পাড়া এলাকার আবেদ আলীর ছেলে। তিনি পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। একটি নাশকতার মামলায় গত ৭ নভেম্বর থেকে তিনি রাজশাহী কারাগারে ছিলেন। এছাড়া গত ২৬ নভেম্বর কাশিমপুর কারাগারে চট্টগ্রামের এক বিএনপি নেতার মৃত্যু হয়। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ওই বিএনপি নেতা গোলাপুর রহমান মারা গেছেন বলে জানিয়েছে কারাগার কতৃপক্ষ। তিনি চট্টগ্রাম নগরীর মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সহ-সভাপতি ছিলেন। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের হাই সিকিউরিটি ইউনিটের সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা জানান, কারাগারে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন গোলাপুর রহমান। তাকে দ্রুত কারা-হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাকে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। 

https://www.dailysangram.info/post/544747