২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৫:৫১

বছর জুড়ে নাভিশ্বাস নিত্যপণ্যে

 

তথ্য বলছে, ২০২২-এর তুলনায় ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম প্রায় ২৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যা মহামারির পরে সবচেয়ে কম। তবে বিশ্বে দাম কমলেও দেশের বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই। বছর জুড়েই চিনি, ভোজ্য তেল, পিয়াজ, ডিম, কাঁচা মরিচ, সবজি ও আলুর মূল্য বাড়িয়ে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চক্র শত শত কোটি টাকা ভোক্তার পকেট কেটে নিয়েছে, যা এখনো চলমান আছে। সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও তার প্রভাব পড়েনি বাজারে। এদিকে টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী বিরাজ করায় বহু মধ্যবিত্ত পরিবার তছনছ হয়েছে। ফলে অর্থনীতির জন্য এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি। গড় মূল্যস্ফীতি উঠেছে ৯.৪৯ শতাংশে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকেই অন্যান্য পণ্যের ব্যবহার কমাতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক পরিবার আকাশচুম্বী দামের কারণে বছরজুড়ে মাছ, মাংস, ডিম, দুধের চাহিদা মেটাতে পারেনি। সবমিলিয়ে দ্রব্যমূল্যের দামে অস্বস্তি নিয়ে কেটেছে ২০২৩ সাল।

এ ছাড়া সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবেও গত এক বছরে পণ্যের দাম বাড়ার তালিকাই দীর্ঘ হিসেবে লক্ষ্য করা গেছে। তবে যুদ্ধ, ডলার সংকট, অস্থিতিশীল পণ্যমূল্য ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা-এসব ইস্যু দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। অবশ্য তারা মনে করেন, গত এক বছরে সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা খুব একটা কাজে আসেনি। বেশকিছু পণ্য আমদানির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ছিল। কিন্তু তার সুফল মেলেনি। এ ছাড়া সরকার বেশ কয়েক বার বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম বেঁধে দিলেও কেউ তা মানেনি। 

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, যা সব শ্রেণির মানুষের জন্যই অস্বস্তির। বছরজুড়ে কেউ স্বস্তি পায়নি। গত এক বছরে সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলোও কাজে আসেনি। বেশকিছু পণ্য আমদানির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তার সুফল মেলেনি। 

বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বছরজুড়েই বাজারে জিনিসপত্রের দাম ছিল বেশ চড়া। কাঁচা মরিচ, চিনি, লবণ, আলু, চাল, গরু ও মুরগির মাংস, তেল, ডিম থেকে শুরু করে পিয়াজ; বছরজুড়ে এসব পণ্য ছিল ব্যাপক আলোচনায়। সিন্ডিকেট চক্র কখনো ডিম, আদা, রসুন কখনো আবার পিয়াজ বা আলুর দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট কেটেছে বার বার। এসব পণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো দেশে আলু, পিয়াজ ও ডিমের সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার আলু, কাঁচা মরিচ ও ডিম আমদানির অনুমতি দেয়।

সূত্র বলছে, ২০২৩ সালের শুরু থেকেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ঊর্ধ্বমুখী। বছরের শেষ ভাগে এসে তা আরও বেড়েছে। সরকারের নানা পদক্ষেপেও খাদ্যপণ্যের দামে লাগাম টানা যায়নি। বেড়েছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। গত আগস্ট মাসে হঠাৎ খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রথমবারের মতো দুই অঙ্কের ঘরে উঠে যায়। যা ছিল গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরের তিন মাস খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ শতাংশের উপরে। অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ১২.৫৬ শতাংশ। যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। মূল্যস্ফীতির কারণে বাজারে গিয়ে মানুষ ভুগেছেন। কখনো চালের দাম বেড়েছে। কখনো বা তেলের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে। আবার কখনো ডিমের ডজন দেড়শ’ টাকা ছাড়িয়েছে। হরতাল, অবরোধ, ডলার সংকট, পণ্য রপ্তানিতে ভারতীয় সরকারের নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন কারণে নিত্যপণ্যের দাম ছিল আকাশছোঁয়া। ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারায় বছরের শুরুতে চিনির সংকট দেখা দিয়েছিল। 

টিসিবি’র নিয়মিত বাজার দরের হিসাব মতে, গত এক বছরে বেশ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সামান্য কমেছে। আর বেড়েছে এমন পণ্যের তালিকাই বেশি। সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, গত এক বছরে শুধু চাল ও আটা-ময়দার দাম কমেছে। অন্যদিকে ডাল, তেল, চিনি, পিয়াজ, আদা, রসুন, আলু, ডিমসহ মসলা, মাছ, মাংসের দাম বেড়েছে।

বছরজুড়েই বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতি বিশ্ব অর্থনীতিতে কিছুটা দুরবস্থা সৃষ্টি করেছে। বছরের শুরুতে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দামবৃদ্ধি, ডলারের ঘাটতি, পণ্য ও কাঁচামাল আমদানিতে ডলার সংকট, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধিসহ বেশকিছু কারণে দ্রব্যমূল্যের সরবরাহ সংকটও ছিল। তারপরও এ বছর গম, চিনি ও ভোজ্য তেলের মতো বিভিন্ন আমদানিভিত্তিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। কিন্তু ডলার সংকট এবং জ্বালানির দাম বাড়ায় উচ্চতর আমদানি ব্যয়ের কারণে আমদানিকারকেরা পণ্যের দাম কমায়নি। এতে বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে এর সুফল পাননি ভোক্তারা।

বরং বছরজুড়ে ওইসব নানা সমস্যাকে পুঁজি করে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বাজার সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। প্রকৃতপক্ষে যতটুকু দাম বাড়ার কথা তার চেয়ে কয়েকগুণ দাম বাড়িয়ে অবৈধ মুনাফা লুটেছে অতি মুনাফালোভীরা।

বছরের মাঝামাঝি সময়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশে পণ্যের উচ্চমূল্য শুধু বাহ্যিক বা আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে নয়। এর পেছনে আছে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের অভাব, বাজারের সিন্ডিকেট, প্রয়োজনীয় মনিটরিংয়ের অভাব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা।

সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ‘অসহায়ত্ব’ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অনেক শক্তিশালী। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সিন্ডিকেটের সঙ্গে পেরে উঠছে না সরকার। এমনকি বছরের বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীকেও কয়েক দফা বাজার সিন্ডিকেট প্রতিরোধের তাগিদ দিতে হয়েছে।

এদিকে লাগামছাড়া দাম নিয়ন্ত্রণে চলতি বছর সরকার বেশকিছু পণ্যের দাম বেঁধে দেয়। এরমধ্যে চিনি, ভোজ্য তেল, পিয়াজ, আলু, ডিম অন্যতম। তবে বাজারে কোনো পণ্যই সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হয়নি। এখনো সেগুলো নির্ধারিত দামের চেয়ে অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে। এরমধ্যে শুধু ডিমের দাম সামান্য কমেছে।

ওদিকে বাজারে সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর করতে বছরজুড়ে তৎপরতা দেখা গেছে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের। প্রতিদিন সারা দেশে শত শত প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে। তবে জরিমানা করলেও পরক্ষণেই একই পণ্য বিক্রি হয়েছে বাড়তি দামে। এর পেছনে সিন্ডিকেট প্রতিরোধে প্রচলিত আইনের দুর্বলতাকে দায়ী করেন বিশ্লেষকেরা।

কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, বাজারে ভোক্তাকে জিম্মি করে ডাকাতি চলছে। এটা সম্পূর্ণ অনৈতিক। এটাকে ব্যবসা বলা যায় না। তিনি বলেন, বাজারে সুশাসনের ঘাটতির কারণেই সমস্যা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা যেমন খুশি দাম নির্ধারণ করছেন, সরকারের কোনো বিধি-বিধানের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। যেসব পণ্যের দাম বেঁধে দেয়া হয়েছে সেগুলো কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল। মাঝেমধ্যে ভোক্তা অধিদপ্তর কিছু জরিমানা করছে। এতে ব্যবসায়ীদের টনক নড়ছে না।

নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বছরজুড়ে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পেছনে ছুটেছে সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষ। খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল ও আটা এবং ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য কিনতে শুরুর মতো বছরের শেষ ভাগেও মানুষের দীর্ঘ লাইন চোখে পড়ছে। চাহিদার চেয়ে বরাদ্দ কম থাকায় অনেকে ওএমএসের চাল-আটা বা টিসিবি’র পণ্য না পেয়ে খালি হাতে ফিরেছেন। তবে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিতে বছরের শেষ ভাগে সরকার ফ্যামিলি কার্ডধারীদের পাশাপাশি আগের মতো আবারো টিসিবি’র ট্রাকসেল চালু করেছে। যদিও সে কার্যক্রমও চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।

রাজধানীর মগবাজার এলাকার বাসিন্দা খালেদ বলেন, গত বছর তার বেতন বেড়েছে ২ হাজার টাকা। কিন্তু বছরজুড়ে শুধু মাসিক খাদ্য ব্যয় বেড়েছে সাড়ে তিন হাজার টাকা। যা তার বর্ধিত বেতনের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি।

তিনি বলেন, জীবনে পণ্যের দামে এমন ডাকাতি আগে দেখিনি। ফলে সংসারের বাজেটে কাটছাঁট করতে হয়েছে। পুষ্টির জন্য মাছ-মাংস মাসে একবার খেতে হয়েছে। এ ছাড়া আগে নিয়মিত দুধ-ডিম খাওয়া হতো, সেটাও এখন বন্ধ। এমনকি কোথাও ঘুরতেও যাওয়া হয়নি।

এদিকে বর্তমানে মুরগির বাজার নিম্নমুখী থাকলেও চলতি বছরের শুরুর দিকে এ বাজার ছিল চরম অস্থিতিশীল। প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ২৬০ টাকা কেজিতে। 

ওদিকে দফায় দফায় চিনির দাম কমিয়ে-বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত প্রতি কেজি পরিশোধিত খোলা চিনি ১৩০ টাকা এবং প্রতি কেজি পরিশোধিত প্যাকেট চিনি ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। সবশেষ গত ১লা নভেম্বর চিনির আমদানি শুল্ক কমিয়ে অর্ধেক করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে দেশের বাজারে কমেনি চিনির দাম। উল্টো বাজার থেকে হাওয়া হয়ে গেছে প্যাকেটজাত চিনি। বর্তমানে বাজারে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায়।

জরুরি তিনটি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের আলোকে আলুর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩৫-৩৬ টাকা, দেশি পিয়াজের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৬৪-৬৫ টাকা আর ডিমের পিস সর্বোচ্চ ১২ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। দাম নির্ধারণ করে দেয়ার পরও কমেনি এসব পণ্যের দাম। 

উল্টো কয়েক গুণ বাড়ে পিয়াজের দাম। ওই সময় আলু বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৬০-৭০ টাকা পর্যন্ত, যা এখন আলুর মৌসুমের সময়ও ৬০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। টিসিবি’র তথ্য বলছে, গত এক বছরে দেশের বাজারে ১৮১.২৫ শতাংশ বেড়েছে আলুর দাম। পিয়াজ বিক্রি হয় ১০০-১২০ টাকায়। টিসিবি’র তথ্য বলছে, গত এক বছরে দেশের বাজারে ১৬২.৫ ও ২১২.৫ শতাংশ বেড়েছে দেশি ও ভারতীয় পিয়াজের দাম। ডিমের দাম প্রতি পিস ১২ টাকা বা প্রতি ডজন ১৪৪ নির্ধারণ করা হলেও খুচরা বাজারে প্রতি ডজন ১৫০-১৬০ টাকায় বিক্রি হয়। 

চলতি বছর বাজারে সবচেয়ে বেশি উত্তাপ ছড়িয়েছে কাঁচা মরিচ। দেশের কোথাও কোথাও প্রতি কেজি মরিচ বিক্রি হতে দেখা যায় ১ হাজার থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত।

এদিকে বর্তমানে মুরগির বাজার নিম্নমুখী থাকলেও চলতি বছরের শুরুর দিকে এ বাজার ছিল চরম অস্থিতিশীল। প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ২৬০ টাকা কেজিতে।

https://mzamin.com/news.php?news=90391