১৮ ডিসেম্বর ২০২৩, সোমবার, ৭:১৮

দুর্ভিক্ষের শঙ্কা : রাজনীতি নাকি অতিরাজনীতি

-রিন্টু আনোয়ার

 

হালকা-মাঝারি-ভারী কত বিষয় নিয়েই কথা হয়। অনাকাক্সিক্ষত-অবান্তর বিষয়াদি নিয়েও আলোচনা-সমালোচনাও জমে। অথচ খাদ্য নিয়ে আমরা কোন ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছি, তা এখন পর্যন্ত ভাবনায়ও আসছে না অনেকের। ওই ভবিষ্যৎটি অবশ্যই দুশ্চিন্তার-উদ্বেগের যার সূচনা ২০২০ সালের প্রথম প্রান্তিক থেকে এবং কেবল বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই।
করোনা মহামারীর দু’বছরে সারা বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন কমতে থাকে। সাপ্লাই চেইনেও ঘটতে থাকে বিপর্যয়। করোনা একটু দমতে না দমতেই ২০২২ থেকে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ দেয় আরেক ধাক্কা। মূল্যস্ফীতি, খাদ্য সরবরাহ হ্রাস, জ্বালানি ও গ্যাস সরবরাহ হ্রাস এবং মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি-রফতানি মন্দা, বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্কটে পড়ে গোটা বিশ্ব। তা সামলাতে দেশে দেশে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বনসহ ব্যাংক ও মুদ্রানীতিতে পরিবর্তন আনতে হয়। বাস্তবে সামলানো যায়নি। বড়জোর সাময়িক ঠেক দেয়া গেছে। আর খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁঁকিতে ছুটতে ছুটতে এখন ক্রান্তিকালে।

বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি সঙ্কট ইত্যাদির ফলে বাংলাদেশেও বিগত আট-নয় মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এ মূল্যস্ফীতি বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সাড়ে ৯ শতাংশ অতিক্রম করে। খাদ্যমূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশেরও বেশি। দিন দিনই চাল-ডাল, গম, ভোজ্যতেল, চিনি, তরিতরকারিসহ যাবতীয় খাদ্যসামগ্রীর দাম দিনে-রাতে বাড়ছে। মজুদদারি ও অতিমুনাফাখোরদের দৌরাত্ম্যে অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। দেশে দেশে জাতীয় আয়ের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিসহ মানুষের আয়-রোজগার কমে যাওয়া এবং খাদ্যনিরাপত্তায় হুমকি দেখা দেয়ার সমূহ শঙ্কা ঘুরছে।

 

বিশ্বের অন্তত ৪৫টি দেশে তীব্র খাদ্যসঙ্কটের শঙ্কা কথা জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-এফএও এবং বিশ্বখাদ্য কর্মসূচি-ডব্লিউএফপিও। জাতিসঙ্ঘের বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাড বলেছে, আগামী বছর অর্থনৈতিক মন্দার পাশাপাশি খাদ্যসঙ্কটও ভয়াবহ রূপ নেবে। এর প্রভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে। বাড়ছে বেকারত্ব। স্বাভাবিকভাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। আঙ্কটাড প্রতিবেদন প্রকাশের আগেই বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, বিশ্বমন্দা শুরু হলে ৩৫ কোটি মানুষ খাদ্য সঙ্কটে পড়বে। এফএওর জরিপে দেখা যায়, এশিয়ার ৯টি দেশ বড় রকমের খাদ্যসঙ্কটের মধ্যে আছে। এ ৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিশ্ব পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাংলাদেশেও খাদ্যাভাবের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়েছেন কৃষি উৎপাদন বাড়াতে। সর্বক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হতে।

তার আহ্বান কে কতটুকু বুঝেছেন, আমল দিয়েছেন- সেটি আরেক প্রশ্ন। ততক্ষণে ঘটনা যা ঘটার ঘটে চলছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে গত ১০ বছরের মধ্যে বর্তমান মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে। জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের স্বল্পতার কারণে শিল্পোৎপাদন বাধাগ্রস্ত। রফতানি প্রবৃদ্ধি গত বছরের তুলনায় অনেক কমে গেছে। প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য, এলএনজি ও জ্বালানি তেল, সার ইত্যাদি আমদানি করা যাচ্ছে না। এলসি খুলতে সাহস পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে বর্তমানে দেশে তিন কোটি ৩০ লাখ মানুষ দরিদ্র। তাদের এক কোটি ৭০ লাখ অতিদরিদ্র। বাস্তব হিসাবটা অবশ্যই আরো বেশি। ঘাটে-মাঠে-বাজারে নয়; রাস্তায় নামলেই তা বোধগম্য।

আওয়ামী লীগের ভেতরেও সম্ভবত একটি দুর্ভিক্ষ-ফোবিয়া কাজ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি অল্প দিনের ব্যবধানে দু’-তিনবার দুর্ভিক্ষ-আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছেন। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তো বলছেন আরো বেশি।
বাস্তব এ নমুনায় বাংলাদেশ আরেকটি দুর্ভিক্ষের দিকে যাচ্ছে কিনা-শঙ্কা ভর করেছে। অথচ এখনো কার্যকর আলোচনা বা পদক্ষেপ নেই। তবে খোঁচাখুঁচি আছে। দোষারোপও আছে। কেষ্টবেটার নামে আগেভাগেই এফআই করে রাখাও হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপির পরবর্তী পদক্ষেপ দেশে দুর্ভিক্ষ বাধানো। মানে দেশে দুর্ভিক্ষ একটি আসছে? এসে পড়লে তখন শুরু হবে আরেক রাজনীতি। কেষ্টবেটা বিএনপিকে তো আগেভাগে দায়ী করে রাখাই হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে- দুর্ভিক্ষের এমন আশঙ্কা সরকার কেন করছে? দুর্ভিক্ষ যদি আসেই, তার জন্য বিরোধী দলকেই বা দায়ী করা যায় কোন যুক্তিতে?

‘বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ’-এই প্রচার দীর্ঘ দিনের। সরকারের প্রায় সব মহল থেকেই বারবার এ কথা বলা হয়। এই বাহাদুরির মধ্যেই গত অর্থবছরে এক কোটি পাঁচ লাখ ৩৩ হাজার টন খাদ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরে এই আমদানির পরিমাণ কিছুটা কমে এক কোটি চার লাখ ৪৯ হাজার টন হতে পারে। এ তথ্য জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) গত সেপ্টেম্বরের খাদ্যশস্য প্রতিবেদনের। দুর্ভিক্ষের কথা উঠলেই বাংলাদেশের প্রবীণ মানুষজন এখনো আঁতকে উঠেন। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে সরকারিভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়েছিল। এতে ৩০ হাজার লোক খাদ্যাভাবে মারা গেছে বলে সরকারিভাবে নিশ্চিত করা হয়েছিল। তবে মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে। বেশির ভাগই একমত যে, দুর্ভিক্ষের আগে বা পরে ক্ষুধা বা অর্ধাহার-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে মৃতের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। নোবেলবিজয়ী ভারতের অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ১৯৮১ সালে যদিও লিখেছেন, ‘১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের কারণ আর যাই হোক, সেটি খাদ্য কমে যাওয়ার কারণে ঘটেনি। মানুষের সৃষ্টি ছিল সেই দুর্ভিক্ষ।’

দুর্ভিক্ষ করোনাভাইরাসের মতো ছোঁয়াচে রোগ নয়। দুর্ভিক্ষ মানুষের সৃষ্টি। কেন দুর্ভিক্ষ হতে পারে এবং তা রোধ করার জন্য রাজনৈতিক পদক্ষেপ কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা করার সময় এসেছে। কালক্ষেপণ করলেই বিপদ বাড়বে, কমবে না। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। আগামী কিছু দিনের মধ্যে কী ঘটবে তা কেউ বলতে পারে না। এ রকম সময়েই দুর্ভিক্ষের কথা শোনানো মানুষের জন্য আতঙ্কের। আবার ইতিহাসও কথা বলে ওঠে। প্রসঙ্গক্রমে এসে যায় কিছু কথাও। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের জেরে আওয়ামী লীগ বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখন বিএনপি সৃষ্টি হয়নি। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের আগে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বর্তমানের মতো বৈরী অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) এবং ভারতের পরামর্শ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা নিজ দল বিলুপ্ত করে একদলীয় শাসন (১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে) ‘বাকশাল’ কায়েম করে। পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্রের কবর রচিত হয় বাংলাদেশে। প্রথম স্নায়ুযুদ্ধের সে সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মদদপুষ্ট বাকশাল টেকেনি। ১৯৭৯ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ পুনর্জন্ম লাভ করে। বর্তমানে আওয়ামী লীগের গায়েও কিছুটা সেই পুরোনো বাতাস।

বাতাস যেমন বা যে দিকেরই হোক দুর্ভিক্ষ কাম্য নয়। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দেশের সার্বিক খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি, কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন ও মজুদ পরিস্থিতির বিষয়টি টপ প্রায়োরিটি পাওয়া উচিত। দরকার পরিস্থিতি দৃষ্টে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া। এবার দেশের খাদ্য উৎপাদন ও মজুদ পরিস্থিতির দিকে নজর দেয়া যাক। গত বছর দেশে চালের চাহিদা ছিল তিন কোটি ৫২ লাখ টন। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে জোগান নেমে আসে তিন কোটি ৪৬ লাখ টনে। ফলে ছয় লাখ টন ঘাটতি হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ২০ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়। গমের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে বার্ষিক ৭০ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। দেশে উৎপাদন হয় মাত্র ১০-১২ লাখ টন। ফলে প্রতি বছর প্রায় ৬০ লাখ টন গম আমদানি করতে হয়। দেশে চলতি বছর বোরো ধানের ভালো ফলন ছিল। কিন্তু হাওরের আগাম বন্যা এবং বৃহত্তর সিলেটসহ আরো কয়েকটি জেলায় কয়েক দফা বন্যার ফলে ফসল উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় উৎপাদন ১২-১৫ শতাংশ কম হয়েছে। সাম্প্রতিক খরা ও ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে আমন ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়।

এ রকম সময়ে দরকার খাদ্যনিরাপত্তা। এর কোনো বিকল্প দুনিয়াতে এখনো আবিষ্কার হয়নি। খাদ্য নিরাপত্তা বলতে বোঝায়- খাদ্যের সহজলভ্যতা ও মানুষের খাদ্য ব্যবহারের অধিকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যনিরাপত্তার তিনটি প্রধান স্তম্ভ নির্ধারণ করেছে। এগুলো হলো- খাদ্যের পর্যাপ্ততা, খাদ্যের সহজলভ্যতা ও খাদ্যের ব্যবহার-অপব্যবহার। চাহিদা অনুযায়ী খাদ্যের সরবরাহ থাকাকে বলা হয় খাদ্যের সহজলভ্যতা। খাদ্য ক্রয় করার সামর্থ্য থাকাকে বলা হয় খাদ্য গ্রহণের সামর্থ্য। তবে শুধু খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করলে হবে না, তার পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে নিরাপদ খাদ্য। খাদ্যকে ভেজাল ও অন্যান্য দূষণ থেকে মুক্ত অবস্থায় গ্রহণ করাই হলো নিরাপদ খাদ্য। নিরাপদ খাদ্য ব্যতীত খাদ্যনিরাপত্তা গড়ে তুললে তা আরো বিপদ হবে। কারণ মানুষ আসলে কখনোই না খেয়ে মরে না। কিছু না কিছু খেয়েই মরে। আর ওই কিছু না কিছুটা প্রায়ই হয় অখাদ্য-কুখাদ্য।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/799424