১৭ ডিসেম্বর ২০২৩, রবিবার, ৯:৪৮

দেশে স্টেন্টের দাম ভারতের তিন গুণ

দাম নির্ধারণে বৈষম্যের অভিযোগ আমদানিকারকদের

দেশে হৃদরোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত সবচেয়ে আধুনিক স্টেন্টের (হার্টের রিং) সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা। এই একই কম্পানির একই মানের স্টেন্টের দাম ভারতে ৩৮ হাজার ২৬৫ রুপি বা ৫০ হাজার ৮৯২ টাকা।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর গত ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশে স্টেন্টের এই দাম ঠিক করে। আর ভারতের জাতীয় ওষুধের দাম নির্ধারণ কর্তৃপক্ষ গত ৩১ মার্চ তাদের দেশে স্টেন্টের দাম ঠিক করে দেয়।

দুই দেশের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রায় সব মানের স্টেন্টের দাম বাংলাদেশে ভারতের চেয়ে সর্বোচ্চ তিন গুণ বেশি।  

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর দেশে ২৭টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের জন্য স্টেন্টের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করেছে। অধিদপ্তরের প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাতীয় নীতিমালা বা মার্কআপ ফর্মুলা অনুসরণ করা হয়েছে মাত্র তিন প্রতিষ্ঠানের বেলায়। যুক্তরাষ্ট্রের এই তিন প্রতিষ্ঠানের একই মানের স্টেন্টের মূল্য দাঁড়িয়েছে ভারতের প্রায় তিন গুণ।

আমদানিকারক বাকি ২৪ প্রতিষ্ঠানের স্টেন্টের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে মার্কআপ ফর্মুলা মানা হয়নি। তার পরও যে দাম ঠিক করে দেওয়া হয়েছে তা ভারতে চলমান দামের চেয়ে সর্বনিম্ন তিন হাজার টাকা থেকে তিন গুণ পর্যন্ত বেশি। কিন্তু ভারতের তৈরি দুটি ব্র্যান্ডের স্টেন্টের দাম ধরা হয়েছে ভারতে যে দামে বিক্রি হয় তার চেয়ে ১১ হাজার টাকা কম।

আবার বাংলাদেশে আয়ারল্যান্ডের তৈরি যে দুটি ব্র্যান্ডের স্টেন্ট সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় সেগুলোর একটির দাম ভারতের দ্বিগুণ, অন্যটির তিন গুণ বেশি।

যেমন—আয়ারল্যান্ডের অ্যাবোট ভাসকুলার কম্পানির তৈরি জিয়েন্স প্রাইম ব্র্যান্ডের একটি স্টেন্টের দাম ভারতে বাংলাদেশি টাকায় ২৯ হাজার ৯২৫ টাকা। বাংলাদেশে দাম ঠিক করে দেওয়া হয়েছে ৬৬ হাজার ৫০০ টাকা। একই দেশের বোস্টন সায়েন্টিফিকের তৈরি প্রোমুস এলিট ব্র্যান্ডের স্টেন্টের দাম বাংলাদেশে ধরা হয়েছে ৯৩ হাজার ৫০০ টাকা। ভারতে সেটির দাম ২৯ হাজার ৯২৫ টাকা।

এই দামে সন্তুষ্ট নয় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল ডিভাইস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন।

তারা দাম পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছে এবং গতকাল শনিবার থেকে হাসপাতালগুলো তাদের সরবরাহ করা স্টেন্ট ব্যবহার না করার অনুরোধ জানিয়েছে।

জানতে চাইলে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, রোগীদের কথা চিন্তা করে আগে সরবরাহ করা স্টেন্ট ব্যবহার যাতে বন্ধ না করা হয় তা বিবেচনা করা উচিত। পাশাপাশি দ্রুত সময়ের মধ্যে ঔষধ প্রশাসনের সঙ্গে বসে সমস্যার সমাধান করা উচিত। তা না হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে রোগীরা।    

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র উপপরিচালক নুরুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, হার্টের রিং নিয়ে নৈরাজ্য কমাতে সরকার মূল্য নির্ধারণ করেছে। ঔষধ প্রশাসন একা এই মূল্য নির্ধারণ করতে পারে না। এর জন্য ১৩ সদস্যের মূল্য নির্ধারণী কমিটি রয়েছে। তারা নির্ধারিত সীমা অনুযায়ী স্টেন্টের মূল্য নির্ধারণ করেছে। এই দামের মধ্যে সরবরাহকারীর ট্যাক্স ও লাভ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ছাড়া মধ্যস্বত্বভোগীদের জন্য ১১.৫ শতাংশ খুচরা কমিশন রাখা হয়েছে।

ভারত কিভাবে একই মানের স্টেন্টের দাম এত কম নির্ধারণ করেছে, জানতে চাইলে নুরুল আলম বলেন, ভারতে স্টেন্টের বিক্রি বাংলাদেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। ফলে প্রস্তুতকারক কম্পানিগুলো সেখানে কিছু সুবিধা দেয়, যা বাংলাদেশ পায় না।  

পাঁচ হাসপাতালে স্টেন্ট সরবরাহ বন্ধের চিঠি

দেশে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল ডিভাইস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন পাঁচটি হাসপাতালে স্টেন্ট সরবরাহ বন্ধের চিঠি দিয়েছে। তাদের দাবি, স্টেন্টের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বৈষম্য করা হয়েছে। স্টেন্ট সরবরাহ বন্ধের চিঠি পাওয়া হাসপাতালগুলো হলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন। এই পাঁচটি হাসপাতালেই মূলত হৃদরোগের চিকিৎসা বেশি হয়। এই হাসপাতালগুলোকে গতকাল থেকে তাদের আগে সরবরাহ করে রাখা স্টেন্ট ব্যবহার না করার অনুরোধ করা হয়েছে।     

সংগঠনটির একাধিক নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, ঔষধ প্রশাসন স্টেন্টের বাজার তিনটি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। ২৪টি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে জাতীয় নীতিমালা বা মার্কআপ ফর্মুলা অনুসরণ না করা এবং কেনা মূল্যের চেয়ে কম মূল্য নির্ধারণ এর প্রমাণ।

সংগঠনটিরই একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জাতীয় নীতিমালা বা মার্কআপ ফর্মুলা অনুসরণ করা হলেও বাজারে সর্বাধুনিক স্টেন্টের মূল্য কোনোভাবেই ৭০ হাজার টাকার বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। এখন ধরা হয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা। শুধু সিন্ডিকেটের কারণে দাম এত বেশি ধরা হয়েছে।

জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র নুরুল আলম বলেন, ইউরোপীয়ান কম্পানির স্টেন্ট আমদানিকারকরা বলছেন তাঁদের লোকসান হবে। এই তথ্য সঠিক নয়। কারণ লাভ ধরেই মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

নুরুল আলম বলেন, সর্বশেষ বৈঠকে ইউরোপীয় কম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতেই দাম নির্ধারণ করা হয়। সমস্যা থাকলে বৈঠকেই তাঁরা আলোচনা করতে পারতেন। আবার এখনো আলোচনার সুযোগ আছে। কিন্তু হঠাৎ করে স্টেন্ট সরবরাহ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া তাঁদের উচিত হয়নি।

যে তিন প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দেওয়া হলো

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর যে ২৭ প্রতিষ্ঠানের স্টেন্টের মূল্য নির্ধারণ করেছে এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাবোট ভাসকুলার, বোস্টন সায়েন্টিফিক ও মেডট্রোনিক নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। এগুলোর দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতিটি এক লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা করে।

ইউরোপের ব্র্যান্ডের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় আয়ারল্যান্ডের অ্যাবোট ভাসকুলার, বোস্টন সায়েন্টিফিকের তৈরি জিয়েন্স প্রাইম এবং প্রোমুস এলিট ব্র্যান্ডের স্টেন্ট। এগুলোর দাম নির্ধারণ করা হয়েছে যথাক্রমে ৬৬ হাজার ৫০০ ও ৯৩ হাজার ৫০০ টাকা। আবার সুইজারল্যান্ডের বায়োসেন্সর ইন্টারভেনশনালের স্টেন্টের দাম ধরা হয়েছে ৬৫ হাজার টাকা। একই দেশের বায়োটিক এজির স্টেন্টের দাম ৫৮ হাজার টাকা। জার্মানির ট্রান্সলুমিনা জিএমবিএইচ কম্পানির স্টেন্টের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৩ হাজার টাকা।

যে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশে সেগুলোর সরবরাহকারী কারা? অ্যাবোট ভাসকুলার কম্পানির মেডিক্যাল ডিভাইস আমদানি করে কাডিয়ার্ক কেয়ার লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির আহমেদ। 

বোস্টন সায়েন্টিফিকের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ভাসটেক লিমিটেড। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাংলাদেশে মেডিক্যাল ডিভাইস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন।

মেডট্রোনিকের ডিলার মেডট্রোনিক বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহাবুবুর রহমান ডালিম।

অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ২০১৭ সালের আগে মেডিক্যাল ডিভাইস বিক্রির গাইডলাইন ছিল না। পরবর্তী সময়ে জাতীয় নীতিমালা অনুযায়ী সরকার ১.৪২ শতাংশ মার্কআপ ফর্মুলা করে এবং প্রথম ধাপে যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি কম্পানিকে প্রস্তাব দেয় মার্কআপ ফর্মুলা অনুযায়ী রিংয়ের মূল্য নির্ধারণের জন্য। কিন্তু বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্য নির্ধারণ ফর্মুলা অনুসারে কেন করা হলো না, এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন ভালো বলতে পারবে।

সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে খরচ কেমন?

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের জন্য বেশি ব্যবহৃত হয় স্টেন্টের পুরনো সংস্করণ। এগুলোর দাম ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। আবার একই স্টেন্ট বেসরকারি হাসপাতালে বিক্রি করা হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকায়।

স্টেন্ট ব্যবহারের প্রয়োজনীতা সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. মহসীন হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, সব রোগীর ক্ষেত্রে স্টেন্ট ব্যবহার করার দরকার হয় না। বেশির ভাগ রোগীকে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। ওষুধের খরচ প্রতি মাসে গড়ে তিন হাজার টাকার বেশি হয়ে থাকে। আর যেসব রোগীকে স্টেন্টিং (রিং ব্যবহার) করানো হয় তারা তুলনামূলক ভালো থাকে। তবে তাদের ক্ষেত্রেও মাসে তিন হাজার টাকা ওষুধের পেছনে খরচ করতে হয়।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/12/17/1346317