১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৩:৩৪

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন

বৈদেশিক ঋণের তুলনায় রিজার্ভ সর্বনিম্নে

ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমেছে ৪৮ শতাংশের বেশি

 

দেশের মোট বৈদেশিক ঋণের তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অনুপাত সর্বনিম্নে এসে নেমেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া ও বৈদেশিক ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে এমনটি হয়েছে। গত ১২ বছরে যে হারে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে, সেই হারে রিজার্ভ বাড়েনি। এছাড়া গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশের রিজার্ভ কমছে। কিন্তু ঋণ বেড়েছে। এসব মিলে ঋণের বিপরীতে রিজার্ভের অনুপাত কমে গেছে।

গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেবট রিপোর্ট ২০২৩’ বা ‘বৈশ্বিক ঋণ প্রতিবেদন ২০২৩’ শীর্ষ প্রকাশনা থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সূত্র জানায়, রিজার্ভের বিপরীতে বৈদেশিক ঋণের অনুপাত কম থাকলে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বেশি থাকে, ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে আর্থিক ঝুঁকি কম থাকে। অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে রিজার্ভের অনুপাত কম থাকলে আর্থিক ঝুঁকি বাড়ে। ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাও কমে। এসব কারণে ৭ বছর ধরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা গড়ে কমছে। মাঝে এক বছর বাড়লেও তা স্থায়ী হয়নি। তবে এখনো দেশটি বৈদেশিক ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়নি। জিডিপির তুলনায় ঋণের অনুপাতে দেশটিতে কোনো ঝুঁকিও নেই। তবে আইএমএফ এক প্রতিবেদনে বলেছে, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিুমানের ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে রিজার্ভ বেড়েছে। ফলে ওই সময়ে ঋণ পরিশোধে সক্ষমতা বেড়েছে। ওই সময়ে রিজার্ভ বেড়েছে, কিন্তু বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধির হার ছিল কম। যে কারণে ঋণের বিপরীতে রিজার্ভের অনুপাত কমেছে। ২০১২ সালের রিজার্ভ ও ঋণের অনুপাত ছিল ৪৩ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১৩ সালে এই অনুপাত আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশে, ২০১৪ সালে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৬৩ দশমিক ৩ শতাংশে। একই কারণে ২০১৫ সালেও রিজার্ভ ও বৈদেশিক ঋণের অনুপাত বেড়ে ৭১ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০১৬ সালে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭ দশমিক ৭ শতাংশে। এরপর থেকে বৈদেশিখ ঋণ বেড়েছে বেশি হারে। কিন্তু সে তুলনায় রিজার্ভ বেড়েছে কম। এ কারণে ঋণের বিপরীতে রিজার্ভের অনুপাত কমতে থাকে। যে ধারা এখনো অব্যাহত আছে। ২০১৭ সালে ঋণের বিপরীতে রিজার্ভের অনুপাত কমে ৬৫ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০১৮ সালে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৫৬ দশমিক ১ শতাংশে। ২০১৯ সালে আরও কমে দাঁড়ায় ৫২ দশমিক ৩ শতাংশে। ২০২০ সালে দেশের রিজার্ভ বেড়েছে, কিন্তু ঋণ তেমনটা বাড়েনি। এ কারণে আগের দুই বছরের তুলনায় এ অনুপাত আবার বেড়ে ৫৮ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০২১ সালে রিজার্ভ বেড়ে রেকর্ড গড়লেও ঋণও বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে। এ কারণে ওই বছরে রিজার্ভ ঋণের অনুপাত আবার কমে ৫০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে যায়। ২০২২ সালে তা আরও কমে ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশে নামে। গত ১১ বছরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ওই সময়ে ঋণের বিপরীতে রিজার্ভের অনুপাত কমেছে ৩২ দশমিক ১ শতাংশ। ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমেছে ৪৮ শতাংশের বেশি।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশের বর্তমান নিট রিজার্ভ ১ হাজার ৯১৭ কোটি ডলার। বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৯০০ কোটি ডলারে। নিট রিজার্ভের হিসাবে ঋণের বিপরীতে রিজার্ভের অনুপাত ১৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০১২ সালে দেশের বৈদেশিক ঋণ ছিল ২ হাজার ৯১৬ কোটি ডলার। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৭০১ কোটি ডলারে। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৭ হাজার ৫৫০ কোটি ডলার, স্বল্পমেয়াদি ঋণ ১ হাজার ৮৫৩ কোটি ডলার। গত বছরে সরকারকে বৈদেশিক মূল ঋণ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৫১৪ কোটি ডলার ও সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ১০৪ কোটি ডলার।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অক্টোবর পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণ বেড়ে ৯ হাজার ৯০০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশের মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে ঋণের অংশ ২০২০ সালে ছিল ১৯০ দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ রপ্তানি আয় ১০০ কোটি ডলার হলে ঋণ ১৯০ দশমিক ১০ কোটি ডলার। ২০২১ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৮৪ দশমিক ৩ শতাংশে। ২০২২ সালে তা আরও কমে দাঁড়িয়েছে ১৬০ দশমিক ২ শতাংশে। মোট ঋণের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বাড়ছে। ২০২০ সালে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০২১ সালে ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ, ২০২২ সালে ১৯ দশমিক ১ শতাংশ। বর্তমানে তা আও বেড়ে ২১ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। স্বল্পমেয়াদি ঋণে বেশি ঝুঁকির মাত্রা বাড়ে। সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে যে ডলার সংকট দেখা দিয়েছে তার অন্যতম কারণ হচ্ছে স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধের বাড়তি চাপ। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিকল্পনা করে পরিশোধ করা সম্ভব হলেও স্বল্পমেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। যে কারণে ডলারের ওপর চাপ বাড়িয়ে দেয়।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, এদিকে মোট জাতীয় আয়ের তুলনায় বৈদেশিক ঋণের অনুপাত ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ২০১২ সালে ছিল ২০ শতাংশ। পরে তা কমতে থাকে। ২০২০ সালে ছিল ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এরপর থেকে ঋণ বাড়ায় এই অনুপাত আবার বেড়ে যায়। ২০২১ সালে জাতীয় আয়ের বিপরীতে ঋণের অনুপাত ছিল ২০ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০২১ সালে কমে দাঁড়ায় ২০ দশমিক ৩ শতাংশে। বর্তমানে তা আরও কমেছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/751812