১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৩:৩০

বাইশ পরিবার উপাখ্যান

-ইবনে নূরুল হুদা

 

স্বাধীনতাত্তোরকালে আমরা বাইশ পরিবারের উপাখ্যান শুনেছি। এখন শুনছি লক্ষ পরিবারের রূপকথার গল্প। অতীতে বাইশ পরিবার নিয়ে অভিযোগের অন্ত ছিল না। অভিযোগ ছিল এইসব পরিবারেই দেশের সিংগভাগ অর্থ সঞ্চিত ছিল। তাদের নানা অপকর্মের কারণে দেশের মানুষ ক্রমেই দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে। এমন অভিযোগই ছিল একশ্রেণির রাজনীতিকদের মুখে মুখে। কিন্তু সার্বিক দিক বিবেচনায় অনুমিত হয় এই ২২ পরিবারের প্রত্যেকেই ছিলেন স্বনামধন্য শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী। প্রায় ক্ষেত্রেই বৈধভাবে সঞ্চিত অর্থবিত্তের মালিক। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পরও যারা কোটিপতি হয়েছেন তাদের অধিকাংশই তো রীতিমত আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ। এদের সিংহভাগই তাদের অর্থ-বিত্তের উৎস জানাতে মোটেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।

মূলত, ১৯৭০ সালের আগ পর্যন্ত অবিভক্ত পাকিস্তানে ২২ কোটিপতি বণিক পরিবারের কথা জানা যায়। তাদের মধ্যে দু’টি পরিবার ছিল পূর্ব পাকিস্তানের তথা বাংলাদেশে। একটি হলো এ কে খান পরিবার। অন্যটি ইস্পাহানি (অবাঙালি) পরিবার। এর বাইরে আরও অর্ধশতাধিক জমিদার পরিবার ছিল। স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশে এসব পরিবারের প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকলেও বর্তমানে তারা যেন হারিয়ে যেতে বসেছে! বিলীন হতে চলেছে কালের গর্ভে।

জানা যায়, ১৯৬৯-৭০ সালে শীর্ষ ১০ বাংলাদেশী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বা পরিবারের শীর্ষে ছিল এ কে খান পরিবার। এই পরিবারের ১২টি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ছিল। সম্পদের পরিমাণ ছিল আনুমানিক সাড়ে ৭ কোটি রুপি। দ্বিতীয় স্থানে ছিল গুলবক্স ভূঁইয়া পরিবার। তাদের প্রতিষ্ঠান ছিল ৫টি। সম্পদের পরিমাণ সাড়ে ৬ কোটি রুপি। তৃতীয় স্থানে থাকা জহুরুল ইসলাম ও তার ভাইদের সম্পদের পরিমাণ ছিল ৬ কোটি রুপি। তাদের প্রতিষ্ঠান ছিল ১৪টি। চতুর্থ স্থানে থাকা ফকির চাঁদ পরিবারের ৯টি প্রতিষ্ঠান ছিল। তাদের সম্পদের পরিমাণ ছিল ৬ কোটি রুপি। পঞ্চম স্থানে ছিল মকবুল রহমান ও জহিরুল কাইয়ুম পরিবার। এ পরিবারটির ৬টি প্রতিষ্ঠান ছিল। সম্পদের পরিমাণ ছিল ৫ কোটি রুপি। ষষ্ঠ স্থানে থাকা মুসলিম উদ্দিনের পরিবারের ৬টি প্রতিষ্ঠান ও ৫ কোটি রুপির সম্পদ ছিল। সপ্তম স্থানে ছিলেন শামসুজ্জোহা পরিবার। তাদের ৪টি প্রতিষ্ঠান ও ৫ কোটি রুপির সম্পদ ছিল। অষ্টম স্থানে ছিলেন খান বাহাদুর মুজিবর রহমান। ওই সময় তার পরিবারের ৫টি প্রতিষ্ঠান ও সাড়ে ৪ কোটি রুপির সম্পদ ছিল। নবম স্থানে থাকা আফিল উদ্দিন আহমেদ পরিবারের ৪টি প্রতিষ্ঠান ছিল। তাদের সম্পদ ছিল ৪ কোটি রুপি। দশম স্থানে থাকা এমএ সাত্তার পরিবারের ছিল ৫টি প্রতিষ্ঠান। তাদের সম্পদ ছিল ৩ কোটি রুপি।

তৎকালীন ধনীদের সম্পদের হিসাব করা হয়েছে আনুমানিক সম্পত্তির ভিত্তিতে। আর মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স প্রকাশিত মেম্বার ডিরেক্টরির তথ্য বিশ্লেষণ করে সাজানো হয়েছে ১৯৮৮ সালের শীর্ষস্থানীয় শিল্প ও বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর তালিকা। এসব ধনীদের বাইরেও বনেদি পরিবার ছিল। এর মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রামের রাউজানের তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার ও অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট একেএম ফজলুল কাদের চৌধুরী ও আনোয়ারা উপজেলার আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর পরিবার। তার বাবা ছিলেন জমিদার নূরুজ্জামান চৌধুরী। এছাড়া বনেদি পরিবারের অন্যতম ছিল নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবার। এর বাইরে বিপুল অর্থের মালিক ছিল তেওতা জমিদার পরিবার। এই জমিদারির আওতাভুক্ত ছিল ঢাকা, ফরিদপুর, পাবনা এবং দিনাজপুরসহ রংপুর ও বর্ধমানের কিছু অংশ। ১৯১৪ সালে এই পরিবারের দিনাজপুরে থাকা সম্পত্তির মূল্য ছিল ১১ লাখ টাকারও বেশি। তখন এই পরিবার ৬০ হাজারেরও বেশি টাকা কর দিতো। বাংলাদেশ ভূখ-ে একসময় প্রভাব বিস্তার করে ফরিদপুরের জমিদার পরিবার। এর একটি কীর্তিপাশা জমিদার পরিবার। তারা ঝালকাঠি জেলার বৈদ্য বংশীয় জমিদার। বরিশালের মাধবপাশা জমিদার পরিবারও ধনী ছিল। বর্তমানে জমিদার পরিবারগুলোর অবস্থা বেশ নাজুক। তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির অধিকাংশই এখন বেদখল।

জানা গেছে, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার বকুল কিশোর আচার্য চৌধুরীর পরিবারটির সংসার চলছে সুপারি ও নারিকেল বিক্রি করে। এই পরিবারের একজন সদস্য অভিযোগ করে বলেছেন, ময়মনসিংহের ভালুকা, গফরগাঁও, গাজীপুর, জয়দেবপুর, বগুড়া, বরিশাল, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন স্থানে এখনও তাদের সম্পত্তি রয়েছে। তবে সেগুলো তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে।

একইভাবে পাকিস্তানের ধনাঢ্য আদমজী পরিবারের তিন ভাই ওয়াহেদ আদমজী ওরফে দাউদ আদমজী, জাকারিয়া আদমজী এবং গুল মোহাম্মদও এখন ইতিহাস। আদমজী পরিবার যৌথভাবে ১৯৫০ সালে সিদ্ধিরগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ২৯৪ দশমিক ৮৮ একর জমিতে গড়ে তোলে আদমজী জুট মিলস। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পাকিস্তান আমলে ২২ ধনী পরিবার থাকলেও বাঙালি কোনও ধনী পরিবার ছিল না বললেই চলে। স্বাধীনতার পর থেকে ধনীরা এ দেশ থেকে চলে যাওয়া শুরু করে। তাদের মধ্যে অন্যতম আদমজী গ্রুপ। এছাড়া অনেকেই চলে গেছে স্বাধীনতার পর। তাদের মতে, বাংলাদেশে এখনকার ধনীরা সেই ২২ পরিবারকেও ছাড়িয়ে গেছেন। এখন লাখ লাখ ধনী পরিবারের বসবাস এ দেশে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে কিংবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েও অনেকে ধনী হয়েছেন। এ কারণে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্যও বেড়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের বক্তব্য হলো, ‘স্বাধীনতার আগে এ দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে ধনী পরিবারগুলো। স্বাধীনতার পর তারা ব্যবসা গুটিয়ে পাকিস্তানে চলে গেছেন। স্বাধীনতার পর দেশের অনেকেই সেইসব ব্যবসার হাল ধরেছেন। ওই সময় অনেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাও পেয়েছেন। তার ভাষায়, দেশের অর্থনীতি যেভাবে বড় হয়েছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনেকেই প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জন করে সফলতা দেখিয়েছেন। পাকিস্তানের বড় ব্যবসায়ী ধনীরা মূলত চা এবং পাটের ব্যবসায় বিনিয়োগ করতেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর ব্যবসার ধরন বদলে গেছে। ব্যাংক থেকে অনেকে ঋণ সুবিধাও পেয়েছেন। পাশাপাশি তাদের দক্ষতাও বেড়েছে। সব মিলিয়ে যোগ্যরাই এ দেশে ধনী পরিবার করতে পেরেছেন।

মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স প্রকাশিত মেম্বার ডিরেক্টরির তথ্য অনুযায়ী, আশির দশকে জহুরুর ইসলাম গ্রুপ দেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল। ঠিকাদার ব্যবসার মাধ্যমে গ্রুপটি প্রতিষ্ঠা করেন জহুরুল ইসলাম। ১৯৮৮ সাল নাগাদ এ গ্রুপের বার্ষিক টার্নওভার দাঁড়ায় ৬২৮ কোটি টাকায়। এ সময় গ্রুপের অধীনে ছিল ২৪ প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৮ সালে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় নম্বরে ছিল ইস্পাহানি গ্রুপ।

আশির দশকে এএসএফ রহমান প্রতিষ্ঠিত বেক্সিমকো গ্রুপ ছিল তালিকার তৃতীয় স্থানে। ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক টার্নওভার ছিল ৫২৪ কোটি টাকা। চতুর্থ স্থানে ছিল মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইনের আনোয়ার গ্রুপ। পঞ্চম স্থানে থাকা এ কে খান গ্রুপের টার্নওভার ছিল ৪০০ কোটি টাকা। ষষ্ঠ ধনী ব্যবসায়ী পরিবার ছিল মুহাম্মদ ভাই। সপ্তম স্থানে লতিফুর রহমানের ডব্লিউ রহমান জুট, অষ্টম স্থানে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর এপেক্স, নবম স্থানে এম মোর্শেদ খানের প্যাসিফিক এবং দশম স্থানে ছিল স্যামসন এইচ চৌধুরীর স্কয়ার গ্রুপ।

ব্যাংকিং খাতের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল মাত্র ৫ জন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে (১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত) এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ জনে। জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে (মে ১৯৮১) সংখ্যাটি বেড়ে হয় ৯৮। বর্তমানে ব্যাংক খাতে কোটি টাকার বেশি সঞ্চয় রয়েছে এমন হিসাবধারীর সংখ্যা লক্ষাধিক। দিনবদলের সঙ্গে অর্থনীতি বড় হয়েছে, পাশাপাশি বেড়েছে সম্পদশালী পরিবারের সংখ্যাও।

মূলত, কালের বিবর্তনে এবং রাজনৈতিক চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যেই ধনী ব্যক্তির ফিরিস্তি ক্রমে দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হচ্ছে। এমনকি শীর্ষ ধনীর তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম। এর মধ্যে আছেন ‘বিজনেস মোগল’ নামে পরিচিত ড্যাটকো গ্রুপের চেয়ারম্যান মুসা বিন শমসের। ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে তিনিই বাংলাদেশের শীর্ষ ধনী। তার সম্পদের পরিমাণ ১০০ কোটি ২০ লাখ ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ৯৫ হাজার কোটি টাকা)। এছাড়া তালিকায় আছেন বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সালমান এফ রহমান। বেইজিংয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান হুরুন গ্লোবালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে তার অবস্থান ১৬৮৫তম। বাংলাদেশের কোনও ব্যবসায়ী এই প্রথম আন্তর্জাতিকভাবে ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় উঠে আসলেন। তার সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১৩০ কোটি ডলার। 

ধনীদের তালিকায় আরও আছেন বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ আকবর সোবহান, পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাশেম, গাজী গ্রুপের গোলাম দস্তগীর গাজী, যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম (মরহুম), ইস্ট-কোস্ট গ্রুপের মালিক আজম জে চৌধুরী, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, এস আলম গ্রুপের সাইফুল আলমসহ শতাধিক ব্যক্তি। বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বেসরকারি হাসপাতাল, টিভি চ্যানেল, ব্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক তারা। এর বাইরেও নতুন নতুন শিল্পোদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২ কোটি টাকা বা এর বেশি টাকার সম্পদের মালিক এখন ১৭ হাজার ৩৯ জন।

নানা কারণেই জাতীয় অর্থনীতিতে টালটামাল অবস্থা চলছে। একই সাথে মূল্যস্ফীতি নতুন উচ্চতায় উঠেছে। নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, কমেছে সঞ্চয়ও। এর মধ্যেও বাংলাদেশে বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা। এক বছরের ব্যবধানে নতুন করে সাত হাজারের বেশি কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব বেড়েছে।

সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যমতে, ব্যাংক হিসাবে (অ্যাকাউন্ট) কোটি টাকার বেশি আছে, এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এখন এক লাখ ১৩ হাজার ৫৮৬। এক বছর আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে কোটি টাকার এই হিসাব ছিল এক লাখ ছয় হাজার ৫২০টি। বছরের ব্যবধানে কোটি টাকার হিসাব বেড়েছে সাত হাজার ৬৬টি। তিন মাসে এ রকম হিসাব বেড়েছে ৩২টি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। ২০০৬ সালে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল সাড়ে আট হাজার। এই হিসাবে গত ১৬ বছরে কোটিপতি বেড়েছে এক লাখ পাঁচ হাজার জন। এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালকের বক্তব্য হচ্ছে, যখন মূল্যস্ফীতি বাড়ছে সেই সময়ে কোটিপতি বাড়ার মানে হচ্ছে টাকা কিছু মানুষের হাতে বন্দী।

মূল্যস্ফীতির এই সময়ে কিছু মানুষ ধনী হচ্ছে। দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিক থাকলে এটা হওয়ার সুযোগ ছিল না। কারণ সঙ্কটের কারণে এখন আমানতের প্রবৃদ্ধি অনেক কম। এর মানে মানুষ এখন ব্যাংকে টাকা কম রাখছে। কোটিপতিরাও কম রাখছে। এর মধ্যে আবার ব্যাংকে আমানতের সুদহার কম, ব্যাংকে টাকা রাখলে ট্যাক্স কাটে। এর মধ্যেও কোটি টাকার হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া মানে সম্পদ আছে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে।

 কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার ৬৮৪। এসব হিসাবে জমা আছে ১৭ লাখ ১৩ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে কোটি টাকার হিসাবে জমা আছে সাত লাখ ২৫ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ৪২.৩৫ শতাংশ কোটি টাকার হিসাবধারীদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, এক কোটি এক টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা ৮৯ হাজার ৭৬০, যাতে জমা এক লাখ ৮৭ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। পাঁচ কোটি এক টাকা থেকে ১০ কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা ১২ হাজার ২২১, যাতে জমা ৮৬ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। এ ছাড়া ১০ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকার হিসাব রয়েছে চার হাজার ৭৪টি, ১৫ কোটি থেকে ২০ কোটির মধ্যে এক হাজার ৯৬৮টি, ২০ কোটি থেকে ২৫ কোটির মধ্যে এক হাজার ২৭৪টি, ২৫ কোটি থেকে ৩০ কোটির মধ্যে রয়েছে ৯১৯টি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, কোটি টাকার হিসাব মানেই কোটিপতি ব্যক্তির হিসাব নয়। কারণ ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখার তালিকায় ব্যক্তি ছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আবার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক হিসাবও রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কোটি টাকার হিসাবও রয়েছে। কোটি টাকার স্থিতি থাকা ব্যাংক হিসাবের তথ্য দিলেও সে হিসাবগুলোর মধ্যে ব্যক্তির সংখ্যা কত, সেই পরিসংখ্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে নেই। অর্থাৎ কোটিপতি ব্যক্তির সংখ্যা কত তা বোঝা যাচ্ছে না।

দেশের পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি চলতি বছরের নভেম্বরে ৯.৪৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যদিও ব্যাংকগুলোতে নভেম্বরে আমানতের গড় রেট হচ্ছে ৪.৫ শতাংশ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোয় আমানত বেড়েছে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। অথচ আগের জুন প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর আমানত বড়েছে ৭৪ হাজার কোটি টাকা। দেশে বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে মোট অ্যাকাউন্টধারী রয়েছে ১৪.৯৭ লাখ। এসব অ্যাকাউন্টে আমানতের পরিমাণ ১৭.১৩ লাখ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল পাঁচজন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৯৮। এরপর ১৯৯০ সালে কোটিপতি হিসাবধারী হয় ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে দুই হাজার ৫৯৪টি, ২০০১ সালে পাঁচ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে আট হাজার ৮৮৭টি এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে এ রকম আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে তা দাঁড়ায় এক লাখ এক হাজার ৯৭৬। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সেই হিসাবের সংখ্যা ছিল এক লাখ ৯ হাজার ৯৪৬।

দেশে আয়বৈষম্য এখন সকল সময়ের সীমা অতিক্রম করেছে। অর্থনৈতিক সেক্টরে লাগামহীন দুর্নীতি, অনিয়ম, অর্থপাচার ও লুটপাট দেশের অর্থনৈতিক সেক্টরকে সীমাহীন নৈরাজ্যের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অপরাধ করে পার পাওয়া ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি এজন্য কম দায়ি নয়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব, অস্থিরতা ও চলমান সঙ্কট সার্কিক পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। একশ্রেণির রাজনীতিক, আমলা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণেই দেশে এখন কোটিপতির সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। দরিদ্ররা হয়ে পড়েছেন অধিকতর।

তাই এই অশুভ প্রতিযোগিতা থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে হলে দেশে গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই। অন্যথায় এই উপখ্যানের শেষ হবে না।

 

https://www.dailysangram.info/post/543299