১২ ডিসেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ৬:১২

আট বছরে মাত্র ১% দরিদ্র পরিবার সেবা পেয়েছে

স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। ২০১২ সালে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল ৬০ শতাংশ। তা বেড়ে এখন ৬৯ শতাংশ। বড় কোনো অসুখে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে অনেকে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে।

এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি (এসএসকে) বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর লক্ষ্য ছিল সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা পরিবারগুলোকে চিকিৎসায় সহায়তা করা।

২০১৬ সালের মার্চে পরীক্ষামূলকভাবে এই কর্মসূচির কাজ শুরু হয়। গত আট বছরেও তা শেষ করা সম্ভব হয়নি।

এসএসকে কর্মসূচির মূল দায়িত্ব পাওয়া স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, গত আট বছরে টাঙ্গাইল, লক্ষ্মীপুর ও বরগুনা জেলার ১৬টি উপজেলায় নিবন্ধিত হয়েছে দুই লাখ ৯০ হাজার ৪৬৬টি দরিদ্র পরিবার। এর মধ্যে ৫০ হাজার ৮৮৮ জন রোগী চিকিৎসা পেয়েছে। এতে সরকারের ব্যয় হয়েছে ২২ কোটি ৩৯ লাখ ৮২ হাজার টাকা। অর্থাৎ গড়ে জনপ্রতি সরকারের ব্যয় চার হাজার ৪০১ টাকা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা তিন কোটি ১৭ লাখ ৫৭ হাজার। সেই হিসাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় সেবা পেয়েছে ১ শতাংশেরও কম দরিদ্র মানুষ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, কোনো পরিবারের মোট আয়ের ১০ শতাংশ যদি স্বাস্থ্য খাতে চলে যায়, তাহলে তাকে বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয় বলে। সে হিসাবে দেশের ২৪.৪ শতাংশ মানুষ এই বিপর্যয়মূলক ব্যয়ের মধ্যে পড়েছে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আজ মঙ্গলবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস পালিত হচ্ছে।

এবারে দিবসটির প্রতিপ্রাদ্য ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য, কর্মের জন্য সময়’।

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ড. মো. এনামুল হকে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নানা সীমাবদ্ধতার কারণে দীর্ঘ সময় ধরে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চলছে। এই কর্মসূচি এগিয়ে নিতে সরকারিভাবে বড় ধরনের সহায়তা দরকার।’ তিনি বলেন, ‘আশা করছি আগামী জুনের মধ্যে ১৫ লাখ মানুষকে সেবা দিতে পারব। ১১০ রোগে সেবা দিতে স্থানীয় ফার্মেসি, প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোরও সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে।’

সমস্যা অনেক, সমাধান নেই

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরুর আগে জানা দরকার তাতে বাস্তবে কতটা সফল হওয়া যাবে। পরীক্ষামূলক কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য হলো দুর্বল ও সবল দিকগুলো যাচাই করা। স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির পরীক্ষামূলক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করা হয়নি, যার ফলে এখন নানা সমস্যা পাওয়া যাচ্ছে এবং এর সমাধান না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগোচ্ছে না।

তিনি বলেন, যেসব এলাকায় পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হয়েছে, সেখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই। পদ তৈরি করা হয়নি। যাঁরা আছেন তাঁদের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ছে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় অনেক পরীক্ষা সক্ষমতা নেই। অনেক উপজেলায় প্যাথলজি কনসালট্যান্ট নেই, সার্জন নেই, গাইনিকোলজিস্ট নেই। অনেক ওষুধ নেই। ব্যবস্থাপনা উন্নত করা না হলে এই কর্মসূচির অগ্রগতির সম্ভাবনা নেই।

বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে

বিশ্বব্যাংকের সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৫১, যেখানে নেপালের ৫৩, ভারতের ৬১, ভুটানের ৬২, শ্রীলঙ্কার ৬৭ ও মালদ্বীপের ৬৯। অন্যদিকে ৪৫ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের নিচে আছে পাকিস্তান, আর আফগানিস্তানের স্কোর ৩৭।

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায় আমরা অনেক পিছিয়ে। আমার মনে হয়, ২০৩০ সালের আগে সেটি আদৌ অর্জন সম্ভব হবে না। প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব নেবে রাষ্ট্র। সেটা হতে হবে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। কারণ আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় অনেক বেশি। স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে কেউ কেউ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে যে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, সেটা আমরা নিচ্ছি না। প্রাইভেট যে স্বাস্থ্য খাত গড়ে উঠেছে, সেটি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার জন্য অন্তরায়। কারণ এখানে স্বাস্থ্যসেবা রয়েছে কিন্তু তা গ্রহণ করার মতো যে অর্থনৈতিক সংগতি দরকার, সেটা অনেকের নেই। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে আমাদের প্রথমে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। চিকিৎসায় ব্যক্তির নিজস্ব খরচ কমিয়ে আনতে হবে। বিশেষ করে পরীক্ষা ও ওষুধের ব্যবস্থা সরকারি হাসপাতালে করতে হবে।’

নিয়ম-কানুনের বেড়াজালে আটকা আছি

দেশে ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সময়ে তা অর্জন করা সম্ভব কি না—এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘নিদিষ্ট এই সময়ে সব কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই অগ্রগতি হবে। আমাদের নীতিনির্ধারকরা সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য বোঝেন না। একটি হাসপাতাল কিংবা স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিভাবে পরিচালনা করতে হয়, কিভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হয়, তা তাঁরা জানেন না। আমরা নিয়ম-কানুনের বেড়াজালে আটকা আছি। এ ছাড়া অবকাঠামোগত ও দক্ষ জনবলের সংকটও রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্যসেবা অগ্রগতির অনেক ধরনের সমস্যা ও বাধা রয়েছে, তার মধ্যে প্রধান সমস্যা হলো মানসিকতার। কারণ মানসিকভাবেই সঠিক কর্মপন্থা ঠিক করতে পারি না। দ্বিতীয় সমস্যা হলো, আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাতকে কেউ গুরুত্ব দেয় না; সেটি পারিবারিক, ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবেই হোক। এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যকে আমরা অবহেলা করি। স্বাস্থ্য ব্যয়কে আমরা অপচয় মনে করি। আমি বাড়ি-গাড়ি-সম্পদ কিনলে মনে করি ভালো ব্যয়, কিন্তু স্বাস্থ্যের ব্যয়কে আমরা অযথা ব্যয় হিসেবে গণ্য করি।’

ডা. আব্দুল হামিদ বলেন, ‘দেশের স্বাস্থ্য খাত এগিয়ে নিতে হলে স্বাস্থ্যকে এক নম্বরে রাখতে হবে এবং স্বাস্থ্যই প্রথম—এই স্লোগান দিতে হবে। সেই স্লোগান ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবনে যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। আমাদের স্বাস্থ্য খাতে যে বাজেট দেওয়া হয়, তা জনসংখ্যার তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। সুতরাং বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে। আবার বাজেট দেওয়া হলে তা খরচ করা হয় না। দুর্বল ব্যবস্থাপনা, অদক্ষ জনশক্তি, ব্যয়ভীতির কারণে প্রতিবছর বরাদ্দের টাকার বড় অংশ ফেরত যাচ্ছে। সুতরাং স্বাস্থ্য খাতের মান উন্নয়নে বাজেটের টাকা খরচ করতে ভয়ের পরিবেশ দূর করতে হবে। তাহলেই স্বাস্থ্য খাতে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হবে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/12/12/1344800