১২ ডিসেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ৫:৫০

ব্যারিস্টার মইনুলের মৃত্যু : একটি নক্ষত্রের পতন

-ড. মো. নূরুল আমিন

 

প্রথিতযশা আইনজীবী এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন গত ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার মৃত্যুতে দেশ একজন অভিজ্ঞ, দূরদর্শী, নির্লোভ দেশপ্রেমিককেই শুধু হারায়নি একজন অভিভাবককেও হারিয়েছে। আমি মহান আল্লাহর কাছে তার রূহের মাগফিরাত কামনা করছি। দোয়া করছি রাব্বুল আলামিন যেন তার শোকসন্তপ্ত পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনকে তার বিয়োগ-ব্যথা সহ্য করার তাওফিক দেন। দেশ আজ যখন দুর্জন রাজনীতিকদের দুর্বিনীতি লুটপাট, হত্যা-ধর্ষণ, অধিকার হরণ ও দুঃশাসনের লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে এবং নির্বাচনের নামে যাত্রাদলের অভিনয় চলছে তখন ব্যারিস্টার মইনুলের ন্যায় ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, কিন্তু আল্লাহ তাকে নিয়ে গেলেন। আমাদের দেশে সংকট মুহূর্তে মধ্যস্থতা করে সমস্যার সমাধান বাতলানোর মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় কোনো ব্যক্তি নেই। এই অবস্থাতেও ব্যারিস্টার মইনুল বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আস্থাভাজন একজন ব্যক্তি ছিলেন। তার পিতা তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও উন্নতমানের একজন লেখক-কলামিস্ট ছিলেন। তার মৃত্যুর পর জনাব মইনুল ১৯৬৯ সালে ইত্তেফাকের সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনিও পিতার ন্যায় সফল কলামিস্ট, ব্যবস্থাপক এবং সংবাদপত্র শিল্পের দিকপাল ছিলেন।

১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ¯স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি আমাদের অগ্রজপ্রতিম শাহ আব্দুল হান্নানের সহপাঠী ছিলেন। শাহ হান্নান ঐ বছর রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। ব্যারিস্টার মইনুল এবং শাহ হান্নান দু’জনই আমার মুরুব্বী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত বছরের সিনিয়র ছিলেন। হান্নান ভাইয়ের মাধ্যমে তার সাথে আমার পরিচয় এবং সাংবাদিকতা পেশায় ঘনিষ্ঠতা। ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসে পাকিস্তান আর্মির তরফ থেকে অবজারভার হাউজে মেজর সালেক নামে একজন আর্মি অফিসার প্রেস লিয়াজোঁ অফিস খোলেন। এই অফিসে অন্যান্য সম্পাদকদের ন্যায় তাকেও আসা-যাওয়া করতে হতো। একইভাবে জেনারেল রাও ফরমান আলী কর্তৃক তৎকালীন গভর্নর হাউজের দরবার হলে আয়োজিত সভাগুলোতেও তার সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হতো। তিনি অত্যন্ত কড়া ভাষায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিপীড়নমূলক কর্মকা- ও মানবতা বিরোধী তৎপরতার সমালোচনা করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগ টিকিটে তার পৈত্রিক নিবাস পিরোজপুর থেকে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে আরো দু’জন এমপির সাথে তিনিও পদত্যাগ করেন। এরপর তিনি আর কোনো রাজনৈতিক দলে যোগদান করেননি। তিনি এক-এগারোর সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সময় আরেক উপদেষ্টা জেনারেল মতিনসহ দেশকে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের কবল থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা চালান এবং সারা দেশে কয়েক হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়। এর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল আওয়ামী লীগ দলীয়। ঐ সরকারের আমলে বেশ  কিছু মামলার বিচার হয় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিভিন্ন মেয়াদের কারাদ-ে দ-িত হন। তারা প্রমাদ গুণতে শুরু করেন এবং বলে বেড়ান যে, দেশকে বিরাজনীতিকরণের জন্যই তারা এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এর জের এখনো কাটেনি। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি-দুঃশাসন কেয়ারটেকার সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের যৌক্তিকতা ও সত্যতাই প্রমাণ করে। ব্যারিস্টার মইনুল আজ নেই, তার মৃত্যুতে দেশবাসী শোকাভিভূত হলেও সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের তরফ থেকে শোকবাণী প্রেরণের কোনো খবর আমি দেখিনি।

২০১০ সালের দিকে যখন আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার প্রক্রিয়া শুরুর ঘোষণা দেন তখন ব্যারিস্টার মইনুলই প্রথম তার প্রতিবাদ করেন। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, এই বিচার হতে পারে না কেননা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিবেচনায় যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাবাহিনী অথবা তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সদস্য না হলে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে কাউকে গণ্য করা যায় না। জামায়াত নেতারা যুদ্ধাপরাধী নন। ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান পরাজিত সেনাবাহিনীর ৯৪ হাজার সদস্যের মধ্য থেকে তাদের অপরাধের ভিত্তিতে ১৯৫ জন সেনা সদস্যকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির ‘মহানুভবতা’ প্রদর্শনের অংশ হিসেবে তাদের বিচার না করেই পাকিস্তানকে ফেরত দিয়ে দেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার তা মানেনি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য তারা কাঙ্গারু কোর্টে জামায়াত নেতাকর্মীদের ফাঁসি দিয়েছে।

১৯৭১ সালের কথা। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য সচিব রোয়েদাদ খান রাওয়াল পিন্ডির হোটেল ইন্টারকনে সাংবাদিক সম্মেলন ডাকলেন। এই সম্মেলনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃস্থানীয় প্রায় সবগুলো দৈনিক পত্রিকাকেই দাওয়াত পাঠানো হলো। আগস্ট মাসের ৭ এবং ৮ এই দুই দিনই ছিল সম্মেলন। সম্মেলনের প্রথম দিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতির ওপর একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়। এই শ্বেতপত্রে সারা প্রদেশব্যাপী আওয়ামী লীগের হরতাল, অবরোধ, অসহযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞ এবং হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ বিশেষ করে অবাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে তাদের ভাষায় গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়। দ্বিতীয় দিনে আওয়ামী লীগের ৮৭ জন এমএনএকে (Member National Assembly) অপরাধ ক্ষমা করে প্রকাশ্য রাজনীতি করার অনুমোদন দেয়া হয়। উল্লেখ্য যে, এর আগে দেশে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতার জন্য রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রেসিডেন্ট ও সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘোষণা করেন। এই সম্মেলনে যোগদানের জন্য আমাকে দৈনিক পূর্বদেশে প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়। অন্যান্য পত্রিকাসমূহের প্রতিনিধিরা ছিলেন নি¤œরূপ:

১. ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন, সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক।

২. অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, সহকারী সম্পাদক, ডেইলি পাকিস্তান অবজার্ভার।

৩. অধ্যাপক আখতার ফারুক, সম্পাদক, দৈনিক সংগ্রাম।

৪. জনাব বদরুদ্দীন, সম্পাদক, মর্নিং নিউজ।

৫. জনাব মজিবর রহমান খাঁ, সম্পাদক, দৈনিক আজাদ।

৬. জনাব শাহাদাৎ হোসেন, সম্পাদক, দৈনিক পাকিস্তান।

৭. অধ্যাপক খালেদ, সম্পাদক, দৈনিক আজাদী, চট্টগ্রাম।

৮. জনাব আবদুল মালেক, সহকারী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী, চট্টগ্রাম।

নয়জনের এই সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের মধ্যে আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ। তখন ঢাকা থেকে সরাসরি রাওয়ালপিন্ডিতে পিআইএর কোনো ফ্লাইট ছিল না। আমরা যাত্রার আগে ঢাকার কোথাও বসে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার সুযোগ পাইনি। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত নোটিশে তেজগাঁও এয়ারপোর্টে পৌঁছতে হয়েছিল। তথ্য বিভাগ থেকে যার যার অফিসে এয়ার টিকিট পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছিল। ৬ তারিখে আমরা পিআইএর বিমানযোগে বিকেল তিনটায় রওয়ানা হয়ে সাড়ে পাঁচটায় করাচি পৌঁছি। সন্ধ্যায় পিন্ডির উদ্দেশে কোনো ফ্লাইট না থাকায় হোটেল মিডওয়ে হাউজে আমাদের রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করা হয়। হোটেল লাউঞ্জে বসে আমরা নীতিগত অবস্থান নির্ণয় করি এবং ব্যারিস্টর মঈনুলকে প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে মনোনীত করা হয়। ঠিক হয় যে, তিনি সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে বক্তব্য রাখবেন। তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন। তার বক্তব্যের দুটি লাইন আমার এখনো মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, “My brother and Sisters in West Pakistan, Please remember that we want a political Solution, not a military Solution to the problems of East Pakistan. And that Solution must be within the framework of united Pakistan.”

অর্থাৎ আমার পশ্চিম পাকিস্তানী ভাই ও বোনেরা, মনে রাখবেন আমরা পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান চাই সামরিক সমাধান নয়। এবং সেই সমাধান হতে হবে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান কাঠামোর ভেতরে। রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে সামরিক নির্যাতনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করায় পাকিস্তান টেকেনি।

দীর্ঘদিন ব্যারিস্টার সাহেবের সাথে আমার যোগাযোগ অক্ষুণ্ন ছিল। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো এবং তার চেম্বারে মতবিনিময় হতো। ২০২১ সালে ভয়ংকর করোনা রোগে আক্রান্ত হয়ে আমি হাসপাতালে ও বাসায় প্রায় আট মাস শয্যাশায়ী ছিলাম। সুস্থ হবার পর আমাকে আমার মুভমেন্ট সীমিত করতে হয়। এ প্রেক্ষিতে তার সাথে আমার আর দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। তবে আমার বেয়াই (ছেলের শ্বশুর) সোনার বাংলার চেয়ারম্যান জনাব রফিকুন্নবীর মাধ্যমে নিয়মিত তার খোঁজ-খবর পেতাম। সর্বশেষ ডিসেম্বরের ২ তারিখে শুনলাম তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। আমার দুর্ভাগ্য আমি তাকে দেখতে যাইনি। এত তাড়াতাড়ি তাকে হারাব বুঝতে পারিনি। তিনি একজন অসাধারণ গুণী ব্যক্তি ছিলেন। যে দেশ গুণীদের সম্মান করে না সে দেশে গুণীর জন্ম হয় না। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। তার তিরোধান একটি নক্ষত্রের পতন; জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।

https://www.dailysangram.info/post/542986