১১ ডিসেম্বর ২০২৩, সোমবার, ৭:১৩

ডাণ্ডাবেড়ি সভ্য সমাজে চলতে পারে কি

-মুহম্মদ রেজাউল করিম

সরকার যখন কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে তখন নাগরিক অধিকার সঙ্কুচিত হয়। নাগরিকদের দেখা হয় কেবলই সন্দেহভাজন হিসাবে। বাংলাদেশে গত দেড় দশকে নানা কালাকানুন তৈরি হয়েছে। নাগরিক অধিকার সঙ্কুচিত হয়েছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে নাগরিকের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে এবং হচ্ছে। আইনবহির্ভূত অনেক নিষ্ঠুর অমানবিক পদ্ধতি নাগরিকের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে বিরোধী দল ও মত দমন করার উদ্দেশ্যে। ডাণ্ডাবেড়ি এমনই এক অমানবিক, নিষ্ঠুর পদ্ধতি যা বিরোধী দল দমন করার জন্য সরকার বারবার ব্যবহার করছে।

সরকার বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। সর্বশেষ আমরা দেখেছি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়েছে। রফিকুল ইসলাম খান কি কোনো সন্ত্রাসী বা দাগি আসামি?

আধুনিক-উত্তর বিশ্বে এটি একটি অসভ্য ও গর্হিত কাজ। যদিও টোটালিটারিয়ান সরকারের কাছে মানবিকতা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং ক্ষমতা আঁকড়ে রাখাই তাদের মূল উদ্দেশ্য।

অথচ অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ডাণ্ডাবেড়ি পরানো সম্পূর্ণ সংবিধান পরিপন্থী একটি কাজ। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘আইনবহির্ভূত ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির ক্ষতি করা নিষিদ্ধ’। অনুচ্ছেদ ৩৫(৫) অনুযায়ী ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না বা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাবে না বা তার সাথে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না।’ আর সংবিধান হলো বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন ও রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি। যেকোনো আইন বা বিধান সাংবিধানিক কোনো নীতির পরিপন্থী হলে তা অবশ্যই বাতিল বলে গণ্য হয়।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন : জাতিসঙ্ঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ কারাবন্দীদের জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে অনুসৃত যে ন্যূনতম নীতিমালা তৈরি করেছে, সেখানকার ৩৩ নম্বর অনুচ্ছেদে ডাণ্ডাবেড়ি পরানোকে অমানবিক বলা হয়েছে। এ ধরনের অমানবিকতা সভ্য সমাজে চলতে পারে না।

জাতিসঙ্ঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ১৯৪৮ এবং আন্তর্জাতিক বেসামরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ঘোষণাতে বলা হয়েছে, কাউকে কোনো অবস্থাতেই নির্যাতন করা যাবে না। No one shall be subjected to torture or to cruel, inhuman or degrading treatment or punishment. UDHR (1948, art. 5); ICCPR (1976, art. 7)

সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা লঙ্ঘন : ‘ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আসামিকে আদালতে উপস্থাপনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত থেকেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছিলে। ২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি চারজন বিচারাধীন অভিযুক্তকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করার পর আদালত অভিযুক্তদের ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর বিষয়টি কারাবিভাগের ডিআইজির কাছে ব্যাখ্যা দাবি করেন। ওই ঘটনার জন্য আদালতের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চান ডিআইজি প্রিজন তৌহিদুল ইসলাম।’ বিবিসি বাংলা অনলাইন, ১৭ মার্চ ২০১৭

‘পরবর্তীতে একই বছর বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ কোনো আদালতের এজলাসে বিচারাধীন আসামিকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে কাঠগড়ায় তোলা যাবে না মর্মে নির্দেশনা জারি করেন।’ বিবিসি বাংলা অনলাইন, ১৭ মার্চ ২০১৭

সম্প্রতি ‘ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে হাসপাতালের মেঝেতে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে যুবদল নেতাকে’-শীর্ষক প্রতিবেদনসহ এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ২৯ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো: আতাবুল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী। কিন্তু আদালত তার চাওয়া স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি না করে রিট নিয়ে এলে রুল জারি করা হবে মর্মে সিদ্ধান্ত দেন। আদালত বলেন, জঙ্গি সম্পৃক্ততাসহ হিনিয়াস ক্রাইমের (জঘন্য অপরাধের) ক্ষেত্রে সাধারণত অপরাধীকে ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হয়। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের একাধিক সিদ্ধান্তও রয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে ডাণ্ডাবেড়ি পরানো যাবে, সে বিষয়ে গাইডলাইন (নির্দেশিকা) আছে।

সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক মামলা কিংবা তুলনামূলক দুর্বল মামলার বিচারাধীন আসামিকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে কারাগার থেকে আনা-নেয়া করা হচ্ছে। অন্যদিকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুর্ধর্ষ জঙ্গি কয়েদিকেও কেবল এক হাতে হাতকড়া পরিয়ে আদালত চত্বরে চলাচল করাতেও সম্প্রতি দেখা যায়। যদিও সেই ঘটনায় দু’জন জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ‘এমনকি মায়ের লাশের জানাজায় অংশ নিতেও পরতে হচ্ছে ডাণ্ডাবেড়ি। মায়ের মৃত্যুতে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে ডাণ্ডাবেড়িসহ জানাজায় অংশগ্রহণের অমানবিক এমন একাধিক ঘটনায় সারা দেশে বইছে সমালোচনার ঝড়।’ ডয়েচে ভেলে বাংলা, ২২ ডিসেম্বর ২০২২

একনজরে ডাণ্ডাবেড়ির নির্মম শিকার যারা: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপির নেতাকর্মীরাই ডাণ্ডাবেড়ি নামক পাশবিক নির্যাতনের বেশি শিকার। সরকার বিরোধীদের দমন করার জন্য ডাণ্ডাবেড়ি অস্ত্রকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ইতঃপূর্বে এর শিকার হয়েছেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি এ টি এম আজহারুল ইসলাম, অধ্যাপক তাসনীম আলম, মু. সেলিম উদ্দীন, ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, ড. রেজাউল করিম, দেলাওয়ার হোসাইনসহ অনেক সামাজিক, রাজনৈতিক এবং গুরুত্বপূর্ণ সম্মানিত ব্যক্তিকেই এই ডাণ্ডাবেড়ির নৃশংসতার শিকার হতে হয়েছে।

বিশিষ্ট নাগরিক ও আইনবিশেষজ্ঞদের নিন্দা : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, বিচারাধীন বা সাজাপ্রাপ্ত কোনো ক্ষেত্রেই আসামিকে ডাণ্ডাবেড়ি পরানো যাবে না। এটি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। সবচেয়ে বড় আইন হচ্ছে দেশের সংবিধান। সংবিধানে যেটি নিষেধ আছে, তা নিয়ে যদি আইনও থাকে বা যদি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হয় সে আইন বাতিল বলে গণ্য হবে। এসব (ডাণ্ডাবেড়ি) আইন হচ্ছে ‘ব্রিটিশ কলোনিয়াল ল’। ব্রিটিশরা যে আইনগুলো করেছে সেগুলো হলো- শোষণ, শাসন ও দমন-পীড়নের আইন। সেটি তো এখনো চলতে পারে না। এটি সম্পূর্ণ বেআইনি। যারা ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়েছেন তাদের প্রত্যেকের সাজা হওয়া উচিত। তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। সুপ্রিম কোর্টের এ সিনিয়র আইনজীবী আরো বলেন, এক সময় বলা হতো ফাঁসির আসামি, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত দুর্ধর্ষ আসামিদের ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হবে। পরবর্তীতে একটি মামলায় আদালত কর্তৃক এই ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর বিষয়টি নিষেধ করা হয়। বলা হয়, ডাণ্ডাবেড়ি পরানো যাবে না। কারণ এটি একটি নির্যাতন, মধ্যযুগীয় অত্যাচার।

মানবাধিকারকর্মীদের নিন্দা : মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশকেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাবে না কিংবা কারো সাথে কোনোরূপ নির্দয় আচরণ করা যাবে না।’ সে হিসেবেই সংবিধান ও মানবাধিকারের আলোকে চিন্তা করলে, এ ধরনের ব্যবস্থা নিপীড়নমূলক। এটি আইনে অচল। ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর ঘটনাগুলো সংবিধানের পরিপন্থী। এটি আইনের ব্যত্যয়। যারা করেছেন তাদেরকে জবাবদিহিতা বা আইনের আওতায় আনা উচিত।’

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন আরো বলেন, ‘আমরা দেখতে পাই, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিদের কোনোমতে একটি হাতে হাতকড়া পরিয়ে কারাগারের বাইরে তথা আদালতে আনা-নেয়া করা হয়। আর সেখানে সাম্প্রতিক যাদের ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে কারাগারের বাইরে আনা হলো (জানাজায়) তাদের কেউই কিন্তু আদালত কর্তৃক অপরাধী প্রমাণিত হয়নি। বেশির ভাগই রাজনৈতিক নেতাকর্মী। পারিবারিক মৃত্যুর ক্ষেত্রেও জনসম্মুখে দেখা গেল, ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে জানাজার আনুষঙ্গিকতা সারতে হলো। এটি কোনোভাবেই মেনে নেয়ার মতো নয়। এটি সুস্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বাধ্যতামূলক কার্যকরতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, আপিল বিভাগের ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রিম কোর্টের যেকোনো বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধস্তন সব আদালতের জন্য অবশ্য পালনীয় হবে।

প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা একটি ইতিবাচক সংবাদের অপেক্ষায় থাকি। যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাব- ‘শুধু আদালতে নয় সব স্তরে উচ্চ আদালত ডাণ্ডাবেড়ি ও আড়ুয়া বেড়ি পরানোকে নিষিদ্ধ করেছেন।’ সেদিন আমাদের সংবিধানের শাশ্বত বাণী চিরন্তন রূপ পাবে। শুরু হবে নতুন এক যুগের। ভোটের রাজনীতিতে যেকোনো রাজনৈতিক সংগঠনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থন। সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ জনসাধারণের জন্য সৎ, যোগ্য, মেধাবী এবং জনহিতাকাক্সক্ষী প্রার্থীদের বেছে নেয়ার সুযোগ করে দেয়। এতে একটি দেশ সবচেয়ে যোগ্যদের দায়িত্বে ক্রমান্বয়ে উন্নতি ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। বাংলাদেশের চলমান সঙ্কটের পিছনের মূল কারণ হলো গণতন্ত্রের মোড়কে একটি চরম স্বেচ্ছাচারী সরকারব্যবস্থা। বিগত তিনটি নির্বাচনের দু’টিতেই দলীয় সরকারের অধীনে বিরোধী দলের অংশগ্রহণহীন অবস্থায় সরকার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নামে নিজেদের ক্ষমতার মেয়াদ বৃদ্ধি করে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পরিবেশটিকে ধীরে ধীরে হাইব্রিড-ডেমোক্র্যাটিক সিস্টেমে পরিণত করেছে।

তাই, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, জামায়াতের আমির ডা: শফিকুর রহমান, জামায়াত ইসলামী সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সেলিম উদ্দীনসহ বিরোধী দলের সব রাজবন্দীর মুক্তি দাবি করছি। সাংবাদিক, সুশীলসমাজ, বুদ্ধিজীবী, কিংবা মানবাধিকারকর্মী যারাই সরকারের হামলা-মামলা, জেল-জুলুম আর ডাণ্ডাবেড়ি নামক নির্যাতনের ভয়ানক শিকার হয়েছেন তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। অবিলম্বে ডাণ্ডাবেড়ি নামক এই কালা-কানুন বন্ধের দাবি জানাচ্ছি। আসুন, আমরা মানুষ, মানুষের মর্যাদাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরি।

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/797794