৫ ডিসেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ১২:৩৩

ফেক লিংকের ফাঁদ

 

ব্যবসায়ী হাবিব রাজু। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি লিংক নজরে আসে তার। লিংকটিতে লেখা ছিল ‘দ্রুত লোন নিন।’ ভুক্তভোগী লিংকে চাপ দিতেই বন্ধ হয়ে যায় মুঠোফোন। দশ মিনিট পরই মুঠোফোনটি আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়। একঘণ্টা পর হাবিবের মুঠোফোনে আর্থিক সেবা (এমএসএফ) নম্বরে ২৩ হাজার ৪০০ টাকা আসে। পরে একটি বিদেশি নম্বর থেকে তাকে ফোন করে বলা হয়  ঋণের আবেদন করায় ওই টাকা দেয়া হয়েছে। এক সপ্তাহ পর তাকে সুদসহ ৩৯ হাজার ১৫০ টাকা পরিশোধ করতে হবে। লিংকে চাপ দেয়ার পর তার মুঠোফোনে শুধু টাকাই আসেনি। মুঠোফোনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন প্রতারক চক্রের সদস্যরা। নানা হুমকি দিতে থাকেন।

ওই প্রতারক চক্র গত চার-পাঁচ মাসে ব্ল্যাকমেইল করে তার কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় বড় অঙ্কের টাকা। এ ঘটনায় হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন হাবিব। এর আগে একই প্রতারক চক্রের শিকার আরেক ব্যক্তি কাফরুল থানায় একটি মামলা করেন। এই দুই মামলা তদন্তে নেমে গত ২৪শে নভেম্বরে এক চীনা নাগরিকসহ আন্তর্দেশীয় প্রতারক চক্রের ১৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। সংশ্লিষ্টরা বলেন, ফেসবুক বা মুঠোফোনে যদি এই ধরনের লিংক যুক্ত কোনো মেসেজ আসে সেটিকে এড়িয়ে চলতে হবে। 

ভুক্তভোগী হাবিব বলেন, গত মে মাসের ঘটনা এটি। আমি মুঠোফোনে ভিডিও দেখছিলাম। হঠাৎ একটি লিংকে অসাবধানতাবশত চাপ পড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর থেকে ফোন করে আমাকে বলা হয় আপনি ঋণের জন্য আবেদন করেছিলেন। আপনাকে ঋণ দেয়া হয়েছে। এরপর আমার মুঠোফোনে আসা টাকা ফেরত দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রতারকরা তা ফেরত নেয়নি। পরে তারা টাকা চাওয়া শুরু করে। টাকা দিতে না চাইলে তারা আমার মুঠোফোনে থাকা বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর ও ছবি আত্মীয়-স্বজন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। আমার ফোনে থাকা সবকিছু প্রতারক চক্রের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় ভয় পেয়ে যাই। এরপর ব্ল্যাকমেইল করে আমার কাছ থেকে প্রায় ৮ লাখ ৬ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় তারা।

শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নয়, অনেকের মুঠোফোনে দিনে এমন লিংকযুক্ত অসংখ্য খুদে বার্তা আসে। সূত্র জানায়, কিছুদিন ধরে ফেসবুক হ্যাকিংয়ের হার বেড়েছে। এমনকি অনেকের আইডি থেকে অপ্রীতিকর পোস্ট বা স্টোরি শেয়ার করা হচ্ছে মালিকের বিনা অনুমতিতে। এটির কারণ তাদের ফেসবুক আইডিটি স্ক্যামাররা দখল করে নিয়েছে। আইডির মালিক ভুলক্রমে বা লোভে পড়ে স্ক্যামারদের দেয়া লোভনীয় ফিশিং লিংকে ঢুকে পড়েছে। বর্তমান বাংলাদেশে স্কামারদের একটিভ ফিশিং লিংকগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে Dear you passed the interview. An average of 2,000 Tk can be Received every day, contact: https://wa.me/” মোবাইলে ব্যবহৃত সিমে আসা মেসেজটি অনেকটা এভাবে থাকে সঙ্গে একটি মোবাইল নাম্বার যুক্ত থাকে। এই লিংকে প্রবেশ করলে অনেক সময় কোন টেলিগ্রাম গ্রুপে নিয়ে যাবে বা কোনো তথ্যই আসবে না। অথচ এসকল লিংকে ঢোকা মাত্রই স্কামার ফেসবুক আইডিটি তাদের দখলে নিয়ে যায়।

ডিবি’র অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ এ ঘটনায় বলেন, ‘দ্রুত লোন নিন’ নামের অ্যাপ ফেসবুকে ও ইউটিউবে বিজ্ঞাপন দিয়ে ঋণ দেয়ার নামে প্রতারণা করে। এরপর ‘ফিশিং’ লিংকের মাধ্যমে গ্রাহকের মুঠোফোনের যাবতীয় তথ্য হাতিয়ে নেয় তারা। পরে ব্ল্যাকমেইল করে তার কাছে চাওয়া হয় কয়েক গুণ বেশি টাকা। এভাবেই গত ৬ মাসে ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্র। জামানত ছাড়া ঋণ দেয়ার কথা বলে তারা গত দুই বছরে দেড় হাজার বাংলাদেশির কাছ থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। পরে এ টাকা বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, প্রতারকরা হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন গ্রুপে এড হতে বলে, তাদের একটা প্রাইভেট গ্রুপ থাকে অনেকে সেই গ্রুপে এড হয়। প্রথমে অনলাইনে তাদের কিছু কাজ দিয়ে অল্প টাকা পেমেন্ট করে। পরবর্তীতে প্রতারক চক্র ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করতে বলে। বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করার পরে ভুক্তভোগীরা বুঝতে পারে তারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। 

মানুষকে সতর্ক করে সিআইডি’র বিশেষ পুলিশ সুপার আরও বলেন, যে লিংকগুলো পাঠাচ্ছে সেই জায়গায় ইনভেস্ট থেকে শুরু করে কোনো ধরনের প্রলোভনে পা দেয়া যাবে না। এগুলো একটি ফাঁদ এবং বর্তমানে প্রতারণার একটি বড় কৌশল।

https://mzamin.com/news.php?news=86781