৫ ডিসেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ১২:৩১

বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস আজ

চরম হুমকিতে জীবনের উৎস মাটি ও পানি

 

মানুষসহ পৃথিবীর সব প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবনে মাটি ও পানির গুরুত্ব অপরিসীম। জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-এফএও’র সাবেক মহাপরিচালক জোসে গ্রাজিয়ানো দা সিলভা-এর মতে, মাত্র ১ সেন্টিমিটার মাটি গঠন হতে প্রায় এক হাজার বছর সময় লাগে। পৃথিবীতে মানুষের জন্য মোট ব্যবহারযোগ্য স্বাদু পানির সরবরাহ প্রায় দুই লাখ ঘনমিটার, যা মোট মিঠাপানির সম্পদের ১ শতাংশেরও কম। অর্থাৎ মানুষ ও প্রাণির বেঁচে থাকার জন্য মাটি ও পানির চাইতে বড় কিছু নেই। অথচ এই মাটি ও পানির প্রতিই মানুষের সবচেয়ে বেশি অবহেলা। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে পানিতে লবণাক্ততার কারণে আশানরূপ ফসল হয় না। বরেন্দ্র এলাকায় পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে দিনের পর দিন। এ ছাড়া কলকারখানার বর্জ্য দেদার ডোবানালা, খালবিল এবং নদ-নদীতে পড়ে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। বিষাক্ত পানি মাটির সাথে মিশে উর্বরতা নষ্ট করছে। ওই মাটিতে ফলানো শাকসবজিসহ অন্যান্য ফসলে বিষাক্ততা ছড়িয়ে পড়ছে। যা খেয়ে অসুস্থ হতে হচ্ছে মানুষকে। সবকিছু মিলে মাটি ও পানি এখন হুমকিতে। ফলে হুমকিতে পড়েছে মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা ও অন্যান্য প্রাণিকুল। এমন বাস্তবতায় আজ (৫ ডিসেম্বর) বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস। ঢাকাসহ সারা দেশে দিবসটি নানা আয়োজনে পালন করবে কৃষি মন্ত্রণালয় অধীনস্থ সংস্থা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই)।

এ বিষয়ে এসআরডিআই মহাপরিচালক মো: জালাল উদ্দীন বলেন, মাটির পুষ্টি ও জৈব পদার্থ অপচয়, মাটির ক্ষয়, অম্লীয়করণ, লবণাক্ততা, নদীভাঙন, জলাবদ্ধতা, নগরায়ন, মাটি ও পানির দূষণ, খরা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্টকারী নানাবিধ ক্রিয়াকর্মের কারণে প্রতিনিয়ত ভূমির অবক্ষয় ঘটছে। মানুষের কার্যক্রমের ফলে ৭০ শতাংশের বেশি বৈশ্বিক ভূমি ইতোমধ্যে প্রাকৃতিক অবস্থা থেকে রূপান্তিরিত হয়েছে, যা পরিবেশের ব্যাপক অবক্ষয় এবং উল্লেখযোগ্যভাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। তিনি জানান, বাংলাদেশে অবক্ষয়প্রাপ্ত ভূমির পরিমাণ মোট ভূমির প্রায় ৭৬ শতাংশ। বিগত ২০০০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২৭ হাজার হেক্টর পরিমাণ অবক্ষয় ঘটেছে। মাটিতে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের অপচয়ের কারণে প্রায় ৭৫ শতাংশ জমির মাটি লক্ষণীয়ভাবে তার উর্বরতা হারিয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার বলেন, মাটি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। ফলে পৃথিবীতে জীবন রক্ষা হয়। পুষ্টিচক্র, উদ্ভিদের অবলম্বন, জীবজগতের বাসস্থান, মানুষের খাদ্য, জ্বালানি ও বস্ত্রনির্মাণের তন্তুর জোগান, পানি পরিশুদ্ধকরণ, বিষাক্ত দ্রব্যের পরিশোষণ, কার্বন সঞ্চায়ন, বনা নিয়ন্ত্রণ, ভেষজ ও কৌলিক সম্পদের উৎস এবং মানুষের কৃষি গঠনে মাটির অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে। তেমনিভাবে পুষ্টিচক্র, মানুষের স্বাস্থ্য ও পয়নিষ্কাশন, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব হ্রাস, তাপ নিয়ন্ত্রণ, কৃষি ও জীবিকা উপার্জন, জলজ জীবের বাসস্থান, রাসায়নিক বিক্রিয়া, ক্ষয়রোধ, শিল্পকারখানার বিভিন্ন ক্রিয়াকর্ম, জলবিদ্যুৎ তৈরি, কৃষি ও আনন্দ উদযাপনের নানা ক্রিয়াকর্ম সম্পন্ন করার কথা পানি ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। তিনি বলেন, কৃষিকাজে সেচের পানি হিসাবে, কলকারখানায় ও গৃহস্থালির কাজে এবং জলাধার হিসেবে ক্রমাগতভাবে পানির বর্ধিষ্ণু ব্যবহার পৃথিবীর পানি সম্পদের ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করছে। দেশের নানান স্থানে ভূগর্ভের পানি নেমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। বর্তমানে ঢাকার ভূগর্ভের পানির উচ্চতা গড়পড়তা ৭৮ মিটার, যা আগামী ১০-১২ বছরে ১৩২ মিটার পর্যন্ত নেমে যেতে পারে। ভূগর্ভের পানির এই ক্রমাগত উত্তোলনের ফলে সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জের মতো শিল্প এলাকাগুলোতে ব্যাপকভাবে ভূমি অবনমনের ঘটনা ঘটতে পারে বলেও আশঙ্কা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (গাজীপুর) মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: মিজানুর রহমান বলেন, মাটি এবং পানি দু’টি সবচেয়ে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য এবং বিশ্বের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য সম্পদ। পানি হলো আবহাওয়াযুক্ত খনিজ পদার্থ, জৈব পদার্থ, বায়ু এবং পানি যা সব জীবন্ত প্রাণীকে টিকিয়ে রাখে। মাটি এবং পানি একসাথে বিশ্বের প্রায় ৯৫ ভাগ মানুষের খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করে। তার মতে, ২০০৫-২০০৭ সালের তুলনায় ২০৫০ সালে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন ৬০-১১০ শতাংশ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম সাইফুল্লাহর মতে, পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশ মিঠাপানি ব্যবহার করা হয় কৃষিকাজে। বিশ্বজুড়ে বেশির ভাগ কৃষিকাজ সেচের ওপর নির্ভরশীল, যেখানে ক্ষেতগুলোকে পানিতে ডুবিয়ে ফেলা হয় এবং পানির স্বল্প একটা অংশ উদ্ভিদ গ্রহণ করে আর বেশির ভাগ অপচয় হিসেবে কৃষিজমির সার, কীটনাশক ধুয়ে নিয়ে খাল, নদী পেরিয়ে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রকে দূষিত করে।

এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক বলেন, প্রতি বছর আবাদযোগ্য জমি হ্রাস, প্রাকৃতিক দুর্যোাগ, বন্যা, খরা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত এবং সর্বোপরি ক্রমবর্ধমান বিশাল জনগোষ্ঠীর বাড়তি চাপ, বর্তমান কৃষির জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। এসআরডিআই-এর গবেষণা প্রতিবেদনের সূত্র ধরে মন্ত্রী বলেন, প্রতি বছর ০.৭৩ শতাংশ হারে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ ভূমির মাটির উর্বরতা লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। কৃষিকাজে সেচের পানি হিসেবে কলকারখানায় ও গৃহস্থালি কাজে এবং জলাধার হিসেবে ক্রমাগতভাবে পানির বর্ধিষ্ণু ব্যবহার পৃথিবীর পানিসম্পদের ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, মাটি ও পানির এসব প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করে কৃষি মন্ত্রণালয় আধুনিক কৃষিনীতি প্রবর্তন, সংরক্ষণমূলক মৃত্তিকা প্রযুক্তি উদ্ভাবন, খামার যান্ত্রিকীকরণ, পানি সাশ্রয় সেচব্যবস্থার প্রয়োগ এবং উত্তম কৃষিচর্চার প্রসারের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখেছে। পানি ও ভূমিসম্পদ অবক্ষয় রোধ করে ভবিষ্যতে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রাখা বর্তমানে কৃষির অন্যতম চ্যালেঞ্জ।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেন, মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষিই মূল চাবিকাঠি। বর্তমান সরকার কৃষি খাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কৃষিবান্ধব নীতি ও উদ্যোগ গ্রহণ করার কারণে দেশ দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পর্ণতা লাভ করেছে। কিন্তু কৃষির উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে আমাদের সামনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এক দিকে আবাদযোগ্য জমি ক্রমাগত কমে যাচ্ছে, অন্য দিকে ক্রমবর্ধমান বিশাল জনগোষ্ঠীর বাড়তি চাপ। এসব চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে আমাদের এগোতে হবে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে মাটি ও মাটির গুরুত্ব সমধিক। অযতœ ও অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে মাটি ও পানি নানাভাবে অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছে। এসব সঙ্কট থেকে উত্তরণে আমাদের বিজ্ঞানী ও কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীদেরকে টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

মৃত্তিকা বিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশের মাটির স্বাস্থ্য ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। মাটিতে রাসায়নিক উপাদানের পরিমাণ কমে আসছে। মাটির যত্ন না নেয়ার কারণে এমন পরিস্থিতি দেখা দিচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে খাদ্য উৎপাদনে। তারা বলছেন, সারা দেশের মাটিতেই প্রয়োজনের তুলনায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, দস্তা ও বোরনের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া অঞ্চলভেদে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজের ঘাটতি আছে। দেশের প্রায় সব উপজেলার মাটি পরীক্ষা করে এসআরডিআই এ তথ্য পেয়েছে।

টাঙ্গাইল জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মৃত্তিকা বিজ্ঞানী ড. উৎপল কুমার এসআরডিআই’র নিউম্যান প্রজেক্ট-২০২২-এর সূত্রে জানান, ২০২১-২২ অর্থবছরে সার বাবদ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ফলে কৃষির অতিমূল্যবান এই উপাদান অত্যন্ত সাশ্রয়ী মূল্যে কৃষকের হাতের নাগালে থাকায় কৃষক সারের অতিরিক্ত ব্যবহার করছেন। এসআরডিআরই’র এই প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, এক দিকে সার ব্যবহারে অপচয় হচ্ছে প্রায় ১৫-২০ ভাগ, অন্য দিকে ফসলের ফলন কমছে প্রায় ২০-৩০ ভাগ। তাই স্মার্ট মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার জন্য স্মার্ট সার সুপারিশ কার্ড প্রবর্তন করে মাটির উর্বরতা মান অনুসারে সুষম মাত্রায় সব কৃষককে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এতে সার ব্যবহারে ১৫-২০ ভাগ অপচয় কমবে। উৎপাদন বাড়বে ২০-৩০ ভাগ। সারা দেশে এই পদ্ধতির প্রচলন শতভাগ নিশ্চিত করা গেলে সরকারের শুধু সার বাবদ সাশ্রয় হবে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। আর খাদ্য উৎপাদন বাড়বে প্রায় এক কোটি মেট্রিক টন, যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।

 

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/796476