৪ ডিসেম্বর ২০২৩, সোমবার, ১০:৩২

ডলার-সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় অনিশ্চয়তা-উদ্বেগে ব্যবসায়ীরা

 

ফাইল ছবিকরোনার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ডামাডোল। অর্থনীতির না শুকানো ক্ষতে নতুন করে আঁচড় দেয় এই যুদ্ধ, যার প্রভাবে হঠাৎ করে বেড়ে যায় আমদানি ব্যয়। এতে টান পড়ে ডলারে। সেই যে ডলার-সংকটের শুরু, তা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। তীব্র ডলার-সংকটে কমাতে হয়েছে আমদানি, যার প্রভাবে রপ্তানিতেও চলছে মন্দা। অর্থনীতি যখন নানামুখী সংকটে বিপর্যস্ত, ঠিক সে সময়ে দেশে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা।

এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা হরতাল-অবরোধে স্থবিরতা চলছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। একটার পর একটা ইস্যুর মুখে কুলিয়ে উঠতে না পারা ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা এখন শঙ্কিত টিকে থাকা নিয়ে। 

মেডিকেল যন্ত্রপাতি উৎপাদন খাতের বড় উদ্যোক্তা প্রমিস্কো গ্রুপ। সরকারের কাছে পণ্য বিক্রি করে এখন তহবিল-সংকটে তারা। কারণ, বিক্রীত পণ্যের বিল পাচ্ছে না। এ বিষয়ে গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মৌসুমী ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সেই করোনার সময় সরকারকে চিকিৎসা সামগ্রী দিয়েছি। এখনো একটির বিলও বুঝে পাইনি। অথচ ব্যাংকঋণ নিয়ে এসব সরঞ্জাম তৈরি করেছিলাম। এ জন্য প্রতি মাসে ব্যাংকের সুদ গুনতে হচ্ছে; পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব তহবিলও ফুরিয়ে আসছে। 

প্রমিস্কো গ্রুপের মতো এ ধরনের অসংখ্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে, যারা নানামুখী সংকটে ধুঁকছে। ব্যবসায়ীদের বড় অংশ ভুগছে ডলার-সংকটের কারণে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পেরে। এলসি খোলার জন্য বড় বড় শিল্প গ্রুপও এখন ব্যাংকের এমডিদের কাছে ধরনা দিচ্ছে। এলসি জটিলতায় অনেক কমে গেছে আমদানি। তথ্য-উপাত্ত বলছে, গত অর্থবছরের নভেম্বরে যেখানে সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল, এ অর্থবছরের নভেম্বরে তা নেমে গেছে ৪ দশমিক ৯২ বিলিয়নে। 

আমদানি পণ্য ও সরবরাহ ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র রাজধানীর মৌলভীবাজার। চাল, ডাল, তেল, চিনি, মসলা, মনিহারি, ফলমূলসহ প্রায় সব ধরনের পণ্য আমদানি হয়ে এখান থেকেই সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। ব্যবসার হালচাল জানতে চাইলে মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আজমল হোসেন বাবলু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বলতে পারেন, ব্যবসা এখন জিরো টলারেন্সের মধ্যে আছে।’ তিনি এটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘ডলার-সংকটে ব্যবসা এখন কঠিন সময় পার করছে। আগে এক বছরে যেখানে আমি নিজে দুই শর বেশি এলসি খুলতে পারতাম, এখন তা করেছি মাত্র ১৮টি। তাহলে বুঝতেই পারছেন, এলসির হার কত? আমি যে ব্যাংকের নিয়মিত গ্রাহক, সেই ব্যাংক ছয় মাস ঘুরিয়েও আমাকে একটি এলসি খুলে দিতে পারেনি। পরে আমি ব্যাংক বদল করেছি। এনবিআর শুধু রাজস্ব আদায়ে মরিয়া, অথচ ব্যবসা আছে কি না, তা দেখছে না।’ 

আমদানিতে কড়াকড়ির ফলে আমদানিনির্ভর শিল্পগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যেমন সম্প্রতি কমে গেছে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি। অনেক শিপব্রেকিং ইয়ার্ডও বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া বড় ধাক্কা খেয়েছে সিমেন্ট খাতও। এ পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রি কমেছে ৩০-৪০ শতাংশ। 

উদ্যোক্তারা জানান, এমএস (মাইল্ড স্টিল) রডের বিক্রি ৬০-৭০ শতাংশ কমে গেছে। বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, সিরামিক পণ্যের সরবরাহ ৩০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। 

আমদানিতে ডলার-সংকটের কোপ পড়ায় রপ্তানিও এখন শ্লথ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, গত অক্টোবর মাসে ৩ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা ২৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। আগের বছরের একই মাসে মোট ৪ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। রপ্তানি যখন এমনিতেই চ্যালেঞ্জের মুখে, তখন নতুন করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও মানবাধিকার ইস্যুতে রীতিমতো চোখ রাঙাচ্ছে আমেরিকা-ইইউভুক্ত দেশগুলো। 

এদিকে ব্যাংকগুলো ভুগছে তারল্যসংকটে; পাশাপাশি ডলার-সংকট তো আছেই। তারল্যসংকটে পড়া ব্যাংকগুলো চড়া সুদের কলমানিতে ধার করছে প্রতিনিয়ত। টাকার অভাবে অনেক ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারছে না। ব্যাংকগুলোর তারল্য-চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক গত সপ্তাহের বুধবার এক দিনেই কয়েকটি ব্যাংককে ১৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকা ধার দিয়েছে। নিলামের মাধ্যমে সাড়ে ৯ শতাংশ সুদে এ টাকা ধার দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

এদিকে সরকারে রাজস্ব ঘাটতিও দিন দিন বাড়ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য সন্তোষজনক না থাকায় সরকার ঠিকমতো রাজস্ব আদায় করতে পারছে না। অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রাজস্ব ঘাটতি ১৯ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। যতই দিন যাচ্ছে, এ ঘাটতি বড় হচ্ছে। 

ঠিকমতো রাজস্ব আয় না হওয়ায় খরচ মেটাতে সরকারের তহবিলে টান পড়েছে। তহবিল জোগাতে ব্যাংক থেকে টাকা নিচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার ৩১ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গতকাল রোববারও সরকার বেশি সুদ দিয়ে ৫ হাজার ১৪২ কোটি টাকা ধার করেছে। 

https://www.ajkerpatrika.com/306218