৪ ডিসেম্বর ২০২৩, সোমবার, ১০:২৮

অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে বিদেশী ঋণ

- দেড় দশকে বেড়েছে সাড়ে ৭৩ বিলিয়ন ডলার

 

বৈদেশিক মুদ্রায় দায় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। গত দেড় দশকে বিদেশী ঋণ ২৯০ শতাংশ বেড়ে ৯ হাজার ৮৯৪ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ৯৯ বিলিয়নে উন্নীত হয়েছে। যেখানে স্বাধীনতার ৩৭ বছরে (১৯৭২-২০০৯ পর্যন্ত) বিদেশী ঋণ বেড়েছিল আড়াই হাজার কোটি ডলার, সেখানে গত এক যুগে বেড়েছে ৭ হাজার ৩৫৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা সাড়ে ৭৩ বিলিয়ন ডলার। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থাৎ ৯ মাসে (সেপ্টেম্বর-জুন) বিদেশী ঋণ বেড়েছে প্রায় ৬০২ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার, বা ৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়েই বিদেশী ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে সম্প্রতি স্বল্প মেয়াদি ঋণ বেশি বাড়ায় বিদেশী দায়দেনার বহির্মুখী প্রবাহ আকস্মিকভাবে বাড়তে পারে। তাদের মতে, যে হারে বিদেশী ঋণ বাড়ছে তা চলতে থাকলে সামগ্রিক আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিদেশী ঋণের সুদ আপাতদৃষ্টিতে সস্তা মনে হলেও ডলার ও টাকার বিনিময় হারের হিসাব করলে কার্যকর সুদহার অনেক বেড়ে যাবে। সেই সাথে দেশের ওপর বাড়বে সুদসহ বিদেশী ঋণের দায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সামগ্রিক বিদেশী ঋণ ছিল ১৪ কোটি ৬৫ লাখ মার্কিন ডলার, গত ২০০৯ সাল পর্যন্ত তা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৫৩৭ কোটি মার্কিন ডলার। স্বাধীনতার ৩৭ বছরে দেশে সামগ্রিক বিদেশী ঋণ বেড়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা বেড়ে হয়েছে ৯ হাজার ৮৯৩ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। এতে দেড় দশকে বিদেশী ঋণ বেড়েছে ৭ হাজার ৭৫৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ দেড় দশকে বিদেশী ঋণ বেড়েছে প্রায় ২৯০ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর শেষে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে সামগ্রিক বিদেশী ঋণ ছিল ৯ হাজার ২৯১ কোটি মার্কিন ডলার। মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে জুনে এসে তা বেড়ে হয়েছে ৯ হাজার ৮৯৩ কোটি ৫৫ লাখ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ ৯ মাসের ব্যবধানে বিদেশী ঋণ বেড়েছে ৬০২ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১১৫ টাকা হিসেবে)।

সামগ্রিক ঋণের মধ্যে ৯ মাসে সরকারি খাতে বিদেশী ঋণ বেড়েছে ৭৮৩ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। গত সেপ্টেম্বরে সরকারের বিদেশী ঋণ ছিল ৬ হাজার ৭৫০ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার, গত জুনে এসে তা বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ৬৬৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। ৯ মাসে সরকারি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ।

এ দিকে ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ বাড়েনি। বরং কমে গেছে। সেপ্টেম্বরে যেখানে ছিল ২ হাজারর ৫৪০ কোটি মার্কিন ডলার, সেখানে জুনে এসে হয়েছে ২ হাজার ২২৫ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আগে বেসরকারি উদ্যোক্তারা শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য বিদেশী ঋণ নিলে তিন মাস পর হতেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হতো। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ কমাতে ২০১৪ সালে এমন নির্দেশনা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যবসায়ীদের চাপে এ নির্দেশনা সংশোধন করে নীতিমালা শিথিল করা হয়। এখন বিদেশী ঋণ পরিশোধের সময় বাড়িয়ে সর্বোচ্চ এক বছর সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, কিস্তির পরিবর্তে একবারে পরিশোধ করলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর কিছুটা চাপ বাড়লেও স্বস্তিতে থাকবেন উদ্যোক্তারা। তারা বাড়তি সময় পাবেন ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, সাধারণত ব্যবসায়ীদের বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ এনে তা সুদে-আসলে বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়। এ ঋণের সুদ আপাতত কম মনে হলেও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়জনিত কারণে মেয়াদ শেষে সুদহার বেড়ে যায়। যেমন, প্রতি ডলার ৮৪ টাকার বিনিময় মূল্যের সময় একজন ব্যবসায়ী ঋণ নিয়েছিলেন। এখন হয়েছে ১১৫ টাকা। যেহেতু বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়, তাই মুদ্রার বিনিময় মূল্যের কারণে প্রকৃত সুদহার অনেক বেড়ে গেছে। তবে মূলধনী যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ নিলে প্রকৃত অর্থে লাভ হয়। কিন্তু বৈদেশিক ঋণ এক বছরের বেশি সময়ের জন্য নিলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ বিডার কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এ অনুমোদনের ঝামেলা এড়াতে উদ্যোক্তারা স্বল্প মেয়াদেই বেশি হারে বৈদেশিক ঋণ নিচ্ছেন, এতে বৈদেশিক মুদ্রার দায় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এক দিকে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, অপর দিকে বৈদেশিক ঋণের বাড়তি দায় পরিশোধ করতে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ বেড়ে যাবে। এমনিতেই টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে, সামনে ডলারের বিপরীতে এ অবমূল্যায়ন আরো হবে অর্থাৎ টাকার মান আরো কমে যাবে। সেক্ষেত্রে একই পণ্য কিনতে বাড়তি ব্যয় করতে হবে। অপর দিকে টাকা ডলারের বিনিময় হারের কারণে বৈদেশিক দায় পরিশোধ করতেও বেশি ব্যয় করতে হবে। সবমিলেই লেনদেনের ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা।

 https://www.dailynayadiganta.com/last-page/796239