৪ ডিসেম্বর ২০২৩, সোমবার, ১০:২২

ধারদেনা করে চলছে দেশের ব্যাংকিংখাত

দেশের ব্যাংকখাতে তারল্য সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর তারল্য চাহিদা মেটাতে এক দিনে ১৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকা ধার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিলামের মাধ্যমে গত বুধবার এই টাকা ধার দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এতে সুদের হার ছিল সাড়ে ৯ শতাংশ। অনেক ব্যাংক ঋণের অর্থ আদায় করতে পারছে না। আমানতের সুদ হার বাড়িয়েও সংকট কাটছে না ব্যাংকগুলোতে। ইসলামি ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি তারল্য সংকটে ভুগছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকে গত বুধবার বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য রেপো, লিকুইডিটি সাপোর্ট সুবিধা, স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি এবং শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর জন্য ইসলামিক ব্যাংকস লিকুইডিটি সুবিধার (আইবিএলএফ) নিলাম অনুষ্ঠিত হয়।

এই নিলামে এক দিন মেয়াদি রেপো সুবিধার আওতায় একটি ব্যাংক ২৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা, সাত দিন মেয়াদি রেপো সুবিধার আওতায় ১৮টি ব্যাংক ও ২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা, এক দিন মেয়াদি লিকুইডিটি সাপোর্ট সুবিধার আওতায় ১৩টি প্রাইমারি ডিলার ব্যাংক মোট ৭ হাজার ২৩৬ কোটি টাকার বিড বা দরপ্রস্তাব দাখিল করে।

এ ছাড়া এক দিন মেয়াদি স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি হিসেবে একটি ব্যাংক ৫০ কোটি টাকার দরপত্র এবং ১৪ দিন মেয়াদি ইসলামিক ব্যাংকস লিকুইডিটি সুবিধার আওতায় একটি ব্যাংক ১০০ কোটি টাকার দরপ্রস্তাব জমা দেয়। নিলাম কমিটি সব দরপ্রস্তাবই গ্রহণ করে। ফলে রেপো, লিকুইডিটি সাপোর্ট সুবিধা, স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি ও আইবিএলএফের আওতায় সব মিলিয়ে ১৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বার্ষিক সুদের হার হচ্ছে ৭ দশমিক ৭৫ থেকে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত।  সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে মোটা অংকের টাকা ঋণ নেয়ার কারণেই দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট প্রকট হচ্ছে। এর কারণে অনেক ব্যাংক তাদের চাহিদা মেটাতে অন্যদের কাছ থেকে ধার করে চলছে।

এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকও বড় অঙ্কের ধার দিচ্ছে। অনেক ব্যাংক ঋণের অর্থ আদায় করতে পারছে না। একই সঙ্গে আমানতের পরিমাণও আগের তুলনায় কমছে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনতেও ব্যাপক পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ঋণ নিলে তারল্য সংকট আরো বাড়তে পারে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা।

চলতি অর্থবছরের অক্টোবর শেষে ব্যাংকখাতে সরকারের ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৯৩ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে খাতটিতে সরকারের ঋণ ছিল দুই লাখ ৮৯ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ সময়ে ব্যাংকখাতে সরকারের ঋণ বেড়েছে এক লাখ তিন হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ৩১ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। একই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে পরিশোধ করেছে ৩২ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই সময়ে সরকার ঋণ পরিশোধ করেছে বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার যে ঋণ নিয়েছে চলতি বছরের জুন শেষে তার স্থিতি ছিল এক লাখ ৫৭ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। আর অক্টোবর শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকে ৩২ হাজার ৭৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।

 দেশে চলমান তারল্য সংকটের কারণে মূল্যস্ফীতিও।  প্রথাগত মুদ্রানীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোয় সুদহারসহ অর্থনীতির সব কাঠামোই বাজারভিত্তিক। কিন্তু আমাদের দেশে সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত। উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি প্রায় শতভাগ ব্যাংকনির্ভর। আমাদের অর্থনীতির এখনো ৬০ শতাংশের বেশি ব্যাংকের আওতার বাইরে।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনীতির অন্য সব উপাদানের ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখে কেবল সুদহার বাড়ানোর পদক্ষেপ এ দেশে কার্যকর হবে না। বাজারে অর্থের প্রবাহ কমানোর যে উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছে, তাতে এসএমই, কৃষিসহ উৎপাদনশীন খাতই সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেসব প্রভাবশালী ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা বের করে নিচ্ছেন, তাদের ওপর মুদ্রানীতির কোনো প্রভাব পড়বে না। 

এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নীতি সুদহার করিডোরের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) সুদহার ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে নীতি সুদহার করিডোরের নি¤œসীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) সুদহার ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে পুনর্র্নিধারণ করা হয়। নীতি সুদহার বাড়ানোয় দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোকে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশি সুদে অর্থ ধার করতে হচ্ছে।

অর্থের সরবরাহ হ্রাসের উদ্দেশ্য থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ প্রজ্ঞাপন জারি করলেও এরই মধ্যে বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। সুদহার বেশি হওয়া সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আগের চেয়ে বেশি অর্থ ধার করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৪ অক্টোবর নীতি সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্তের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দৈনিক ধারের পরিমাণ সর্বোচ্চ ১০ হাজার কোটি টাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে ব্যাংকগুলোর নেয়া ধারের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েছে। ২৫ অক্টোবর দেশের ইতিহাসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ ধার নেয় ব্যাংকগুলো। ওই দিন ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা। এরপর ২৬ অক্টোবর ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ ১৪ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকায় নেমে আসে। ২৯ অক্টোবর ধারের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। তবে গত ৩০ অক্টোবর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধারের পরিমাণ ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ছিল বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

জানা গেছে সরকার তার বাজেট ঘাটতি মেটাতে প্রতিদিনই ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিচ্ছে। এতে করে একদিকে ব্যাংকিংখাতে তারল্য সংকট প্রকট হচ্ছে। অন্যদিকে দেশের বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে। এতে করে দেশের তেমন কোন কর্মসংস্থান হচ্ছে না। এনিয়ে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও কোন কাজে আসছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই চলমান তারল্য সংকট কাটাতে আমানতের সুদ হার বাড়িয়েছে। কিন্তু তার পরেও এ সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলো ধারদেনা করে চলতে বাধ্য হচ্ছে।

দেশের প্রায় সব কয়টি ব্যাংকই তারল্য সংকটে রয়েছে। কিন্তু দেশের সব কয়টি ইসলামি ব্যাংকই তারল্য সংকটে রয়েছে। ইসলামি ব্যাংকসহ শরীয়াহ ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ বন্ধ রয়েছে। এতে করে দেশের এক ধরনের বিনিয়োগ স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এনিয়ে সরকার নানা উদ্যোগহ নিলেও কোন কাজে আসছে না।

https://www.dailysangram.info/post/542346