৩ ডিসেম্বর ২০২৩, রবিবার, ৮:৪৭

অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ : ২৭১১ প্রার্থীই প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদ নিয়ে নির্বাচন করছেন

-আসিফ আরসালান

প্রতিবারের মতো আজকেও বাংলাদেশের রাজনীতি বিশেষ করে নির্বাচনী রাজনীতি নিয়ে লিখবো। কিন্তু গত বুধবার ২৯ নভেম্বর একটি বিরাট ঘটনা ঘটে গেছে। যেটাকে বলা যায় রীতিমত নক্ষত্রের পতন। আমেরিকার লম্বা সময়ের জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকারী কূটনীতিক ড. হেনরি আলফ্রেড কিসিঞ্জার ১০০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এত বড় মাপের নেতাদের মধ্যে খুব কম ব্যক্তিরই শতায়ু হওয়ার সৌভাগ্য হয়। ড. কিসিঞ্জারের সেই বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল। ড. কিসিঞ্জার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেও বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠির নিকট অতি পরিচিত একটি নাম। তিনি কত পরিচিত তার একটি নমুনা দিচ্ছি। 

আমার বাড়ি বগুড়া জেলায়। বগুড়ার একটি উপজেলা, যেটি গ্রামাঞ্চল, সেখানে বিশেষ একটি কাজে প্রায় ২০ বছর আগে গিয়েছিলাম। দুটি পরিবারের মধ্যে সেখানে মনোমালিন্য চলছে। আমাকে মধ্যস্থতা মেনে এক পক্ষ অপর পক্ষের সাথে আলোচনায় বসতে চাচ্ছিল না। কারণ জানতে চাইলে প্রথম পক্ষ বলল যে ওদের (অপর পক্ষ) মাথায় আছে শুধু কিসিঞ্জারি বুদ্ধি। এখানে কিসিঞ্জারি বুদ্ধি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু যে অর্থেই ব্যবহার করা হোক, একজন গ্রামবাসীর মুখে কিসিঞ্জারি বুদ্ধি শুনে বিলক্ষণ বুঝতে পারলাম যে ড. কিসিঞ্জারের কূটনৈতিক বুদ্ধি সম্পর্কে এরা অবগত। তেমন অতি পরিচিত (জনপ্রিয় নাকি অজনপ্রিয় সেই বিচারে আমি যাচ্ছি না) একটি নাম হেনরি কিসিঞ্জার। 

বৃহস্পতিবার ৩০ নভেম্বরের পত্র পত্রিকায় দেখলাম, কিসিঞ্জারের জীবনীর বিভিন্ন দিক আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু তার কূটনৈতিক জীবনে সবচেয়ে বড় যে মাইলস্টোন সে সম্পর্কে কোনোরূপ তথ্য দেওয়া হয় নি। আর সেটি হলো চীন এবং আমেরিকার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার রুদ্ধ দুয়ার খুলে দেওয়া। এই কাজটি করেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। আর তখন আমেরিকা ও চীনের মধ্যে দূতিয়ালি করেছিল পাকিস্তান। তখন পাকিস্তানে ছিল জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন। ১৯৪৯ সালে চীনে মাও সে তুং এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও পরবর্তী ২০ বছর অর্থাৎ ১৯৬৯ পর্যন্ত চীন এবং আমেরিকার মধ্যে কোনো প্রকার সম্পর্ক ছিল না। তখন এই বন্ধ দুয়ার খোলায় সাহায্য করার জন্য তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পাকিস্তানের শরণাপন্ন হন এবং ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় সম্পূর্ণ গোপনীয়তার চাদরে মুড়ে দুই বার কিসিঞ্জার বেইজিং সফর করেন। তার প্রথম সফরটি এতই গোপনীয় ছিল যে কাক পক্ষীও সেটি জানতো না। 

দুইবার গোপন সফরের পর হিম শীতলতার বরফ গলতে শুরু করে। অবশেষে ১৯৭২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন প্রকাশ্যে চীনের রাজধানী পিকিং (বর্তমানে বেইজিং) সফর করেন। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলেন যে, চীন ও আমেরিকার মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তান যে বিরাট অবদান রেখেছিল তারই স্বীকৃতিস্বরূপ তৎকালীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে। 

কিন্তু আন্তর্জাতিক কূটনীতির গতি এবং ইংরেজি ভাষায় যেটিকে বলা হয় ঞৎধলবপঃড়ৎু, সেটি বড় বিচিত্র। যে পাকিস্তানের সাথে আমেরিকার এত দহরম মহরম, যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়ক জুলফিকার আলী ভুট্টো এত চীনপন্থী সেই জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং পরবর্তীকালে তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানোর ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা পালন করে এই আমেরিকা। আর সেই কাজের নায়ক ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। 

পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল এই যে, তারা দ্রুতগতিতে পারমাণবিক বোমা বানাচ্ছিল। এই বোমা বানানোর কাজের অগ্রপথিক ছিলেন বিশ^বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ড. আব্দুল কাদির খান। ড. আব্দুল কাদির খানের উত্থান এবং পতনও কূটনীতির গতির মতোই বিচিত্র। এ সম্পর্কে আজ আর দীর্ঘ আলোচনা করবো না। যারা এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান তারা একটি বই পড়তে পারেন। বইটির নাম, ‘দ্য ম্যান ফ্রম পাকিস্তান’। স্পাই থ্রিলারের চেয়েও নাটকীয় এই বইটি আপনাকে রুদ্ধশ^াসে পড়তে হবে। যাই হোক, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আমেরিকার ইতিহাসে জন ফস্টার ডালেসের পর সবচেয়ে আলোচ্য যে ব্যক্তি মার্কিন কূটনীতিতে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি হলেন ড. হেনরি আলফ্রেড কিসিঞ্জার। কিসিঞ্জারের কূটনীতির সবচেয়ে সাফল্যের যে কাহিনী সেই চীন মার্কিন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার নায়ক কিসিঞ্জারের কূটনীতির এই চ্যাপ্টারটি আমি বাংলাদেশের কোনো পত্রিকায় দেখলাম না। 

॥ দুই ॥

ফিরে আসছি বাংলাদেশের রাজনীতি, বিশেষ করে নির্বাচনী রাজনীতির ওপর। গত ৩০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার ছিল শেষ দিন। এই নির্বাচন সম্পর্কে বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই। কারণ প্রতিদিন পত্র পত্রিকায় এসম্পর্কে যেসব খবরাখবর পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো শুনে বা পড়ে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন ছিল অবিশ্বাস্য। তখন প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ প্রায় সবগুলো বিরোধী দল ঐ নির্বাচন বর্জন করেছিল। একটি সরকার গঠনের জন্য পার্লামেন্টে যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন সেই ১৫৩ জন ব্যক্তি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হয়েছিলেন। বাকি ১৪৭ টি আসনে ১৫ শতাংশের বেশি ভোটার উপস্থিতি ছিল না। 

২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল আরেকটি তেলেসমাতি কারবার। পৃথিবীর কোনো যুগে কোথাও শোনা যায়নি যে দিনের ভোট রাতে হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাতে সেই কর্মটিও করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই জল্পনা কল্পনা চলছিল যে পরবর্তী নির্বাচন, অর্থাৎ ২০২৪ সালের নির্বাচনে আর কোন ধরনের তেলেসমাতি কান্ড ঘটবে? সবাই জানেন যে, একই ট্যাক্টিক্স বারবার খাটে না। তারমধ্যে আবার আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং পশ্চিমা বিশ্ব এই মর্মে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ দিয়েছে যে, ২০২৪ সালের নির্বাচনকে অবশ্যই অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ হতে হবে।

যদিও তারা কেয়ারটেকার সরকারের দাবি বা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা মুখ ফুটে বলেনি, তারপরেও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে গেলে বাংলাদেশের বিরাজমান জনসমর্থনের পটভূমিতে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দল অংশগ্রহণ না করলে সেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হতে পারে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার বিলক্ষণ জানে যে, যদি নির্বাচন হয় অবাধ ও সুষ্ঠু তাহলে তারা এত অজনপ্রিয় হয়ে গেছে যে, সেই নির্বাচনে তারা ২০ টি আসনও পাবে না। সুতরাং এবার তারা নতুন কূটচাল দিল। এবারের কূটচাল হলো এই যে, নানান ফন্দি ফিকির করা হবে যাতে করে বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দল সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারে। সেটিও আবার এমন কায়দা করে করতে হবে যে আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্বের চোখে যেন ধুলা দেওয়া যায়। 

॥ তিন ॥

পরবর্তী কাহিনী আপনারা সবই জানেন। ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির ১০ লক্ষ লোকের জনসভা কী রকম পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক প্রচন্ড ক্র্যাকডাউনের মাধ্যমে কিভাবে ভন্ডুল করা হয় সেটা পত্র পত্রিকা এবং সামাজিক মাধ্যমে জনগ সবই জেনে গেছেন। তারপর বিগত এক মাসে বিএনপি এবং জামায়াতের ২১ হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীকে জেলে নিক্ষেপ।

আওয়ামী লীগের পরবর্তী কৌশল হলো প্রতিটি আসনে ডামি প্রার্থী (অর্থাৎ সাজানো প্রার্থী) দাঁড় করিয়ে নির্বাচনটিকে প্রতিযোগিতামূলক এবং অংশগ্রহণমূলক হিসেবে দেখানো যায়। মাঝখানে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। সেগুলো পাঠক ভাইয়েরা জানেন বলে উল্লেখ করলাম না। রাতারাতি তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট (বিএনএম), বিএসপি সহ একাধিক রাজনৈতিক দল ছপ্পড় ফেড়ে বেরিয়ে আসে। জাতীয় পার্টিতেও রওশন এরশাদকে সরিয়ে জিএম কাদেরকে সামনে আনা হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মাস ছয়েক আগে জিএম কাদের দিল্লী সফর করেছিলেন। তখনই তাকে নেতৃত্বে আনার নাটক সাজানো হয়। 

এই সব নাটকের এক একটি অংশে কোনো দল থেকে ২৮৭ টি প্রার্থী, কোনো দল থেকে ২৩০ জন এভাবে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তাতেও আওয়ামী লীগ পুরাপুরি সন্তুষ্ট হতে পারছিল না। তাই আওয়ামী লীগের সহ¯্রাধিক নমিনেশন ফর্ম বিক্রি হলেও ২৯৮ জনকে অফিসিয়াল ক্যান্ডিডেট হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বাকিদেরকে বলা হয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে। তাদের আশ^াস দেওয়া হয়েছে যে স্বতন্ত্র হয়ে আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল প্রার্থীর বিরুদ্ধে কনটেস্ট করলেও তাদেরকে বিদ্রোহী প্রার্থী বলা হবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো এ্যাকশনও নেওয়া হবে না। অর্থাৎ আওয়ামী প্রার্থীরা জিতলেও আওয়ামী লীগ, আবার স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতলেও আওয়ামী লীগ। শুধু তাই নয়, তৃণমূল, বিএনএম, বিএসপি বা জাতীয় পার্টি (জিএম কাদের) যারাই আসুক না কেন, তারা সকলেই প্রধানমন্ত্রীর আশির্বাদ নিয়েই ইলেকশনের মাঠে নেমেছেন। কে বা কারা গৃহপালিত বিরোধী দল হবে, এখন চলছে সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা। 

॥ চার ॥

এই প্রসঙ্গে বিরোধী দলের চলমান সরকার পতন আন্দোলনের কথা এসে পড়ে। আমরা জানি না, এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী। বৃহস্পতিবার ঘোষণা করা হয়েছে, রোববার ও সোমবার ৩ ও ৪ ডিসেম্বর অষ্টম দফায় অবরোধ পালিত হবে। এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে যে বিরোধী দলসমূহের হরতাল এবং অবরোধকে সরকার পাত্তা দিচ্ছে না। বিরোধী দলসমূহের কোনো ফরেন কানেকশন আছে কিনা সেটি আমরা জানি না। জানা সম্ভবও নয়। জানতে চাইও না। কিন্তু বাজারে এভাবে একটি কথা রটে গেছে যে, আমেরিকা বা পশ্চিমা দুনিয়া যদি সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ না করে তাহলে আওয়ামী লীগ সরকার ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে একটি প্রচন্ড তামাশার নাটকের মাধ্যমে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবে। 

এক্সটার্নাল ফ্রন্টে কী হবে না হবে সেটি নিয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বৃহস্পতিবার দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ১০ দিনের ছুটি কাটিয়ে ঢাকায় ফিরে এসেছেন। ফিরে আসার ৩ দিন পর গত বৃহস্পতিবার ৩০ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বেলা ১১ টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত এক ঘন্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন আমাদের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সাথে। কী কথা হয়েছে তাদের মাঝে সেটি কেউ জানে না। কিন্তু ঐ একই দিন দুপুরের পর আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন যে, মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে কূটনীতির ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে থাকতে হবে। তিনি সীমা অতিক্রম করতে পারবেন না। 

কেন তিনি হঠাৎ এমন কঠোর কথা বললেন সেটি আমরা জানি না। আমরা এটাও জানি না যে, মাসুদ বিন মোমেন এবং পিটার হাসের মধ্যকার বৈঠক এবং ওবায়দুল কাদেরের হুঁশিয়ারি কাকতালীয় কিনা। আমরা এটাও জানি না যে, এই দুটি ঘটনার মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা। 

Email: asifarsalan15@gmail.com 

https://www.dailysangram.info/post/542199