১৯ নভেম্বর ২০২৩, রবিবার, ৮:৩৮

কৃষকের স্বপ্নে মিধিলির আঘাত

ভোলা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী ও বরগুনায় ২ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত, অনেক এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন

 

মাঠজুড়ে ছিল কৃষকের সোনার ফসল। কেউ চাষ করেছিলেন ধান। কেউবা ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, লাউ, শিম ও মুলাসহ শীতকালীন নানা শাকসবজি। আর কয়েক দিন পরেই আমন ধান কাটার ধুম পড়ত। 

শীতের সবজি উঠত হাটবাজারে। এতে লাভের স্বপ্ন দেখছিলেন কৃষকরা। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় মিধিলির আঘাতে তাদের সেই স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে। সারা দেশের অন্তত ১৫ জেলায় আমন, শীতকালীন শাকসবজি ও আগাম রবি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। 

শুক্রবারের ঝড়ে তছনছ হয়ে গেছে সুন্দরবনের দুবলার চরের শুঁটকি পল্লি। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও মীরসরাই এবং পটুয়াখালীতে গাছ পড়ে শিশুসহ আরও ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভোলা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী ও বরগুনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ হাজার ঘরবাড়ি। বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে ও তার ছিঁড়ে যাওয়ায় শনিবারও অনেক এলাকায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। 

পটুয়াখালী ও বরগুনায় ট্রলার ডুবে ৬৯ জেলে নিখোঁজ হয়েছেন। এদিকে মিধিলির প্রভাব কেটে যাওয়ায় শনিবার সকাল থেকে নৌপথে যাত্রীবাহী লঞ্চসহ বিভিন্ন নৌযান চলাচল শুরু হয়েছে। ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- 

ভোলা, লালমোহন ও মনপুরা : ভোলা জেলা প্রশাসকের কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, জেলায় ৭৩টি ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪২৬টি। ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকায় শনিবারও বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়নি। শুক্রবার মেঘনা নদীতে ডুবে যাওয়া থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে ফেরির ৩শ যাত্রী। যাত্রীরা সাঁতরে তীরে উঠেছেন। ২০ ঘণ্টা পর শনিবার সকালে কলমিলতা নামে ওই ফেরি ও ৭টি বাস উদ্ধার করা হয়েছে। এদিকে ১ লাখ ৭৮ হাজার হেক্টর জমির আমন ধানের ২৭ ভাগ মাটিতে নুইয়ে গেছে। এছাড়া সরিষা, গম ও ডাল চাষের ৫০ ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানান কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক ওয়াসিলুর রহমান। জেলা সদরের ভেদুরিয়া, কাচিয়া ও ভেলুমিয়া এলাকায় ৪৯টি মাছের ঘের ও পুকুর বিনষ্ট হয়েছে। লালমোহনের রমাগঞ্জ ইউনিয়নের পূর্ব চরউমেদ গ্রামের চাষি মো. নূরনবী মিয়া বলেন, জমি লগ্নি রেখে এ বছর আড়াইশ শতাংশ জমিতে হাইব্রিড জাতের ধান চাষ করি। ঝড়ে জমির অধিকাংশ ধানই মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। 

বরিশাল, মুলাদী ও আগৈলঝাড়া : জেলার বাবুগঞ্জে, মুলাদী, হিজলা, বাকেরগঞ্জ, বানারীপাড়া, উজিরপুরসহ বেশ কয়েকটি উপজেলায় আমন ধানের ক্ষতি হয়েছে। শাক, সরিষা, খেসারি, মসুর ডালসহ বিভিন্ন ফসলের জমি পানিতে ডুবে গেছে। বাবুগঞ্জ উপজেলার চাঁদপাশা ইউনিয়নের কৃষক ফরহাদ বলেন, ধারদেনা করে ৪৭ শতাংশ জামিতে আমন ধানের চাষ করেছি। ঝড়ে আমার সবকিছু শেষ হয়ে গছে। একই এলাকার কৃষক আল আমিন বলেন, আমাদের সবকিছু এই ধানের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এখন যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। এতে বছরের খোরাকি হবে না। মুলাদীতে ৪ হাজার ৮১০ হেক্টর জমির আমন ধান, ৬৫ হেক্টর জমির সবজি, ২৫ হেক্টর জমির সরিষা, ৩০ হেক্টর জমির খেসারি ও মুসর ডাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে ৪৮ ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। 

চাঁদপুর, ফরিদগঞ্জ ও হাজীগঞ্জ : জেলায় ১৯০ হেক্টর জমির আধাপাকা ও পাকা আমন ধান এবং ৪২০ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বাগাদী মাঠের কৃষক হাবিব বেপারী ও ওবাদ শেখ জানান, তাদের পুরো মাঠের অধিকাংশ জমির ধান হাঁটু সমান পানির নিচে। অনেকেই ধান কেটে শুকানোর জন্য রেখেছিলেন। ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা পশ্চিম ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল খালেক বেপারি কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ করে এক একর জমিতে বিআর-২২ জাতের ধানের আবাদ করেছেন। এখন তার সব শেষ। 

পটুয়াখালী, কুয়াকাটা, দুমকি, দশমিনা ও দক্ষিণ : জেলা দুর্যোগ ও ত্রাণ কর্মকর্তা সুমন চন্দ্র দেবনাথ জানান, জেলায় ছয়টি আধাপাকা টিনশেড ঘর ও একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। ১৩১টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতি হয়েছে। জেলা কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, ৮ উপজেলার প্রায় অধিকাংশ জমির পাকা, আধা-পাকা আমন ও ইরি ধান বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে। অনেক এলাকায় আমন ধান বাতাসে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। এদিকে হেলেপড়া গাছ কাটতে গিয়ে চাপায় মো. নাসির হাওলাদার (৪৫) নামে এক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। শনিবার সকালে দশমিনা উপজেলা পরিষদের সামনের সোনালী ব্যাংকের পেছনের মুসলিমপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। 

নোয়াখালী, কোম্পানীগঞ্জ ও সেনবাগ : জেলার উপকূলীয় এলাকা হাতিয়া, সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট ও সদর উপজেলার ৩৪টি ইউনিয়নের দ্বীপ ও চরাঞ্চলে ২১২টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯১৩টি ঘরবাড়ি। বিভিন্ন স্থানে গাছচাপায় অন্তত ৫ জন আহত হয়েছেন। জেলা সদর, বেগমগঞ্জ, হাতিয়া, সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট, চাটখিল, সেনবাগ ও সোনাইমুড়ী উপজেলায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে। অনেক এলাকায় শনিবারও বিদ্যুৎ ছিল না। 

চট্টগ্রাম ও মীরসরাই : সন্দ্বীপ ও মিরসরাই উপজেলায় গাছচাপায় এক বৃদ্ধ ও শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার সন্দ্বীপের মগধরা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে আবদুল ওহাব (৭০) নামে ওই বৃদ্ধের মৃত্যু হয়। একই দিন মিরসরাই উপজেলার ৩ নম্বর জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাপাহাড় কাটাবিলে সিদরাতুল মুনতাহা আরিয়া (৪) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। সে ওই এলাকার আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়ার মেয়ে। এদিকে অনেক স্থানে বিদ্যুতের খুঁটি ও তার লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ায় শুক্রবার গভীর রাত পর্যন্ত বিদ্যুৎহীন ছিল মীরসরাই। পানি জমেছে ফুলকপি, বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন ফসলের খেতে। 

বরগুনা, পাথরঘাটা ও আমতলী : জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মিল্টন চাকমা বলেন, বরগুনা সদরে ৬১টি, আমতলী ১১টি, তালতলী ৫২টি, বামনায় ২০টি, পাথরঘাটা ২০টি, বেতাগী ৪১টি বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলায় ফসলের চরম ক্ষতি হয়েছে। আমতলী উপজেলায় ২১টি ইটভাটার ৫০ লাখ কাঁচা ইট নষ্ট, ১১ কাঁচা ঘর বিধ্বস্ত এবং ২৩৪ হেক্টর আমন ধানের খেত, ৭৬ হেক্টর সবজি, ৪৫০ হেক্টর খেসারি ডাল ও ৫ হেক্টর জমির পান বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই উপজেলায় ১৩টি ঘর পুরোপুরি ও ৫৭টি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক এলাকায় বন্ধ বিদ্যুৎ সরবরাহ। এদিকে বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার করতে যাওয়া ২টি ট্রলারের ৩১ জেলে নিখোঁজ রয়েছে। 

পিরোজপুর ও মঠবাড়িয়া : পিরোজপুর সদর উপজেলার রায়েরকাঠী এলাকার সবজি চাষি ফজলুল হকের চোখেমুখে দুঃস্বপ্ন। তার প্রায় আড়াই একর সবজি খেত পানির নিচে। পানি সরে গেলেও কোনোভাবে রক্ষা করতে পারবেন না ফসল। এরই মধ্যে ক্ষেতের টমেটো, লাউ, শিম ও পেপে গাছ মরা শুরু করেছে। ইন্দুরকানী উপজেলার ঢেপসাবুনিয়া এলাকার কৃষক মোহম্মদ হোসেন আলী বলেন, সবেমাত্র ধান বের হয়েছে। এখনো পাকেনি। এরই মধ্যে ঝড়ে ধানগাছ ভেঙে পানিতে তলিয়ে গেছে। মঠবাড়িয়া উপজেলায় ইরি ও আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া মৌসুমি সবজিখেত, ফলদ ও বনজ গাছ নষ্ট হয়েছে। 

শরীয়তপুর : জেলার জাজিরা, নড়িয়া, গোসাইর হাট, ডামুড্যা, ভেদরগঞ্জ ও সদর উপজেলায় ১২ হাজার ৫শ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে জাজিরা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ, রসুন, দনিয়া, কালজিরা, আলু, সরিষা, খেসারি, বেগুন, মরিচসহ নানা শাক-সবজির নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। ৬টি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার গ্রাহক শনিবার বিকাল পর্যন্ত বিদ্যুৎহীন ছিলেন।

তছনছ দুবলার চর শুঁটকি পল্লি: মোংলা ও শরণখোলা (বাগেরহাট) প্রতিনিধি জানান, সুন্দরবনের দুবলার চরে শুঁটকি পল্লিতে ঝড়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তীব্র বাতাস আর সমুদ্রের ঢেউয়ে তছনছ হয়ে গেছে শুঁটকি তৈরির উপকরণ ও স্থাপনা। ভারি বৃষ্টিতে ভিজে পচে গেছে সমুদ্র থেকে আহরিত বিভিন্ন প্রজাতির কাঁচা মাছ ও শুঁটকি। বনবিভাগের তথ্যমতে, দুবলার জেলে পল্লিতে প্রায় ৩ হাজার ৫শ টন মাছ ও শুঁটকি নষ্ট হয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রায় ২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর এ খাতে ৭৫ থেকে ৮০ লাখ টাকা রাজস্ব হারাবে বন বিভাগ। এ অবস্থায় চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন শুঁটকি জেলে ও ব্যবসায়ীরা। দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদ জানান, ঝড়ে প্রায় ৩৫ হাজার কুইন্টাল কাঁচা মাছ ও শুঁটকি পচে নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া জেলেদের কিছু বসতি ও স্থাপনাও কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

রামগঞ্জ (লক্ষ্মীপুর) : গাছচাপায় বেশ কিছু ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শীতকালীন শাক-সবজির খেত পানিতে ডুবে গেছে। শনিবারও উপজেলার কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না।

চিতলমারী (বাগেরহাট) : কলাই, শরিষা, শীতকালীন সবজি ও বোরো ধানের বীজতলা নষ্ট হয়েছে। 

সোনাগাজী (ফেনী) : গাছপালা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে ও খুঁটি ভেঙে উপজেলার অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ শনিবারও বন্ধ ছিল। ঝড়ের সময় বিভিন্নভাবে ৮ জন আহত হয়েছেন। 

এছাড়া বাগেরহাট, লক্ষ্মীপুরের রায়পুর, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে আমন ধান ও শীতকালীন সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/741666