১৮ নভেম্বর ২০২৩, শনিবার, ১০:০৯

ঘূর্ণিঝড় মিধিলি’র আঘাতে উপকূলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি

ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’ উপকূল অতিক্রমের পর দুর্বল হয় গভীর নি¤œচাপে পরিণত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টি পটুয়াখালীর কলাপাড়ার কাছাকাছি দিয়ে মোংলা-পায়রা উপকূল অতিক্রম করে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকার গাছপালা ও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মিধিলি’র প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়ো বাতাসে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে টাঙ্গাইলে রাজ্জাক মিয়া নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। মৃত রাজ্জাক মিয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের মিরিকপুর গ্রামের কুসুম মিয়ার ছেলে। তিনি বাসাইলের কোটিপতি মার্কেটে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। জুমার নামাজ পড়ে বাসায় যাওয়ার পথে বাসাইল উপজেলা পরিষদের গেটের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে।  

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে শুক্রবার বিকেল ৩টায় উপকূল অতিক্রম করে ক্রমেই দুর্বল হয়ে যায় মিধিলি। এটি স্থলভাগের অভ্যন্তরে আরও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর ও বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে পারে। এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে গতকাল সারাদিন ও সারারাত বৃষ্টিপাত হয়। একইসাথে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্রবন্দরগুলোর ওপর দিয়ে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়া অব্যাহত ছিল বলে জানায় আবহাওয়া দপ্তর।

স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে উপকূলীয় এলাকার গাছপালা ও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে কলাপাড়ায় সারাদিন টানা বর্ষণ ও দমকা হাওয়া বয়ে যায়।  উত্তাল সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ আতঙ্ক সৃষ্টি করে জনমনে।  স্থানীয় কৃষক শাহজাহান বিশ্বাস বলেন, আর মাত্র ১৫ দিন পরেই ধান কাটার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ঝড়ের কবলে সব ধানগুলো মাটিতে শুয়ে পড়েছে। ফসল ঘরে তোলার আগ মুহূর্তে এভাবে ঝড়ের কবলে পড়তে হবে ভাবিনি। অনেক ক্ষতি হয়ে গেল।

জেলে জলিল খান বলেন, আল্লাহ রহমত করেছেন যখন ঘূর্ণিঝড়টি অতিক্রম করেছে তখন সমুদ্রে ভাটা ছিল। তাই ঝড়ের গতি কিছুটা কম ছিল। সেজন্য ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কম হয়েছে। তবে অনেক গাছপালা ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। লতাচাপলী ইউনিয়নের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) দলনেতা মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, সিপিপি থেকে আমরা মাইকে বারবার সতর্ক করেছি সাধারণ মানুষকে। সবার আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া নিশ্চিত করতে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করেছেন। তবে গাছপালা ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। 

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান জানান, মিধিলি খুবই দুর্বল মানের একটি ঘূর্ণিঝড়। এর কেন্দ্রের আকার ৫০ কিলোমিটারের মতো। পুরো শরীরের আকার ৩০০ থেকে ৩৫০ কিলোমিটার। তিনি বলেন, আজ শনিবার থেকে বৃষ্টি কমে যাবে। তবে উপকূলীয় এলাকায় কিছুটা বৃষ্টি থাকবে। এদিকে ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র প্রভাবে বৃহস্পতিবার রাত থেকেই সারাদেশে বৃষ্টি হয়। ঢাকায় দিনভর বৃষ্টি হয়। শুক্রবার ঢাকাসহ দেশের পাঁচ বিভাগে অতিভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর। এছাড়া শুক্রবার সকালে দেশের চারটি সমুদ্রবন্দরে বিপৎসংকেত জারির পর সারাদেশে লঞ্চ চলাচল বন্ধ ছিল। 

বরগুনা : ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কবলে পড়ে গভীর বঙ্গোপসাগরের ৩০০ জেলেসহ মাছ ধরার ২০টি ট্রলার নিখোঁজ রয়েছে। এতে জেলে পল্লীতে উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তফা চৌধুরি এই তথ্য নিশ্চিত করেন। এদিকে এফবি রিফাত নামের মাছ ধরা ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটেছে। সাথে সাথেই অন্য ট্রলারের মাধ্যমে জেলেদের উদ্ধার করা হয়েছে। বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক সমিতি জানায়, জেলায় প্রায় দেড় হাজার ট্রলার সাগর মোহনায় ও গভীর সাগরে মাছ শিকার করে। বর্তমানে সকল ট্রলার কিনারায় ফিরলেও ২০টি ট্রলারের কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।  নিখোঁজের ঘটনায় জেলে পল্লীতে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। তাদের সন্ধানে কোস্টগার্ড, স্থানীয় প্রশাসন ও মৎস্য সমিতির উদ্যোগে নিখোঁজ জেলেদের উদ্ধারের কার্যক্রম চলছে। 

বরিশাল : ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে টানা দুই দিনের বৃষ্টিতে বরিশাল নগরীতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। শুক্রবার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জলাবদ্ধতার এচিত্র দেখা গেছে। বরিশাল নগরীর প্রাণকেন্দ্রে বটতলা থেকে চৌমাথা, বগুড়া রোডের একাংশ, রাজাবাহাদুর সড়কসহ বিভিন্ন অলিগলিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এছাড়া নগরীর চৌমাথা সিএন্ডবি রোড সংলগ্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিপিপি), শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বৃষ্টির পানি জমে রয়েছে।

বরিশাল আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ বশির আহমেদ বলেন, দুপুর ১২টা নাগাদ ১১৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। রাতে বর্ষণ আরো বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে বাতাসের গতি সর্বোচ্চ ৫৫ কিলোমিটার রেকর্ড করা হয়েছে। বরিশাল নদী বন্দরে তিন নম্বর ও পায়রা সমুদ্র বন্দরে সাত নম্বর সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। 

ভোলা : জেলায় মিধিলির প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়ের তাণ্ডবে দুই শতাধিক কাঁচাঘর সম্পূর্ণ ও আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। এছাড়াও ৩টি মাছ ধরার নৌকা ডুবে গেছে। এতে নিখোঁজ রয়েছেন বাচ্চু নামের এক জেলে। তার বাড়ি তজুমদ্দান উপজেলার চর রায়হান এলাকায়।  শুক্রবার  দুপুরের পর ঝড়ের কবলে এ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। চরফ্যাশন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নওরীন হক জানান, ঝড়ের কবলে পড়ে ঢালচর এলাকায় ১৯টি কাঁচাঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন ইউনিয়নে আরও ২০০ ঘর আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে।

অন্যদিকে তজুমদ্দিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শুভ দেবনাথ জানান, ঝড়ের কবলে পড়ে মেঘনার চর রায়হান এলাকায় একটি জেলে নৌকা ডুবে গেছে। এতে ২ জন জীবিত উদ্ধার হলেও বাচ্চু নামের একজন নিখোঁজ রয়েছেন। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় ফসল ও ব্রিক ফিল্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।  এছাড়া মনপুরায় মাছ ধরার দুটি জেলে নৌকা ডুবলেও কোস্টগার্ড ৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছেন। ভোলার জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান বলেন, ঝড়ে কিছু কিছু স্থানে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, সেগুলোর তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তা দেওয়া হবে। এদিকে শঙ্কা কেটে যাওয়ার পর স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে ভোলার উপকূল।

https://dailysangram.info/post/540986