১৭ নভেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ৪:০০

জ্বালানি নিয়ে সিপিডি’র প্রতিবেদন প্রকাশ

বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিপুল ডলার খরচ হচ্ছে

১২ বছরে ব্যয় ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা

বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে প্রতিনিয়ত ডলারের অপচয় করা হচ্ছে। যেখানে আমরা এক ডলার সঞ্চয় ধরে রাখতে রীতিমতো যুদ্ধ করে যাচ্ছি, সেখানে এলএনজি ও কয়লা আমদানিনির্ভরতায় বিপুল ডলার খরচ করা হচ্ছে। এক ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি আরো বলেছে, দেশের ৫১ ভাগ বিদ্যুৎ কেন্দ্র অলস পড়ে রয়েছে। গত ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে এক লাখ চার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে সরকার। এখন আর ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার যৌক্তিকতা নেই। এখন ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। এটি একটি বড় রকমের অপচয়। এ অপচয় মেনে নেয়ার মতো সামর্থ্য আমাদের অর্থনীতিতে নেই।

 

বলা হয়েছে, কয়লা ও এলএনজির আমদানিনির্ভরতা বাড়ানোর মাধ্যমে সরকার জ্বালানি রূপান্তরের উল্টোপথে যাত্রা শুরু করেছে। আমদানিপ্রবণতার কারণে পেট্রোবাংলা ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) পেমেন্ট দিতে হিমশিম খাচ্ছে। আমদানিকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সেভাবে দেশীয় জ্বালানির উত্তোলনে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। যে কারণে আজকের এ সঙ্কট।

গতকাল বৃহস্পতিবার ‘কারেন্ট চেইঞ্জ-কোয়ার্টারলি ব্রিফ অব দ্য পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি সেক্টর’ শীর্ষক মিডিয়া বিফ্রিংয়ে সিপিডি’র পক্ষ থেকে এ কথাগুলো বলা হয়েছে। রাজধানীর ধানমন্ডির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে রিপোর্ট উপস্থাপন করেন সংস্থার রিসার্চ অ্যাসোসিয়েটস হেলেন মাশিয়াত প্রিয়তি।

প্রতি তিন মাস পরপর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কার্যক্রম ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করার একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সিপিডি। এ উপলক্ষে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রথম কোয়ার্টারের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ওপর রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অভ্যন্তরীণ গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ থাকলেও সেটি করা হচ্ছে না। নতুন গ্যাস কূপ না করলেও পুরাতন গ্যাস কূপের সংস্কার যথাসময়ে হলেও এ সঙ্কট হতো না। গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে এলএনজি আমদানির জন্য ঋণ নেয়া হচ্ছে। সরকারের ৪৬টি কূপ খননের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, সেটি পূরণ করা উচিত।
তিনি বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জের নামে প্রতিনিয়ত ডলারের অপচয় করা হচ্ছে। যেখানে আমরা এক ডলার সঞ্চয় ধরে রাখতে রীতিমতো যুদ্ধ করে যাচ্ছি, সেখানে এলএনজি ও কয়লা আমদানিতে ডলার খরচ করা হচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব আমদানি কমানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বিকল্প জ্বালানির দিকে যেতে না পারলে ডলার সঙ্কট দূর করা সম্ভব নয়।

গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীদের ৬৭০ মিলিয়ন ডলার পেমেন্ট বকেয়া পড়েছে বিপিসি’র। অন্য দিকে পেট্রোবাংলার এলএনজি আমদানি বাবদ বকেয়া পড়েছে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের মতো। এই দায় মেটাতে পেট্রোবাংলা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইটিএফসি) কাছে ছয় মাসের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলার সিন্ডিকেট ঋণ নিচ্ছে। সিন্ডিকেট ঋণ সাময়িক সময়ের জন্য স্বস্তি মনে হলেও বিপদ বাড়াবে। আমরা এখনই বকেয়া পরিশোধ করতে পারছি না, এর সাথে সুদসহ বোঝা যুক্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ২০৪০ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে এ কার্যক্রমের অগ্রগতি গড়ের চেয়ে অনেক নিচে অবস্থান করছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ১৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে কোনোটিই নির্ধারিত সময়ে আসতে পারেনি। বিলম্বে কিংবা আংশিক উৎপাদনে এসেছে চারটি, আর ৯টি এখনো উৎপাদনে যেতে পারেনি।

এক প্রশ্নের জবাবে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমাদের ৫১ শতাংশ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বেকার পড়ে থাকছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে একসময় উদ্বৃত্ত ছিল, এখন উদ্বৃত্ততর থেকে বাহুল্য হয়ে গেছে। যা মাথাব্যথার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দেয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নতুন করে চুক্তি নবায়ন করা উচিত হবে না। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিন্ন ভিন্ন ট্যারিফ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সবকিছুর মূলে হচ্ছে দায়মুক্তি আইন। যদি প্রতিযোগিতামূলক বাজার থাকত তাহলে এমন অসম চুক্তি হতো না। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশে মালিকের নাম পাশে বসালে দারুণ একটি যোগসূত্র দেখা যেত। নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানি এসব সুবিধা পাচ্ছে। চুক্তির অস্বচ্ছতার প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

বিদ্যুৎ সরবরাহ সংক্রান্ত রিপোর্টে বলা হয়, বিদ্যুতের সবচেয়ে কম ব্যবহার হচ্ছে ময়মনসিংহ ও রংপুর জোনে। তবে বিগত তিন মাসে এসব জোনেই বেশি লোডশেডিং দেয়া হয়েছে। লোডশেডিংয়ের ক্ষেত্রে শুধু উৎপাদন ঘাটতি নয়, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণেও লোডশেডিং বেড়েছে। গত জুনে সঞ্চালন সমস্যার কারণে প্রায় দুই হাজার ৪১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন থাকে। আগস্টে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল পাঁচ হাজার ১৬ ঘণ্টা।

সিপিডি বলেছে, বাংলাদেশে গ্যাস থেকে কার্বন নিঃসরণ বেড়েছে। বেড়েছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে কার্বন নিঃসরণও। গত ১১ বছরে যা ৬৮ শতাংশ বেড়েছে। বায়ুদূষণের কারণে গড় আয়ু হারাচ্ছে মানুষ।

 

 

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/792064