১৭ নভেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ৩:৫০

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট

ইউপিআরে সদস্যদের উদ্বেগে সাড়া দেয়া উচিত বাংলাদেশের

 

ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউকালে (ইউপিআর) সদস্য দেশগুলো নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে যে ভয়াবহ নির্যাতন ও দমনপীড়নের বিষয়ে উদ্বেগ তুলে ধরেছে তাতে গুরুত্ব দিয়ে সাড়া দেয়া উচিত বাংলাদেশ সরকারের। ১৬ই নভেম্বর এমন আহ্বান জানিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এর শিরোনাম- ‘বাংলাদেশ; ইউএন রাইটস রিভিউ অ্যামিড ভায়োলেন্ট ক্র্যাকডাউন’। এতে বলা হয়, জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী যখন দমনপীড়ন চালাচ্ছে, তখনই এই রিভিউ অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি সাড়ে চার বছরের মধ্যে জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্য দেশকে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে ইউপিআর পর্যালোচনার মুখোমুখি হতে হয় তার মানবাধিকারের রেকর্ডের বিষয়ে। ব্যাপকভাবে খেয়ালখুশিমতো গণগ্রেপ্তার, জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও ব্যাপক আকারে নিপীড়ন সহ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গুরুতর নিয়ম লঙ্ঘন প্রামাণ্য আকারে উপস্থাপন করেছে মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলো। এসব অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত করে দায়ীদেরকে জবাবদিহিতায় আনার পরিবর্তে বাংলাদেশ সরকার, এসব অপরাধের জন্য কমান্ড দেয়া অফিসার সহ নিয়ম লঙ্ঘনকারীদেরকে পুরস্কৃত করেছে। 

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, বাংলাদেশ সরকার সবার জন্য মানবাধিকার সুরক্ষিত রাখায় যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তা অর্থহীন চলমান রাজনৈতিক গণগ্রেপ্তার, জোরপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক বিরোধী ও সমালোচকদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের কারণে। মানবাধিকারের প্রতি সরকারকে প্রকৃত প্রতিশ্রুতি দেখাতে আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতার অধীনেই কাজ করতে হবে। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগের সমাধান করতে হবে। অবিলম্বে বিরোধী রাজনৈতিক, সমালোচক এবং মানবাধিকারের পক্ষের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হয়রানি এবং নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। 

এতে আরও বলা হয়, রিভিউকালে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল সাম্প্রতিক নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতায় অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের প্রমাণ উড়িয়ে দিয়েছে।

তারা বলেছে, আইনপ্রয়োগকারী এজেন্সিগুলো যে ব্যবস্থা নিয়েছে তা ছিল সর্বনিম্ন স্তরের, যৌক্তিক এবং সংযত। সরকারের পক্ষ থেকে আরও দাবি করা হয়েছে যে, খেয়ালখুশিমতো কাউকে আটক করা হয়নি। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের প্রায় ১০ হাজার সহ রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে গণহারে গ্রেপ্তার করা সত্ত্বেও সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় গ্রেপ্তার করা হয়নি। ১৪ই নভেম্বর জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশ যখন ২০২৪ সালের শুরুতে জাতীয় নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখন ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সহিংসতা, বিরোধী দলের সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তার, রাজনৈতিক হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গণহারে খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার, প্রতিবাদ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া, হয়রানির অভিযোগ, ভীতি প্রদর্শন এবং প্রতিশোধ নিতে বেআইনিভাবে পরিবারের সদস্যদেরকে আটক করায় আমরা গভীরভাবে হতাশ। 

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ লিখেছে- বাংলাদেশের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণকারীদের মতে, ২০০৯ সাল থেকে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৬০০ জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ আছে। কিছু মানুষকে পরে মুক্তি দেয়া হয়েছে, আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে অথবা হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু প্রায় ১০০ মানুষ এখনো নিখোঁজ। ভিকটিমের পরিবারগুলো অভিযোগ করেছে পুলিশ ও অন্য নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা তাদের মামলা নিতে বা তদন্ত করতে অস্বীকার করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপরের নির্দেশের কথা উল্লেখ করে তারা। 

ইউপিআর শুনানিকালে অনেক সদস্য দেশ বলেছে, জোরপূর্বক গুম থেকে সব ব্যক্তিকে রক্ষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুমোদন করা উচিত সরকারের। এর জবাবে বাংলাদেশ প্রতিনিধি বলেছেন, এই কনভেনশনের পক্ষ হওয়ার আগে এর বাধ্যবাধকতাগুলো পালনের জন্য জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগ করতে হবে। 

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস থেকে একটি বিশেষায়িত মেকানিজম প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবকে মেনে নিতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে। এই মেকানিজম কাজ করে ঘনিষ্ঠভাবে ভিকটিম, তাদের পরিবার এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে। এর মধ্য দিয়ে তারা জোরপূর্বক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের তদন্ত করে। ২০১৮ সালে ইউপিআর রিভিউতে বাংলাদেশ সরকার দাবি করে যে, জোরপূর্বক গুম বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের মিটিংয়ের অনুকূলে সাড়া দিয়েছে। কিন্তু ৫ বছর পরে এসেও বাংলাদেশ সফরে জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপকে আমন্ত্রণ জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে সরকার। যদিও এ সমস্যা সমাধানে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি প্রদর্শনের জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সাবেক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলে। সরকারের উচিত অভিযোগ তদন্ত করে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে উপযুক্ত সুপারিশ দিতে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট অন্য বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানো। এর মধ্যে আছে খেয়ালখুশি মতো আটক বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ, বিচারবহির্ভূত খেয়ালখুশিমতো হত্যাকাণ্ড বিষয়ক স্পেশাল র‌্যাপোর্টিউর, নির্যাতন, অন্য নিষ্ঠুরতা, অমানবিক ও অপমানজনক আচরণ ও শাস্তি বিষয়ক স্পেশাল র‌্যাপোর্টিউর। 

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের সাম্প্রতিক অভিযোগগুলো নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের ব্যাপকতা ও তাদের এই সংস্কৃতিতে দায়মুক্তির বিষয়টিই তুলে ধরে। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে আছে- প্রহার, বৈদ্যুতিক শক, ওয়াটারবোর্ডিং, ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি করে পঙ্গু করা, পায়ে গুলি করা, হত্যাকাণ্ডের নাটক করা এবং জোরপূর্বক নগ্ন করা।  জোরপূর্বক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন কয়েক শত মানুষ। কাউন্সিলে জমা দেয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, এক দশক আগে পাস হওয়া টর্চার অ্যান্ড জুডিশিয়াল ডেথ (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট পাস হওয়ার পর মাত্র একটি মামলায় একজনকে অভিযুক্ত করেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের কমিটি এগেইনস্ট টর্চার যেসব সুপারিশ করেছে তা বার বার উপেক্ষা করেছে বাংলাদেশ।

https://mzamin.com/news.php?news=83885