১১ নভেম্বর ২০২৩, শনিবার, ১১:০৭

দেশি মাছের আকাল, সংকটে শুঁটকি

২৫ বছর ধরে চলনবিলের মাছ দিয়ে বেশ বড় চাতালে শুঁটকি তৈরির ব্যবসা করছেন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার বিনায়েকপুর গ্রামের আব্দুল গফুর তালুকদার। আগে মৌসুমে প্রায় চার মাস ১০ থেকে ১৫ জন শ্রমিক কাজ করতেন। এ ব্যবসার আয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার ভালোভাবেই চলে যেত। তবে গত কয়েক বছরে শুঁটকি তৈরির মৌসুমে প্রয়োজনীয় মাছ না পেয়ে আয়ে টান পড়েছে।

শুঁটকি তৈরিতে দীর্ঘদিন যুক্ত এ ব্যবসায়ীর মতে, মাছের আকালের কারণে দেশি মাছের 
শুঁটকির ভবিষ্যৎ অন্ধকারে। তাঁর দেওয়া তথ্যমতে, তিনি ২০২১ সালে ৩৫ লাখ টাকার মাছ কিনে 
প্রায় ৫০০ মণ শুঁটকি তৈরি করেন। ২০২২ সালে টাকা থাকলেও চাহিদামতো মাছ পাননি। ২৮ লাখ টাকায় মাছ কিনে ৪৩০ মণ শুঁটকি তৈরি করেন। চলতি বছর মৌসুমের শুরুতে চাহিদামতো মাছ পাচ্ছেন না। চাতালের অর্ধেক অংশে মাছ শুকালেও বাকিটা ফাঁকা পড়ে আছে।

শুধু আব্দুল গফুরের নয়, তাঁর মতো অন্তত ৫০ থেকে ৫৫ জন ব্যবসায়ীর অবস্থা প্রায় একই। তারা বলছেন, চাতালে শুঁটকিতে মাছি বসা রোধ ও ওজন ঠিক রাখতে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লবণপানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় মাছ। পরে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নিরাপদ শুঁটকি তৈরি হয়। চলনবিলের মাছে কেমিক্যাল মেশানো হয় না। ফলে এগুলো স্বাস্থ্যকর। এ কারণে চলনবিলের মাছের শুঁটকির কদর রয়েছে, দামও বেশি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আশির দশকে চলনবিলের মাছের এ ব্যবসা শুরু হয়। আশ্বিনের শুরুতে তাড়াশ, উল্লাপাড়া, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর, ফরিদপুর, গুরুদাসপুর, সিংড়া ও আত্রাইয়ে বিলে অস্থায়ী আবাস গড়ে ব্যবসায়ীরা শুঁটকি তৈরি করতেন। মাছ প্রাপ্তি সাপেক্ষে পৌষ মাস পর্যন্ত চলে এ কার্যক্রম। পুঁটি, টাকি, ট্যাংরা, খলিশা, চান্দা, বোয়াল, ছোট চিংড়িসহ দেশি মাছের শুঁটকি তৈরি হয় শত শত টন। উত্তরের মোকাম সৈয়দপুরসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয় এগুলো। মহাজনদের হাত ধরে ভারতে রপ্তানি করে এসেছে বৈদেশিক মুদ্রা।

যদিও চলনবিল অঞ্চলের উৎপাদনের হিসাব নেই বলে জানান তাড়াশ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশগুল আজাদ। ব্যবসায়ী আলহাজ আলীর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৬, ৮৮ ও ২০০৪ সালের পর চলনবিলে বড় বন্যা হয়নি। তারপরও ২০০৮ সাল পর্যন্ত শুঁটকির উৎপাদন ভালো ছিল। এরপর বন্যা না হওয়ার পাশাপাশি চায়না দুয়ারি, বেড়, কারেন্ট জালসহ নানা উপকরণ দিয়ে ও জলাশয় শুকিয়ে নির্বিচারে পোনা ও মা মাছ নিধন শুরু হয়। এতে মাছের স্বল্পতায় দেড় দশকে শুঁটকির ৩০০ চাতাল থেকে কমে ৫০ থেকে ৫৫টিতে ঠেকেছে। ভরা মৌসুমে ২০২০ থেকে চলতি বছর পর্যন্ত তিন বছরে গড়ে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত চাহিদার বিপরীতে মাছের ঘাটতি হয়েছে।

চলনবিলের হাটবাজারে পুঁটি মাছ প্রতি কেজি প্রকারভেদে ৩০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া টাকি ১৩০ থেকে ১৫০, খলিশা ৫০ থেকে ৮০, চান্দা ৭০ থেকে ৮০, ট্যাংরা ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকায় চাতাল মালিকরা কিনছেন। গত বছরের চেয়ে এবার দাম বেশি। তবে শুঁটকির উপযোগী বোয়াল, শোল, গুচি, ছোট চিংড়ি মাছ পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ভাঙ্গুড়া এলাকার ব্যবসায়ী অনিল সরকার।

সৈয়দপুর, নীলফামারী, রংপুরসহ শুঁটকি বিক্রির কয়েকটি মোকাম থেকে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে প্রতি মণ পুঁটির শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা, টাকি ২৪ থেকে ৩০, বোয়াল ৩০ থেকে ৩৪, খলিশা ১৪ থেকে ১৬ ও চান্দা ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকায়। চাহিদা থাকলেও চলনবিলের ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত সরবরাহ করতে পারছেন না বলে ব্যবসায়ী মো. নান্নু মিয়া জানান।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাছের অভাবে শুঁটকি উৎপাদন কমায় এলাকার ৭০০ থেকে ৮০০ মৌসুমি শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। যারা কাজ করছেন, তাদের পারিশ্রমিক কম। আগে নারী শ্রমিকরা পেতেন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা পেতেন পুরুষরা। অথচ এখন নারীরা ২০০ এবং পুরুষরা ৪০০ টাকা দিনে হাজিরা পাচ্ছেন।

প্রতি বছর শুঁটকির মৌসুমে প্রায় তিন মাস কাজ করতেন তাড়াশের মহিষলুটি এলাকার আনজুয়ারা খাতুন। তবে এখন তাঁর হাতে কাজ নেই। অন্য কাজ খুঁজছেন তিনি। তবে উপজেলার বিরোহালি এলাকায় জমিলা খাতুন এখনও এ কাজ করে চলেছেন। তাঁর ভাষ্য, মাছস্বল্পতার কারণে কাজ কতদিন চলবে, বলতে পারছেন না। আগের চেয়ে এখন মজুরিও প্রায় ১০০ টাকা কম।

শুঁটকি তৈরির সঙ্গে জড়িতদের নিরাপদ পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহিনুর রহমান বলেন, উৎপাদন বাড়াতে তাদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। গত বছর তাড়াশে শুঁটকি উৎপাদন কম হলেও উল্লাপাড়ায় বেশি ছিল। এখন মাছের দামও বেশি।

https://samakal.com/whole-country/article/206896