১১ নভেম্বর ২০২৩, শনিবার, ১১:০৪

ন্যূনতম মজুরি প্রত্যাখ্যান

 

মালিকপক্ষের প্রস্তাবের পর সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি প্রত্যাখ্যান করে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও জোট। বিক্ষোভ থেকে অবিলম্বে ১২ হাজার ৫০০ টাকার পরিবর্তে ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করার দাবি জানিয়েছেন তারা। অন্যথায় আন্দোলন চলবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। একই সঙ্গে আন্দোলনে তিন শ্রমিক নিহতের ঘটনায় বিচার দাবি করেছে পোশাক শ্রমিকরা। এছাড়া রাজনৈতিক প্রলেপ দিয়ে এই ন্যায্য দাবিকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন শ্রমিক নেতৃবৃন্দ। গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিভিন্ন সংগঠন ও জোটের নেতারা বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। এদিকে শ্রমিক অসন্তোষের কড়া মাশুল দিতে যাচ্ছে দেশের তৈরি পোশাক শিল্প। জানুয়ারির আগে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না রফতানি আয় কমার নেতিবাচক ধারা। এমন আশঙ্কার মধ্যেই নতুন করে সব ধরনের নিয়োগ বন্ধের পাশাপাশি ‘নো ওয়ার্ক, নো পে’ নীতিতে কারখানা বন্ধ রাখার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মালিকরা। এ অবস্থায় অটো মাইগ্রেশনসহ কোনো কারণে শ্রমিকরা চাকরি ছাড়লে কারখানাগুলোর চলমান কাজ শেষ হবে কীভাবে সেই প্রশ্ন তুলেছেন পোশাক খাত বিশ্লেষকরা। গত কিছুদিন থেকে অযৌক্তিক মজুরি বাড়ানোর নামে আন্দোলন বা জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় শিল্পকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে বিপর্যয়ের পথেÑ এমন দাবি করে বরাবরই শিল্প মালিকরা নিজেরাই হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছিলেন, যে কোনো ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের চড়া মাশুল গুনতে হবে দেশকেই। তৈরি পোশাক শিল্প বিশেষজ্ঞ অমিত কুমার বিশ্বাস বলেন, অনেকে কাজ ছেড়ে দেয় আবার অনেকে কারখানা পরিবর্তন করে। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে নিয়োগ বন্ধ রাখার এমন সিদ্ধান্তে শ্রমিক হারানো কারখানাগুলো সময়মতো ক্রয়াদেশ শেষ করতে চাপে পড়বে। এ অবস্থায় শিল্প মালিকদের কোনো সিদ্ধান্তে যেন রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সেদিকে বিশেষ নজর রাখার পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের।

 

পূর্ব নির্ধারিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা বলেন, শ্রমিকরা ন্যায্যভাবে যখন মজুরির জন্য আন্দোলন করছেন, তখন সরকার মালিকদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনকারী শ্রমিকদের ওপর গুলি চালাচ্ছে। শ্রমের বিনিময়ে মজুরি চেয়ে শ্রমিকেরা গুলি পাচ্ছেন। ফেডারেশনের নেতারা আন্দোলনে নিহত তিন শ্রমিকের কথা উল্লেখ করে বিচার চান।

রাজনৈতিক প্রলেপ দিয়ে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে আন্দোলনরত শ্রমিক সংগঠনগুলোর একটি জোট ‘মজুরি বৃদ্ধিতে গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন’। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক শ্রমিক সমাবেশে জোটের সমন্বয়ক তাসলিমা আখতার বলেন, সরকারের কাছে আহ্বান জানাতে চাই, শ্রমিকদের মজুরি পুনর্বিবেচনা করুন।

তাসলিমা আখতার বলেন, কারখানা বন্ধ করে দেবেন, শ্রমিকদের ছাঁটাই করবেন, কারাখানায় চাকরি দেওয়া হবে না নানা রকম ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলছেন, এই মজুরি মেনে নিতে হবে। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, শ্রমিকদের মজুরি দিন, যাতে তারা বেঁচে থাকতে পারে। শ্রমিকদের যে আন্দোলন, তার মধ্যে রাজনৈতিক প্রলেপ দিয়ে এই ন্যায্য দাবিকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই।
সাড়ে ১২ হাজার টাকার ন্যূনতম মজুরি কেন গ্রহণযোগ্য নয়, তা ব্যাখ্যা করে ১৫টি শ্রমিক সংগঠনের জোটের নেত্রী তাসলিমা বলেন, আমরা এক বছর ধরে ২৫ হাজার টাকা মজুরি ঘোষণার আন্দোলন করে আসছি। কিন্তু অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মনে লক্ষ্য করলাম, মজুরি বোর্ড, সরকার যে মজুরি ঘোষণা করেছে তা আমাদের আকাক্সক্ষা ধারণ করে না। আমরা যে মজুরি দাবি করেছি, সেই মজুরির ধারে-কাছেও সরকারের সেই ১২ হাজার ৫০০ টাকা আসে না।

মজুরি বোর্ড বলছে, ৫৬ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু আমরা যদি বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট দেখি, তাহলে সেটা ৩৯ শতাংশ হয়। তার থেকে মুদ্রাস্ফীতি হিসাব করলে পেঁয়াজের দাম কত, আলুর দাম কত, প্রত্যেকটা জিনিসের দাম যেই জায়গায় পৌঁছেছে ১২ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে শ্রমিকদের পক্ষে কোনোভাবেই বেঁচে থাকা সম্ভব না। তাই আমরা ১২ হাজার ৫০০ টাকার ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেছি।
তাসলিমা বলেন, আমরা সরকারকে আহ্বান করি, এখনো সময় আছে। ১৪ দিনের মধ্যে যে গেজেট হয়, সেই গেজেট এখনো হয়নি। আমরা সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করি। আমরা আশা করি, মজুরি পুনর্বিবেচনা করে শ্রমিকদের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করবে সরকার।

গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রসহ ১৫টি শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মিছিল নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এই শ্রমিক সমাবেশে যোগ দেয়। তাদের হাতে হাতে ছিল লাল পতাকা ও প্ল্যাকার্ড। ‘গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা ঘোষণা করো’, ‘দয়া-দাক্ষিণ্য নয়, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি ২৫ হাজার টাকা চাই’, ‘স্টপ আরএমজি ওয়ার্কার কিলিং, ‘আঞ্জুয়ারা-রাসেল-ইমরান আমরা তোমাদের ভুলব না’ ইত্যাদি সেøাগান লেখা ছিল সেসব প্ল্যাকার্ডে।

মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে গাজীপুরে বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে গত কয়েক দিনে। সংঘর্ষের মধ্যে প্রাণ গেছে পোশাক শ্রমিক আঞ্জয়ারা, রাসেল ও ইমরানের। সমাবেশ থেকে তাদের হত্যার বিচার দাবি করা হয়।

এ সময় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি মন্টু ঘোষ, শ্রমিক নেতা সাদেকুর রহমান, মাসুদ রেজা, শবনম হাফিজ, বিপ্লব ভট্টাচার্য ও তফাজ্জল হোসেন প্রমুখ।

এদিকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় আরও কঠিন পথে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শিল্প মালিকরা। একযোগে সব কারখানায় সব ধরনের নতুন নিয়োগ বন্ধের মতো কঠিন সিদ্ধান্তের পাশাপাশি কাজ না করলে শ্রমিকরা বেতন পাবেন না নীতিতে চলতে কারখানা মালিকদের নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ দুই সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) ও বিকেএমইএ। পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ গত বৃহস্পতিবার রাতে নতুন করে পোশাক কারখানায় সব ধরনের নিয়োগ বন্ধের পাশাপাশি ‘নো ওয়ার্ক, নো পে’ নীতিতে কারখানা বন্ধ রাখার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসানের সভাপতিত্বে সংগঠনটির প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সমন্বয় সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভার বিস্তারিত সিদ্ধান্ত জানিয়ে সদস্যদের চিঠিও দিয়েছে সংগঠনটি। চিঠি অনুযায়ী, প্রতিটি কারাখানায় গেটে ‘নিয়োগ বন্ধ’ লেখা ব্যানার টাঙিয়ে দিতে হবে।

বিজিএমইএ’র সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম মান্নান কচি বলেন, কারখানা মালিকরা নিয়োগ বন্ধ রাখার জন্য বিজিএমইএকে বলেছেন, এ জন্য বিজিএমইএ ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যতদিন পরিস্থিতি শান্ত না হবে, ততদিন নিয়োগ বন্ধ থাকবে। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিক আন্দোলনের জেরে গত বৃহস্পতিবার আশুলিয়া ও গাজীপুরের কিছু অংশ মিলিয়ে শতাধিক কারখানায় কাজ বন্ধ ছিল। তিনি বলেন, অনেক কারখানাতেই ওয়ার্ক অর্ডার কম। আবার কিছু কারখানায় কাজ আছে, তাদের হয়তো শ্রমিকও প্রয়োজন। কিন্তু শ্রমিকরা কারখানায় এসে কাজ করছে না, এতে কারখানা মালিকদের লোকসান হচ্ছে। আবার নতুন শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে বা কারখানা চালু রেখে এ লোকসান আর তারা বাড়াতে চাচ্ছেন না। তাই এ নিয়োগ বন্ধ থাকবে। অবশ্য এর পেছনে শ্রমিকদেরকে হুমকি দেওয়া মালিকদের উদ্দেশ্য নয় বলে জানান তিনি।

চিঠিতে বলা হয়, যেসব কারখানায় অগ্নি সংযোগ, ভাঙচুর বা মারামারি সংঘটিত হয়েছে, সেসব কারখানা কর্তৃপক্ষকে প্রমাণ হিসেবে ছবি ও ভিডিও ফুটেজ নিয়ে নিকটস্থ থানায় মামলা করতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নাম জানা না থাকলে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা যাবে। মামলার পর এর একটি কপি অবশ্যই সিনিয়র সচিবের কাছে পাঠাতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে। আরও বলা হয়, যেসব শ্রমিকরা কারখানায় গিয়েও কাজ করা থেকে বিরত থাকবেন বা কারখানা ছেড়ে বেরিয়ে যাবেন, সেসব কারখানার মালিকরা বাংলাদেশ শ্রম আইনের ১৩(১) ধারা অনুযায়ী কারখানা বন্ধ করে দেবেন। এর অর্থ কাজ নেই, বেতনও নেই। মামলার পর এর একটি কপি অবশ্যই সিনিয়র সচিবের কাছে পাঠাতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে।

সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, নিয়োগ বন্ধ, কিংবা কারখানা বন্ধ রাখা কোনো সমাধান নয়। নিয়োগ বন্ধ রাখলে তাদের কারখানা চলবে কীভাবে? তিনি মনে করেন, মালিকপক্ষের এ সিদ্ধান্ত শ্রমিকদের ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে কারখানা বন্ধ রেখে একদিনে যে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, বেতন বাড়ালে ওই পরিমাণ টাকাও লাগত না। এই শ্রমিক নেতা বলেন, মালিকপক্ষের ওপরের লেভেলে যাওয়ার সুযোগ আছে, কিন্তু শ্রমিকদের কথা শোনার তো কেউ নেই। গত বৃহস্পতিবারের সমন্বয় সভায় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির সাবেক সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম, সংগঠনটির আরেক সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী, সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম মান্নান (কচি) প্রমুখ।

বিজিএমইএ’র ‘নো ওয়ার্ক, নো পে’ নীতিতে পোশাক খাত সংশ্লিষ্টদের মত, শ্রমিক অসন্তোষের কড়া মাশুল দিতে যাচ্ছে দেশের তৈরি পোশাক শিল্প। জানুয়ারির আগে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না রফতানি আয় কমার নেতিবাচক ধারা। এদিকে এ অবস্থায় অটো মাইগ্রেশনসহ কোনো কারণে শ্রমিকরা চাকরি ছাড়লে কারখানাগুলোর চলমান কাজ শেষ হবে কীভাবে সে নিয়েও উদ্বিগ্ন মালিকপক্ষ।

তথ্য মতে, চলতি বছরের আগস্টে ৪০৪ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের পর প্রায় ৪৩ কোটি ডলার কমে সেপ্টেম্বরে পোশাক খাতের রফতানি আয় নামে ৩৬১ কোটি ৮৯ লাখ ডলারে। সেখান থেকে আরও ৪৫ কোটি ডলার কমে গত অক্টোবরে দেশের তৈরি পোশাক খাতের রফতানি আয় আসে ৩১৬ কোটি ৫৬ লাখ ডলার; যা এক বছর আগের তুলনায় প্রায় ১৪ শতাংশ কম। এর মধ্যে আবার অটেক্সা জানিয়েছে, এক বছর আগের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের রফতানি কমেছে ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

যখন যুদ্ধ আর মূল্যস্ফীতির চাপে বিশ্ববাজার থেকে আসছে হতাশার খবর তখন আবার বেশ কিছু দিন ধরেই কারখানা ভাঙচুর আর শ্রমিক অসন্তোষে অস্থিরতা বিরাজ করছে দেশের তৈরি পোশাক খাতে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, অনেক শ্রমিক অটো মাইগ্রেশন বা অন্য কোনো কারণে এক কারখানা ছেড়ে অন্য কারখানায় যোগ দেয়ার পরিকল্পনা করতে পারে। তারা যাতে জায়গা পরিবর্তন করতে না পারে তার জন্যই নিয়োগ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

তবে খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিমাসে স্বাভাবিকভাবে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত শ্রমিক-কর্মচারী, কর্মকর্তা বাড়তি সুবিধা নিয়ে কারখানা বদল করে থাকেন। নিয়োগ বন্ধ রাখার এমন সিদ্ধান্ত শ্রমিক হারানো কারখানাগুলোকে চাপে ফেলতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

https://dailyinqilab.com/national/article/616263