১০ নভেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ১২:৩৪

অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির

 

শঙ্কায় আমদানি-রফতানিকারক শিল্পোদ্যোক্তরা : ২৫ শতাংশ বেড়েছে পরিবহন ভাড়া
টানা অবরোধে দিনে দিনে স্থবির হয়ে পড়ছে সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি কার্যক্রম। তাতে থমকে যাচ্ছে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকা-। দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম বন্দরে কার্গো ও কন্টেইনার ডেলিভারি এবং হ্যান্ডলিং ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে আমদানি পণ্যবাহী কন্টেইনার ডেলিভারি কমে যাচ্ছে। এতে বন্দর ও বেসরকারি ডিপোতে কন্টেইনারের স্তুপ জমছে। যথাসময়ে রফতানি পণ্য জাহাজীকরণও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। পরিবহনে ভাড়া বাড়ছে লাফিয়ে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ভোক্ত পর্যায়ে। বাড়ছে পণ্যের দাম। যথা সময়ে আমদানিকৃত কাঁচামাল কারখানায় নেওয়া যাচ্ছে না। এতে শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি আমদানি-রফতানিকারক, বিনিয়োগকারী, শিল্পোদ্যোক্তাসহ সংশ্লিষ্টদের মাঝে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা বিরাজ করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আমদানি-রফতানিতে মন্দা অবস্থা রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে। চার মাসে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

গত ২৯ অক্টোবর পূর্ণ দিবস হরতালের পর থেকে চলছে বিরতি দিয়ে অবরোধ। আজ সকালে শেষ হয়েছে ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ। আগামী রোববার সকাল ৬টা থেকে ফের শুরু হচ্ছে দুই দিনের অবরোধ। অবরোধ আর হরতালে পণ্য পরিবহন বিঘিœত হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কে পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। আমদানি-রফতানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভয় আতঙ্কে রাস্তায় গাড়ি নামাতে চাচ্ছেন না অনেকে। অবরোধের কারণে মহাসড়কে পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাস স্বাভাবিক হলেও ডেলিভারী পরিবহন করতে না পারায় বিপাকে পড়েছেন আমদানিকারকেরা। এ সুযোগে পরিবহন মালিক চালকেরা ভাড়া বাড়িয়েছেন প্রায় ২৫ শতাংশ। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সারাদেশে প্রায় ছয় হাজার পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, টেইলর আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহন করে। সব ধরনের পরিবহনের ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় আমদানি-রফতানি ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, বৈশি^ক অর্থনৈতিক মন্দা ও ডলার সঙ্কটের কারণে এমনিতেই আমদানি-রফতানি কমে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী কন্টেইনার এবং কার্গোর পরিমাণ আগের তুলনায় কমেছে। এ কারণে হয়তো বন্দরে জট পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি। তবে লাগাতার অবরোধ অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। তিনি বলেন, অবরোধে চোরাগুপ্তা হামলার ভয়ে আমদানি-রফতানিকারকেরা পণ্য পরিবহন করতে সাহস পাচ্ছেন না। কারখানায় উৎপাদিত রফতানি পণ্য যথাসময়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠিয়ে জাহাজিকরণ করা যাবে কিনা তাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আবার আমদানি পণ্যও বিশেষ করে শিল্পের কাঁচামাল যথাসময়ে শিল্প কারখানায় পৌঁছানো যাচ্ছে না। এতে সবাই লোকসানের মুখে পড়ছেন। পরিবহন ভাড়া ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর নেতিবাচক প্রভাব ভোক্তার উপরে পড়ছে। বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, হরতাল অবরোধের কারণে কারখানায় শ্রমিকের উপস্থিতি কমে গেছে। এতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। যাতায়াত খাতে শ্রমিকদেরও খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের দামও বাড়ছে। যথাসময়ে রফতানি পণ্য বন্দরে পাঠানো এবং আমদানি কাঁচামাল কারখানায় পৌঁছানো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তৈরি পোশাক খাত কঠিন সময় অতিক্রম করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলেছে।

একের পর এক হরতাল ও টানা অবরোধে ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য পৌঁছাতে না পারায় তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রফতানি সামগ্রীর শিপমেন্ট বাতিল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নিরাপত্তার কারণে অনেকে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান বের করছেন না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে লরি, কাভার্ডভ্যানসহ পণ্যবাহী গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিয়ে পরিবহন মালিকরা যেমন পণ্য পরিবহনে রাজি হচ্ছেন না তেমনি আমদানি রফতানিকারকরাও কোটি কোটি টাকার পণ্য এভাবে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতে সাহস পাচ্ছেন না। ফলে আমদানি রফতানি বাণিজ্যে মন্দা নেমে আসছে। ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান সঙ্কটে ভাড়াও বেড়ে গেছে।

অবরোধের কারণে দেশের প্রধান পাইকারি বাজার চাক্তাই খাতুনগঞ্জের বেচাকেনাও কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্বাভাবিক দিনের তুলনায় অবরোধে ২০ শতাংশও বিক্রি হয় না। এতে ব্যবসায়ীরা ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন। আমদানি করা পণ্য খালাস এবং পরিবহন ব্যাহত হওয়ায় বাজারে সরবরাহ কমছে তাতে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। নগরীর সার্বিক ব্যবসা বাণিজ্যও স্থবির হয়ে পড়েছে। মার্কেট বিপণি কেন্দ্রগুলো ফাঁকা। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন খুদে ব্যবসায়ীরা।

অবরোধের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আহরণে। দেশের প্রধান রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান কাস্টম হাউস রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ২২ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। আর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৫ হাজার ৯৭ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দুই হাজার ৫৭০ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অর্থবছর শেষে ৭৭ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বলে মনে করেন কাস্টমসের কর্মকর্তারা।

মিছিল, পিকেটিং সড়ক অবরোধ গ্রেফতার ২০ : তৃতীয় দফায় ৪৮ ঘণ্টা অবরোধের গতকাল শেষ দিনেও সক্রিয় ছিল বিএনপির নেতাকর্মীরা। অবরোধের সমর্থনে মহানগরী ও জেলার বিভিন্ন এলাকায় মিছিল, পিকেটিং ও সমাবেশ হয়েছে। টানা পুলিশি অভিযানে আরও ২০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, নগরীর বায়েজিদ, জালালাবাদ, প্রবর্তক মোড়, চকবাজার, পাহাড়তলী ডি টি রোড, আমবাগান, চান্দগাঁও, জাকির হোসেন রোড, হালিশহর, বাহির সিগন্যাল, উত্তর পাহাড়তলী, বোয়ালখালীর গোমদন্ডী, ফুলতলী, চট্টগ্রাম-রাঙামাটি ও চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়কে অবরোধ ও পিকেটিং করা হয়। দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, পটিয়া এবং বাঁশখালীতেও সড়ক অবরোধ এবং পিকেটিং করেছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। গতকাল পর্যন্ত ১৩টি মামলায় ২৮৫ জন বিএনপির নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

https://dailyinqilab.com/national/article/616025