১০ নভেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ১২:৩৩

গাজীপুরে শ্রমিক বিক্ষোভ সংঘর্ষ, গুলি

 

নতুন মজুরি কাঠামো প্রত্যাখ্যান করে সর্বনিম্ন মজুরি ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে গাজীপুর ও সাভারের আশুলিয়ায় ফের বিক্ষোভ করেছেন পোশাক শ্রমিকরা। এতে গতকাল দিনব্যাপী থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করে গাজীপুর ও আশুলিয়ায়। শ্রমিকরা কয়েকদফা সড়ক অবরোধ করতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বাধা দেয়। এতে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। শ্রমিকরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে সংঘর্ষ বাধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে। এদিন বেশ কয়েকটি গার্মেন্টসও ভাঙচুর করেছে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। এ ছাড়া দিনব্যাপী এসব ঘটনায় কয়েকজনকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সংঘর্ষের সময় পুলিশ কর্মকর্তাসহ কয়েকজন পোশাক শ্রমিকও আহত হয়েছেন। 

গতকাল সকাল সাড়ে ৮টা থেকেই উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করে গাজীপুরের নাওজোড় এলাকায়। সকালে ওই এলাকার পোশাক শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে গেলেও সাড়ে ৮টার দিকে তাদের ছুটি দিয়ে গার্মেন্টসগুলো বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এরপর সকাল ১০টার দিকে গার্মেন্টস থেকে বেরিয়ে কোনাবাড়ীর নাওজোড় এলাকার ঢাকা-টাঙ্গাইল বাইপাস সড়কে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা।

এক পর্যায়ে টায়ার জ্বালিয়ে, রাস্তার ওপর কাঠ ও বাঁশ ফেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সড়ক অবরোধ করেন তারা। পরে পুলিশ সেখানে গেলে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয়।  

বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা জানান, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা করা অযৌক্তিক। এতে তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয় সমন্বয় হবে না। জেনিসিস ফ্যাশন লিমিটেডের সিপিডি ম্যানেজার রকিবুজ্জামান বলেন, সকালে আমরা উত্তপ্ত পরিস্থিতি দেখে শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে গার্মেন্টস বন্ধ করে দেই। এরপর বাইরে তারা বিক্ষোভ করে। জে কে গার্মেন্টসের নিরাপত্তা রক্ষীরা জানায়, সকালে বিক্ষোভের সময় তাদের গার্মেন্টসের প্রধান ফটকে ভাঙচুর চালানো হয়।

বিজিবি’র গাজীপুর ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রফিকুল ইসলাম বলেন, নাওরোজের আশপাশের গার্মেন্টস শ্রমিকরা আগুন জ্বালিয়ে বিশৃঙ্খলা করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের রিজার্ভসহ ২২ প্লাটুন বিজিবি নিয়োজিত আছে।

সকাল থেকে গাজীপুরে সতর্ক অবস্থায় ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মহানগরীর বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে পুলিশ, বিজিবি, র‍্যাব ও আনসার ব্যাটালিয়ানের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। ঢাকা-টাঙ্গাইল বাইপাস সড়কে বিজিবি’র সাঁজোয়া যানসহ র‍্যাবের গাড়িবহরে করে পুরো এলাকা টহল দিয়েছে তারা। তবে দুপুরের দিকে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠে গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকা। এ সময় পুলিশ শ্রমিকদের উদ্দেশ্য করে হ্যান্ড মাইকে সতর্ক করে নিজ নিজ কাজে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানায়। তবে দুপুর পৌনে ৩টার দিকে কোনাবাড়ীতে কাঠের ও প্লাস্টিকের টুল ফেলে কয়েকদফা সড়ক বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করেন গার্মেন্টস শ্রমিকরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে সড়ক স্বাভাবিক রাখেন। এসময় তাদের দিকে ইটপাটকেল ও জুতা ছুড়ে মারে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখতে টিয়ারশেলও নিক্ষেপ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গাজীপুর র‍্যাব-১ পোড়াবাড়ি ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মেজর মো. ইয়াসির আরাফাত হোসেন জানান, সকাল থেকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ৮ জনকে আটক করা  হয়েছে। এরমধ্যে নাওজোড় থেকে ২ জন ও বাকিদের কোনাপাড়া থেকে আটক করা হয়। তিনি বলেন, শ্রমিকদের প্রথমে আমরা শান্ত থাকতে অনুরোধ করি। তারা আমাদের অনুরোধ উপেক্ষা করে আন্দোলনে নামেন এবং তারা নাশকতামূলক কাজ শুরু করেন। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শ্রমিকদের সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন।

বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠে কোনাবাড়ী এলাকা। তখন টুসুকা টাউজার্স লিমিটেড নামের একটি গার্মেন্টসে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। পরে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে পুলিশ গার্মেন্টসের ভেতরে প্রবেশ করে শ্রমিকদের বাইরে বের করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। 

এর আগে মঙ্গলবার পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করে মজুরি বোর্ড। ওই সিদ্ধান্তে শ্রমিকরা সন্তুষ্ট না হওয়ায় বুধবার সকাল থেকে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করেন তারা। এদিন পুলিশের ছোড়া গুলিতে আঞ্জুয়ারা বেগম (২৪) নামের এক নারী শ্রমিক নিহত হন। এ ছাড়া জামাল উদ্দিন নামে আরও এক শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। 

আশুলিয়ায় পুলিশ-শ্রমিক ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, এসপিসহ আহত ১০: ওদিকে ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে সাভারের আশুলিয়ায় বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছেন। সকাল ১১টার দিকে টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কের নরসিংহপুর ও নিশ্চিন্তপুর এলাকার রাস্তায় অবস্থান নিয়ে ঘোষণাকৃত চূড়ান্ত মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা প্রত্যাখানে স্লোগান দিতে থাকেন তারা। এসময় পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করলে বিক্ষোভকারীরা উল্টো পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। উভয় পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় ইটের আঘাতে আহত হন আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর সহকারী পুলিশ সুপার রশিদুল ইসলাম বারি, হা-মীম গ্রুপের শ্রমিক আরিফ, নাসির নামের এক কাভার্ডভ্যান মালিকসহ অন্তত ১০ জন। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে গাজীপুর ও সাভারে চলা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আশুলিয়ার জামগড়া, বেরণ, ছয়তলা ও নরসিংহপুর এলাকার বেশ কয়েকটি গার্মেন্টস কারখানায় বৃহস্পতিবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। যে কয়েকটি খোলা ছিল সেগুলোয় স্বাভাবিক নিয়মেই সকালে দলবেঁধে কাজে যোগ দেন শ্রমিকরা। কিন্তু সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আশুলিয়ার বেরণ এলাকার এ.এম ডিজাইন ও এনভয় গার্মেন্টসের শ্রমিকরা কারখানার বাইরে বেরিয়ে আসেন। এরপর আশপাশের সেতারা, স্টারলিংকসহ আরও বেশ কিছু কারখানার শ্রমিকরাও কাজ না করে গেটের বাইরে বেরিয়ে সড়কে অবস্থান নেন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সড়কের দুই পাশের সব কারখানা ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। পরে বেলা ১১টার দিকে টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কের নরসিংহপুর এলাকার শারমিন ও হা-মীম গ্রুপের শ্রমিকরা সড়কে নেমে বিক্ষোভ শুরু করেন। তাদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। পুলিশও তাদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। পরে অতিরিক্ত পুলিশ, সাঁজোয়া যান, বিজিবি ও র‌্যাব সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি শান্ত করেন। 

বিক্ষোভকারী এ.এম ডিজাইন লিমিটেড কারখানার অপারেটর লিটন বলেন, আমরা গার্মেন্টস শ্রমিকেরা দিন-রাত কাজ করেও ঠিকমতো খাইতে পারি না। সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ দিতে পারি না। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে প্রডাকশন টার্গেট পূরণ করতে যে পুষ্টি দরকার তার চাহিদাও আমরা পূরণ করতে পারি না। যে বেতন বাড়ানো হয়েছে সেটা পর্যাপ্ত না হওয়ায় আমরা আন্দোলন করছি। 

শ্রমিক হাফিজুর বলেন, বেতন বাড়ানোর পরে আমার বেতন হয়েছে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতির কাছে আমরা হেরে যাচ্ছি। এক কেজি পিয়াজের দাম ১২০ টাকা, আমরা খাবো কি? তিনি বলেন, পেটের দায়ে আমরা এত কষ্ট করি। কিন্তু সাড়ে ১২ হাজার টাকায় আমাদের সংসার চলে না। 

এদিকে আহত শ্রমিক আরিফ বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে আমরা প্রতিদিনের মতো কারখানায় প্রবেশ করে কাজ করছিলাম। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে  কারখানার বাইরে সড়কে অন্য কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরু করলে আমাদেরকেও ছুটি দিয়ে দেয়া হয়। তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে যাওয়ায় আমিসহ আরও বেশ কয়েকজন শান্তিপূর্ণভাবে বাসায় ফিরে যাচ্ছিলাম। এ সময় বিক্ষোভকারীদের ছোড়া ইটের আঘাতে আমি আহত হই। আশেপাশের লোকজন তখন আমাকে স্থানীয় নারী ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে যান। তিনি ছাড়াও  আরও বেশ কয়েকজন শ্রমিক সামান্য আহত হয়েছেন বলে জানান আরিফ। 

ভাঙচুর করা কাভার্ডভ্যানের চালক সিদ্দিক বলেন, সকালে গাড়িটি নিয়ে ইপিজেড থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন গাড়ির মালিক নাসির। তিনি গাড়ি নিয়ে নরসিংহপুর এলাকা পার হওয়ার সময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কাভার্ডভ্যানে ভাঙচুর চালায়। গাড়ির সামনের গ্লাস, চুরমার করে দেয় তারা। গাড়িটিকে বাঁচাতে গিয়ে ইটের আঘাতে মালিক নাসিরও আহত হয়েছেন। বর্তমানে তিনি হাসপাতালে ভর্তি। তাই আমি গাড়িটি নিয়ে যাচ্ছি।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক (ওসি) রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বিপ্লব  বলেন, বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে নরসিংহপুরের হা-মীম গ্রুপের শ্রমিকরা সড়কে নেমে বিক্ষোভ করেন। পুলিশ টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করলে তারা সড়ক ছেড়ে চলে যায়। 

এ ব্যাপারে আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম বলেন, শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন। পরে বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বেরিয়ে সড়কে অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করেন। পরিস্থিতি শান্ত করতে গিয়ে শ্রমিকদের ছোড়া ইটের আঘাতে আমাদের সহকারী পুলিশ সুপার রাশিদুল বারি আহত হয়েছেন। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ওই এলাকার প্রায় পাঁচ থেকে ছয়টি কারখানায় বৃহস্পতিবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এরপরও শ্রমিকরা জটলা পাকানোর চেষ্টা করেছে। যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। 
মজুরি নিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলনের বিষয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার শ্রমিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় আইনবিষয়ক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু বলেন, নতুন ঘোষিত মজুরি নিয়ে শ্রমিকরা ধোঁয়াশায় থাকায় তাদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। এখনো বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের জামগড়া থেকে জিরাব এলাকা পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক কারখানা বন্ধ রয়েছে। আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে মজুরি বোর্ডের কাছে আইন অনুযায়ী ঘোষিত মজুরি রিভিউ করার আবেদন জানানো হবে।

https://mzamin.com/news.php?news=82821