১০ নভেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ১২:৩২

পেট লইয়্যাই বাঁচি না জামিন করমু কীভাবে

 

‘এত টেকা পামু কোথায়? অভাবের সংসার। তিন বেলা খাওন জোটে না। অহন আদালতে আইস্যা পোলাডারে দেখতেই নাকি ৫ শ’ টেকা লাগবো। পুলিশ কইলো এক টেকা কমেও হবে না। সক্কাল থেকে হাজতখানার সামনে বইস্যা আছি। আমার পোলা রিকশা চালায়। মঙ্গলবার সকালে কেরানীগঞ্জ শুভ্যাঢা মোড়ে আইতেই পুলিশ গাড়িতে তুলে লইয়্যা  গেছে। রিকশা রাইখ্যা দোকানে সিগারেট খাইতেছিলো। তখন পুলিশ অন্য মানুষের সাথে পোলারেও গাড়িতে তুলে নেয়। থানায় গেলাম পুলিশ আমার কোনো কথাই শুনলো না।

পুলিশ কয় হেয় নাকি বিএনপি করে। আমরা কোনো রাজনীতি করি না। পেট লইয়্যাই বাঁচি না। তারপরেও  জেলে যাইতে হইলো। পোলাডারে একনজর দেখার টেকাই নাই, জামিন করামু কীভাবে? আমার পোলার অপরাধ কী? কেন পুলিশ তারে ধরে আনবো। কার কাছে বিচার দিমু। গরিবের কথা কে শুনবে?’ এভাবেই বলছিলেন পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার রিকশাচালক উজ্জ্বলের মা বিলকিস বেগম। 

বিলকিস বেগম বলেন, আমার পোলা একটু চা-পান খায়। শুনলাম, সে রিকশা রেখে চায়ের দোকানে ঢুকে চা খাচ্ছিলো। তখন পুলিশ গিয়ে সবাইকে ধরে নিয়া গেছে। অহন আদালতে আনছে। কি মামলা দিলো তাও জানতে পারি নাই। স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীকে গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায়। বিএনপি নেতা শহিদুল ইসলাম। ক্যান্টনমেন্ট থানা ১৫ নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সভাপতি। ২৮ তারিখ রাতে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা রিফতি হোসেন রবিন মানিকদী বাজার এলাকায় শহিদুলের বাসায় গিয়ে তার খোঁজ করেন। পরে গভীর রাতে পুলিশ নিয়ে এসে শহিদুলকে টেনেহেঁচড়ে বাসা থেকে নিয়ে যান। রাতেই শহিদুলের স্ত্রী জোৎস্না বেগম ও তার ছেলে মেহেদী হাসান থানায় যায়। তখন পুলিশ তাদের ওপর চড়াও হয়। পুলিশের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ালে একপর্যায়ে স্ত্রী জোৎস্না বেগমকেও গ্রেপ্তার করে। বাড়াবাড়ি করলে ছেলে মেহেদীকেও গ্রেপ্তার করা হবে জানালে, পরে মেহেদী থানা থেকে চলে যান। বুধবার ঢাকার সিএমএম কোর্টে কথা হয় শহিদুল ইসলামের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে মেহেদী হাসানের সঙ্গে। 

তিনি বলেন, ছাত্রলীগ নেতা রিফতি হাসান রনির কাছে আমরা কিছু টাকা পেতাম। টাকা ফেরত চাওয়ায় সে আমাদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই মিথ্যা প্রচার করে পুলিশ এনে আমার বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। গ্রেপ্তারের সময় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতা আমাদের বাসায় আসে। তারা সবাই অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। আমার মা বাধা দিলে তাকেও মারতে তেড়ে আসে। পরে পুলিশ বাবাকে থানায় নিয়ে গেলে মা সেখানে গিয়ে গ্রেপ্তারের কারণ জানতে চাইলে পুলিশ তাকেও গ্রেপ্তার করে। ২৯ তারিখ জামিন চেয়েছিলাম, আদালত জামিন দেয়নি। আবার জামিন চাইতে এসেছি। গত ৫ই অক্টোবর অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুলের গেইট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন জাকির হোসেন। চলন্ত বাস থামিয়ে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। অন্যদের সঙ্গে বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরিরত জাকির হোসেনকেও গ্রেপ্তার করা হয়। পরে বিস্ফোরক মামলা দিয়ে আদালতে পাঠালে আদালত তাদের ৩ দিনের রিমান্ড দেন। জাকির হোসেনের মা আয়েশা বেগম ছেলেকে দেখতে ভোলার দৌলতখান থেকে এসে ঢাকার সিএমএম কোর্টের হাজতখানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। 

জানতে চাওয়া হলে তিনি মানবজমিনকে বলেন, আমার ছেলের মাথার রোগ আছে। মাঝেমধ্যে পাগল হয়ে যায়। ওষুধ খাইলে আবার ঠিক হয়। ২ দিন আগে থানা থেকে ফোন করে আমাকে জানালো ছেলে নাকি গ্রেপ্তার হইছে। আমার ছেলে কেন গ্রেপ্তার হইবো? আমার পোলার নামে কোনোদিন কোনো মামলা ছিল না। শুধু শুধু ওরে ধরে নিয়ে বিএনপি’র মামলা দিছে। জাকিরের বয়স ২৫ বছর। ৪ বছর আগে ওর বাবা মারা গেছে। সংসার চলে জাকিরের রোজগারে। অহন আমার কী হবে? আমরা কী খেয়ে বাঁচমু? আমার ছেলে কোনো রাজনীতি করে না। কোনোদিন কোনো মিছিলেও যায়নি। তবুও ওরে ধরে আনছে। ওরা আমার ছেলেটাকে অনেক মেরেছে। হাজত থেকে আদালতে তোলার সময় দেখা হয়েছে। ছেলেটা ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না। আমি ২ হাজার টাকা ধার করে ভোলা থেকে আদালতে আসছি। উকিল ধরতে পারি না। আমার অসুস্থ ছেলেটাকে নাকি ৩ দিনের রিমান্ডে দিছে। এহন ভাতই পামু না, ছেলেকে ছাড়ামু কীভাবে। ৩রা অক্টোবর আদাবর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক  শফিকুল ইসলাম মানিককে দোকান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপরে ৪ দিন কোনো খোঁজ ছিল না মানিকের। পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তাকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার মানিককে আদালতে তোলা হয়। 

ঢাকার সিএমএম আদালতে দেখা যায়, বেলা ১২টার পর থেকে প্রিজন ভ্যানে করে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের আদালতের হাজতখানায় নিয়ে আসে পুলিশ। ঢাকার বিভিন্ন থানা থেকে তাদের আদালতে হাজির করা হয়। সকাল থেকেই হাজতখানার সামনে আসামিদের স্বজনদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। একের পর এক প্রিজন ভ্যান আসছে আর স্বজনরা এগিয়ে গিয়ে কথা বলছেন। গত ২৮শে অক্টোবর রাজধানীর ওয়ারী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন মো. মাহতাব। তার স্ত্রী জোহরা খাতুন আজ আদালতে আসেন। তিনি বলেন, আমার স্বামীর আয়ে সংসার চলতো। এখন স্বামী জেলে। জামিনও পাচ্ছে না। আমরা অনেক কষ্টে আছি। আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুযায়ী, গত ২৮শে অক্টোবর থেকে ৯ই নভেম্বর পর্যন্ত ১৩ দিনে ঢাকায় বিএনপি’র ৩১৯১ জন নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই সময়ে কেউই জামিন পাননি। দু’একজন জামিন পেলেও তাদের অন্য মামলায় পরোয়ানা দেখিয়ে কারাফটক থেকে আবারো গ্রেপ্তার করা হয়। অনেকে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েও কারামুক্ত হতে পারছেন না।

https://mzamin.com/news.php?news=82824