১০ নভেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ১২:২৬

রেমিট্যান্স আহরণে বিশৃঙ্খলা

বাফেদা এবিবির সিদ্ধান্ত মানছে না অনেক ব্যাংক

 

 

সিদ্ধান্ত ছিল রেমিট্যান্সের ডলার ১১৫ টাকার বেশি মূল্যে কেনা যাবে না। কিন্তু কোনো কোনো ব্যাংক রেমিট্যান্স আহরণ করতে ১২৬ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করছে। যারা নিয়ম মানছে তারা রেমিট্যান্স আহরণে পিছিয়ে যাচ্ছে। রেমিট্যান্স আহরণের মূল্য নিয়ে এ বিশৃঙ্খলার কারণে ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা। এমন পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্স আহরণে শৃঙ্খলা ফেরাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন খোদ বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স এসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংকারদের শীর্ষ সংগঠন এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) নেতৃবৃন্দ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আগে আন্তঃব্যাংকে ডলারের দাম নির্ধারণ করে দিতো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে আইএএমএফ’র কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রত্যেক্ষভাবে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে হস্তক্ষেপ করছে না। বাফেদা ও এবিবির সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। যদিও এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরোক্ষ হস্তক্ষেপ থাকে বলে জানা গেছে। সর্বশেষ বাফেদা ও এবিবি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ব্যাংকগুলো প্রতি ডলার ১১৬ টাকার বেশি মূল্যে রেমিট্যান্স আহরণ করতে পারবে না। তবে বিক্রি করতে হবে ১১১ টাকা মূল্যে। কিন্তু বাফেদার এ সিদ্ধান্ত বেশির ভাগ ব্যাংকই মানছে না।

বাফেদার নির্বাহী কমিটিতে আছেন এমন একটি ব্যাংকের এমডি গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে দিন থেকেই ডলারের মূল্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত বাফেদা ও এবিবির ওপর ছেড়ে দিয়েছিল সেই দিন থেকেই এক শ্রেণীর ব্যাংক সিদ্ধান্ত মানছে না। যখন বাফেদা রেমিট্যান্সের মূল্য ১০৭ টাকা নির্ধারণ করেছিল তখনো এক শ্রেণীর ব্যাংক ১১২ টাকা থেকে ১১৪ টাকায় রেমিট্যান্স আহরণ করে। বর্তমানে ডলার সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করায় বেশি দামে অনেক ব্যাংকই রেমিট্যান্স আহরণ করছে।

অপর একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, গত সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স ১৩০ কোটি ডলারের ঘরে নেমে গিয়েছিল, যা ছিল বিগত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর অন্যতম কারণ ছিল রেমিট্যান্সের মূল্য বাজার মূল্যের চেয়ে কম মূল্য নির্ধারণ করা। আর এ কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ বিষয়ে কিছু শিথিলতা দেয়া হয়। আর ওই শিথিলতার কারণেই বেশি দাম দিয়ে অনেকেই রেমিট্যান্স আহরণ করে। যার প্রভাব পড়ে অক্টোবরের রেমিট্যান্সে। অক্টোবরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৯০ কোটি ডলারের উপরে উঠে যায়। ওই ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলো বেশি দামে ডলার আহরণ করলেও তেমন কিছু দেখা হবে না এমন আশ্বাস দেয়া হয়েছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে। আর এ সুযোগ দেয়া হয়েছিল নভেম্বর, ডিসেম্বরের জন্য। কিন্তু বাফেদা ও এবিবি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রেমিট্যান্স আহরণ সর্বোচ্চ করতে পারবে ১১৬ টাকায় আর বিক্রি করতে পারবে ১১১ টাকায়। কিন্তু গত কয়েক দিন যাবত কোনো কোনো ব্যাংক ১২৬ টাকা দরে পর্যন্ত রেমিট্যান্স আহরণ করেছে। যার সঙ্কট রয়েছে ওই ব্যাংক বেশি দরে রেমিট্যান্স আহরণ করছে। আর যে ব্যাংকের সঙ্কট নেই ওই ব্যাংক কম দরে রেমিট্যান্স আহরণ করছে। এখানেই বিপত্তি বাধে। কারণ, বিদেশী এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো যে ব্যাংক বেশি দাম দিচ্ছে তাদের কাছেই বেশি হারে রেমিট্যান্স দিচ্ছে। অপেক্ষাকৃত কম রেটের ব্যাংকগুলোকে কম রেমিট্যান্স দিচ্ছে। রেমিট্যান্স আহরণের এ বিশৃঙ্খলার কারণে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারেও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে গতকাল বাফেদা ও এবিবি নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে বৈঠক করে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে বাফেদা ও এবিবির নেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ২১টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং নির্বাহী পরিচালকরা।

বৈঠক শেষে এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ এবিবির চেয়ারম্যান এবং ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসাইন সাংবাদিকদের বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্কটে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। এই সমস্যা সমাধানে আমাদের সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে। আমাদের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো ব্যাংক চাইলে ১১৬ টাকা পর্যন্ত রেমিট্যান্স কিনতে পারবে। কিন্তু ১১১ টাকার বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে না। তার পরেও যারা নির্দেশনা ভঙ্গ করছেন তাদের সাথেও কথা হয়েছে। আমরা একত্রে বাজারটাকে স্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে আসব। আমদানিকারকরা নির্ধারিত দামে ডলার পাচ্ছে না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যদি কোনো আমদানিকারকের এরকম অভিযোগ থাকে তা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এসে জানাতে হবে। তা ছাড়া সব বিষয়ে লাইন বাই লাইন লিখিতভাবে নির্দেশনা দেয়া যায় না বলেও মনে করেন এই ব্যাংকার।

বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এবং মুখপাত্র মো: মেজবাউল হক বলেন, সংগঠন দুটির মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্ত ঠিক মতো বাস্তবায়নের জন্য সাহায্য চাইতে এসেছিলেন তারা। আমরাও জানিয়েছি সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে। নির্দেশনার বাইরে কোনো ব্যাংক অথবা এক্সচেঞ্জ হাউজ ডলার কেনাবেচা করলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিষয়টি আগের চেয়ে শক্তভাবে তদারকি করা হবে এখন। তাই প্রয়োজন হলে সর্বোচ্চ আড়াই শতাংশ অতিরিক্ত প্রণোদনা দিয়ে ডলার সংগ্রহ করা যাবে। কিন্তু এর বেশি নয়। যদি কেউ বেশি দামে ডলার কিনেও থাকে তা হলে ১১১ টাকাতেই বিক্রি করতে হবে। অন্যথায় আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ দিকে খোলাবাজারে খোঁজ নিয়ে যানা গেছে, এক দিনেই সাড়ে চার টাকা বেড়ে আজ বিক্রি হচ্ছে ১২৬ টাকা ৫০ পয়সায়। গতকাল বুধবারও যা ছিল ১২২ থেকে ১২৩ টাকা। এর আগে কখনো ডলারের দর এত উঠেনি বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/790374