১০ নভেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ১২:২৩

ইসির নির্বাচনী তোড়জোড়

-তোফাজ্জল হোসাইন

 

রাজনীতির মাঠে সঙ্ঘাত আর সহিংসতার মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ৯০ দিনের ক্ষণ গণনা শুরু হয়েছে। সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী, ১ নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে এ নির্বাচন শেষ করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।
নির্বাচন আয়োজনের সব প্রস্তুতি এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি রেওয়াজ অনুযায়ী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রাষ্ট্রপতিকে সার্বিক বিষয়ে অবহিত করার কথা কমিশনের। সেই অনুযায়ী, গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে দেখা করেছে কমিশন।

২০১৪ সালের মতো এবারো নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে মতপার্থক্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তৈরি হয়েছে উত্তেজনা। বিএনপি ও সমমনাদের হরতাল ও অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে চলছে সঙ্ঘাত আর প্রাণহানি। জনমনে বাড়ছে উদ্বেগ। বিশেষ করে ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশে হামলা মামলার পর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। সাড়ে আট হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে দলটিকে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা করছে সরকার। এতে করে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। নিপীড়নের পথ পরিহারের আহবান জানিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠন।

এমন পরিস্থিতিতে আলোচনার মাধ্যমে মতভেদ নিরসন ও সমাধানের পথ খোঁজার পরামর্শ আসছে পর্যবেক্ষক মহল থেকে। কিন্তু এখনও সমঝোতার তেমন কোনো আভাস মিলছে না।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল গত সপ্তাহে বলেছিলেন, ভোটের কাক্সিক্ষত পরিবেশ এখনো হয়নি। তবে মঙ্গলবার তিনি এও বলেছেন, পরিবেশ প্রতিকূল হলেও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় ভোট করা ছাড়া কোনো বিকল্প নির্বাচন কমিশনের নেই। আর গতকাল রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, যেকোনো মূল্যে নির্বাচন করতে হবে, দ্রুত তফসিল ঘোষণা।

নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপের আয়োজন করে। ৪৪টি দলকে সংলাপের চিঠি পাঠানো হয়। এতে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলসহ ১৮টি দল অংশ নেয়, প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ২৬টি দল সংলাপে সাড়া দেয়নি। সংলাপ শেষে ১৮ দল (বেশির ভাগই নামসর্বস্ব) সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়। আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি সবার একটাই কথা, ক্ষমতাসীন দল দলীয় নেতাকর্মীদের দিয়ে প্রশাসন সাজিয়েছে, ফলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। ইতোমধ্যে তারা যে নির্বাচনগুলো করেছে তাতেও ইসি নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে পারেনি পুলিশ এবং সরকারদলীয় ক্যাডারদের কারণে। সর্বশেষ লক্ষ্মীপুর-৩ (সদর) আসনের উপনির্বাচনে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ৫৩ মিনিটে ৪৩ ভোটে একাই সিল মেরেছেন। নিরপেক্ষ নির্বাচনের আরেক নমুনা জাতিকে উপহার দিলো ইসি।

গত সপ্তাহে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ নেই। তারপরও তিনি সাবেক দুই সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ও কে এম নুরুল হুদার মতো পাতানো নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এ অবস্থায় সবার আগে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি, সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা এবং তারপর তফসিল ঘোষণার পরামর্শ দিয়েছে সংলাপে অংশ নেয়া দলগুলো। আর আওয়ামী লীগের বক্তব্য, ‘বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচন করতে হবে এমন কোনো কথা সংবিধানে লেখা নেই।’ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত শনিবার নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাথে আলোচনার পর দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান এই মন্তব্য করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সংবিধানে কি নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মারার কথা লেখা আছে? নাকি ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কথা লেখা আছে? সংবিধানের জন্য মানুষ নাকি মানুষের জন্য সংবিধান?

সরকার যখন আবারো ২০১৪ সালের মতো আরেকটি ভোটারবিহীন পাতানো নির্বাচন করার মনস্থির করেছে, তখন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের কাছে জাতির প্রশ্ন, কমিশন কি আগের সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ এবং কে এম নুরুল হুদার পথে হাঁটতে শুরু করেছে? অবশ্য, ২০১৪ সালের নির্বাচনের বিষয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে বলেছিলেন, তার দল নির্বাচন বর্জন করলেও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করেছিলেন। এবং তাকে সিএমএইচে নিয়ে আটক করে রাখা হয়।

২০১৪ ও ২০১৮ সালে প্রশাসন, পুলিশকে ব্যবহার করে বর্তমান সরকার পাতানো নির্বাচন করে। এবারো সেই দিকে যাচ্ছে। জাতিসঙ্ঘ পাতানো নির্বাচনের চিন্তা পরিহার করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরামর্শ দিয়েছে। যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপানসহ উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে ব্যর্থ হলে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে এমন বার্তাও দিয়েছে। সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন কার স্বার্থে পাতানো নির্বাচনের পথে হাঁটছে সে প্রশ্ন উঠছে। কারণ দেশের রাজনৈতিক স্থিতি ও অর্থনীতির স্বার্থে রাজনৈতিক সমঝোতা অপরিহার্য মনে করছেন বিশিষ্টজন ও অর্থনীতিবিদরা। দেশের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ চায় ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হোক। বিএনপির নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে আয়োজিত সভা-সমাবেশগুলোতে বিপুল জনসমাগম তার প্রমাণ। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ও প্রভাবশালী দেশগুলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে সঙ্কট সুরাহার পরামর্শ দিচ্ছে। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকরা ভিন্ন পরিকল্পনা করছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে তা স্পষ্ট। এমন সব বক্তব্যের পরও নির্বাচন কমিশন লোকদেখানো সংলাপের আয়োজন করেছে। বিএনপির মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতারা কারাগারে বন্দী জেনেও সংলাপের আমন্ত্রণপত্র দলটির নয়াপল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গেটের চেয়ারে এবং চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের দেয়ালে লাগিয়ে দিয়েছে পথচারীদের সাক্ষী রেখে। ইসির এটি এক ধরনের মশকারা কিনা তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে নেটিজেনদের মধ্যে চলে মহা জল্পনা।

অবরোধে দেশের রাজপথে টালমাটাল অবস্থা। অন্যদিকে সরকারের দায়িত্বশীল নেতারা প্রতিদিন বিএনপির মুণ্ডুপাত করছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভা-সমাবেশে নেতারা বিএনপিকে নিয়ে বেশি কথা বলছেন।

দেশে এখন চলছে রাজনৈতিক চরম অস্থিরতা। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলো ২০১৩ সালের মতো হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে ফিরে গিয়ে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের জনগণের ভোটের অধিকার হারিয়ে গেছে। ওই দুই নির্বাচনে যারা ইসির দায়িত্বে ছিলেন তারা ক্ষমতাসীনদের ‘নাচের পুতুল’ হয়ে বিতর্কিত নির্বাচন করে এখন আফসোস করছেন। সেই একই পরিণতি কি চাচ্ছেন বর্তমান সিইসি!
tafazzalh59@gmail.com

 

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/790297