১০ নভেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ১২:২১

রাস্তায় কেন এসেছিস, দে পিটা

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

পুলিশের পাশাপাশি যে হেলমেট বাহিনী কিংবা স্যান্ডেল পায়ে, ডিবি ও পুলিশের জ্যাকেট পরে যারা বিরোধীদলীয় পিকেটার ও গার্মেন্ট শ্রমিকদের ওপর হামলা চালিয়েছে তাদের ধমকের ভাষা ছিল রাস্তায় নেমেছিস কেন, দে পিটা। তারপর লাঠি হাতে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী ও গার্মেন্ট শ্রমিকদের উপর হামলা করেছে পুলিশ ও তাদের সঙ্গে থাকা সশস্ত্র লোকেরা। এরা প্রধানত ছাত্রলীগ, যুবলীগের কর্মী। 

আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলো বরাবরই বলে আসছিল যে, এই হেলমেট বাহিনী পুলিশের ছত্রছায়ায় নাগরিক ও শ্রমিকদের উপর হামলা চালিয়ে থাকে। আর যারা এই হামলার শিকার হয়ে আহত অবস্থায় হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধেই নাশকতার মামলা দায়ের করছে। এর উপরে আছে গায়েবি মামলা। গায়েবি মামলা মানে যে অপরাধ ঘটেইনি সেই অপরাধ ঘটেছে বলে পুলিশের তরফ থেকে মামলা দায়ের করা হয়। সব সময় এটা ভালো দেখা যায় না বলে কখনো কখনো আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের, তাদের অজান্তেই মামলার বাদী করা হয়। কিন্তু সংবাদপত্র তদন্ত করে দেখিয়েছে যে ও রকম ঘটনা ঘটেইনি। কখনো কখনো দেখা যায়, যাদের বাদী করা হয়েছে তারা বলেছেন যে, ঐ ঘটনা তারা দেখেননি। আবার যাদের বিরুদ্ধে মামলা তাদের তিনি চেনেনও না। সেদিন তিনি কোনো স্বজনের কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে ছিলেন। এ সম্পর্কে সাধারণত আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায় না। এসব মামলায় আসামী হিসেবে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে তিন/চারশ’ অজ্ঞাত ব্যক্তিকেও আসামী করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তি, গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগী কিংবা ইতোমধ্যে জেলে আছেন এমন লোকদেরও আসামী করা হয়। কেন এমন হয়? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা কখনো কখনো ঐ এলাকার বিরোধী দলের কমিটির সকলকেই আসামী করে সরকারকে সন্তুষ্ট করতে চায়। সে জীবিত কী মৃত তার হদিস করা হয় না। এভাবে সরকার তার পেটুয়া বাহিনী দিয়ে ইতোমধ্যেই বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে জেলে পুরেছে আর মামলা দায়ের করেছে ৪০ লাখেরও বেশি বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে।

এক সময় দেখতাম বিভিন্ন জেলা বা বিভাগে বিরোধী দল রোডমার্চ বা সমাবেশ বা মহাসমাবেশের ডাক দিলে সরকারি দলের ঐ পেটুয়া বাহিনী ছাত্রগলী, যুবলীগ রাস্তার উপর বেঞ্চ লাগিয়ে বসে থাকতো। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের শহরে ঢুকতে বাধা দিত। মোবাইল চেক করতো। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে নির্যাতন করত। সরকার ঘোষণা দিয়ে সকল রকম পরিবহন বন্ধ করে দিত। কিন্তু লাখো মানুষের ¯্রােতের সামনে সে ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি।

তারপর সরকার একেবারে লাজলজ্জা ছেড়ে ঘোষণা দিল যে, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও জানমাল রক্ষার দায়িত্ব সরকারের আছে। তাই তারা পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগ, যুবলীগ প্রভৃতি সন্ত্রাসী বাহিনীকে নিয়োজিত করবে। এখন সেটাই চলছে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ পিটা দেবে। আর পুলিশ চালাবে গুলী আর টিয়ার শেল। প্রয়োজনে প্রকাশ্যে পিস্তল, রামদা, লাঠি নিয়ে বিরোধীদরের উপর হামলা চালাবে। এখন সেটাই চলছে।

যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ সরকারের এই ফিকির ধরে ফেলেছে। তারা বলছে, যারা বিরোধী দলের উপর হামলা করছে, তারা সরকার দলেরই লোক। এতে সরকার খুবই ক্ষুব্ধ। তারা বলছে বিদেশী কোনো রাষ্ট্র কী বলল না বলল, সরকার তা পরোয়া করে না। তারা সংবিধান অনুযায়ী দেশে নির্বাচন করেই ছাড়বে। সরকারের পাচাটা নির্বাচন কমিশন কিছুদিন আগে বলেছিল যে, দেশে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। আর এখন বলছে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে।

২০১৪ ও ২০১৮ সালে যে ভোটারবিহীন ও রাতের ভোট এই কমিশন করেছে, তা সারা পৃথিবীতে এক কলঙ্কের অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সরকার এবার ঐ দু’টি মডেলের যে কোনো একটিকে বেছে নেবার চেষ্টা করছে। তবে মানুষ দেখে সরকারের বড় ভয়। কিছু লোক একজায়গায় সমবেত হলেই সরকার কা-জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। ফলে রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে, বিয়ের অনুষ্ঠানে সমবেত হলে ‘নাশকতার ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে গ্রেফতার করা হচ্ছে।

কী উদ্দেশ্যে কে কোথায় জড়ো হচ্ছে, সেটা এখন আর বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। সরকার জনসাধারণকে এত ভয় পেতে শুরু করেছে যে, সমবেত হলেই পেটোয়া বাহিনী লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি গার্মেন্ট কর্মীরা তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করতে শুরু করে। ঢাকা, গাজীপুর, সাভার প্রভৃতি গর্মেন্ট প্রধান এলাকায় ধর্মঘট চলছে। শ্রমিকরা কর্মস্থল ছেড়ে রাজপথে নেমে আসেন।

শ্রমিকরা গার্মেন্টে ন্যূনতম ২৫ হাজার টাকা বেতন দাবি করছেন। কিন্তু সরকার বা গার্মেন্ট মালিকরা এ দাবির প্রতি ভ্রƒক্ষেপ করছে না। বাজারে জিনিসপত্রের দাম প্রায় দ্বিগুণ। মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও দ্বিগুণ/তিনগুণ বেড়েছে। পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল বা কর্ণফুলি টানেল শ্রমিকের ক্ষুধা মেটায় না। এসবের মাধ্যমে কিছু লোকের পকেট ভারী হয়েছে, তাদের চিকনাই বেড়েছে। সাধারণ মানুষ যে তিমিরে ছিল, ততোধিক তিমিরেই রয়ে গেছে। সরকার ও মালিকদের তরফ থেকে বলা হয়েছে তাদের ন্যূনতম মজুরি ১২,৫০০ টাকা পর্যন্ত দিতে পারবে। শ্রমিকরা এ প্রস্তাব মেনে নেয়নি। মালিকদের তরফ থেকে শ্রমিকদের প্রতি অশ্রদ্ধামূলক বক্তব্য দেয়া হয়েছে। তারা বলেছেন, বেশি চাপাচাপি করলে তারা কারখানা বন্ধ করে দেবেন। তখন এদের নাকি ভিক্ষা করে খেতে হবে। কিন্তু তারা একবারও ভাবেননি যে, শ্রমিকদের শ্রমের উপরই তাদের বিলাসবহুল জীবন। যদি কারখানা বন্ধ করে দেন তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তারা কোথায় পাবেন। এই প্রণোদনার টাকা সরকার ঋণ হিসেবে দিয়েছিলো। ঋণ পরিশোধের সময়সীমা তারা বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। এগুলো সাধারণত কুঋণ বা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। তখন তাদের ঋণ পরিশোধের সময়সীমা আরো বাড়ানো হয়। নতুন করে আবারও ঋণ দেয়া হয়। অর্থাৎ বিনা পুঁজিতে তারা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হন। সে টাকা বিদেশে পাচার করেন। কানাডা, বৃটেন, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে সেকেন্ড হোম গড়ে তোলেন। গড়ে উঠে বেগমপাড়া।

শৃঙ্খল ছাড়া শ্রমিকদের হারাবার কিছু নেই। তার সম্বল দু’টি হাত। যে শ্রমিক মেশিন চালাতে পারে সে কোদালও চালাতে পারে। সে নির্মাণ কাজেও হতে পারে একজন দক্ষ ব্যক্তি। তাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। ভয় যে শুধু মালিক পক্ষই দেখাচ্ছে  তাই নয়, ভয় দেখাচ্ছে সরকারও। শ্রমিকরা দাবি আদায়ের জন্য রাস্তায় নামার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশ বাহিনী দিয়ে তাদের উপর হামলা চালানো হচ্ছে। হামলার প্রতিবাদে নতুন করে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে শ্রমিকরা। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ওপর গুলী চালিয়েছে পুলিশ। তাতে কয়েকজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। শ্রমিকের সংগ্রাম চলছেই। কেউ যদি কোনো গার্মেন্ট মালিককে বলে দিলাম আপনাকে ২৫ হাজার টাকা। চালান দেখি আপনাদের সংসার। এই সমাজের বিত্তবানরা যে লাখো কোটি টাকা তসরূপ করেছে, সে টাকা আদায়ে সরকারের মুরোদ নেই। কিন্তু নিরীহ, নিরস্ত্র শ্রমিকের উপর হামলার মুরোদ আছে।

আমাদের বক্তব্য হলো শ্রমিককে তার ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর শ্রমিক যাতে তার পাওনা বুঝে পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকদের মতো সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষদের বিরুদ্ধে লড়াই করে শোষক বা শাসকগোষ্ঠী কখনো জয় লাভ করেনি। করবেও না।

https://www.dailysangram.info/post/540266