৯ নভেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১০:৩০

যে কারণে বাংলাদেশে কম্বোডিয়া মডেলের নির্বাচন সম্ভব নয়

 

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়ার মডেলে এগুচ্ছে। তবে তবে, ওই মডেলে এগুলেও তাতে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশের বর্তমান শোচনীয় অবস্থায় সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার জন্য হলেও একটি ‘সমঝোতার বন্দোবস্তে’ আসতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট আলী রীয়াজ এমন মন্তব্য  করেছেন।

বিশিষ্ট সাংবাদিক মনির হায়দারকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারটি ইউটিউব ভিত্তিক ‘দ্য গ্রিন চ্যানেল’-এ গত ৭ই নভেম্বর প্রচারিত হয়েছে। কম্বোডিয়া মডেল ব্যাখ্যা করার আগে আলী রীয়াজ দেশটির সামপ্রতিক নির্বাচনী ইতিহাস উল্লেখ করে বলেন, কম্বোডিয়াতে ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন হয়েছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন ব্যক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসেন। এরপর হুন সেন (সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী) ক্রমাগতভাবে ক্ষমতাকে সংহত করেন এবং ক্ষমতা নিজের একক কর্তৃত্বে নিয়ে আসেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তার নেতৃত্বে  ক্ষমতাসীন কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ১২৩টি আসনের মধ্যে ৯০টি আসন পেয়ে বিজয়ী হয়। দুটি প্রধান বিরোধী দল কিছু সংখ্যক আসন পেয়েছিল। চার বছর পর অর্থাৎ ২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে ওই দুটি দল একত্রিত হয়ে একটি বড় রকমের প্ল্যাটফরমে আসে।

সেটাই ন্যাশনাল রেসকিউ পার্টি। তার আগেই দেখা গেছে, এই দলটিকে যিনি নেতৃত্ব দিতে পারেন তাকে দণ্ড দেয়া হয়। তিনি শেষ পর্যন্ত দেশ থেকে বেরিয়ে গেছেন।

আলী রীয়াজ বলেন, হুন সেনের দলের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিরোধীরা খুব ভালো ফল করলো। আর তারপরেই শুরু হলো নিপীড়ন। দলের নেতাদের ব্যাপকভাবে আটক করা হলো, দণ্ড দেয়া হলো। চার বছর পর দলটিকে নিষিদ্ধ করে দেয়া হলো। সেটাও ঠিক ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে। এর ফলে, কেবল ছোট ছোট অনেকগুলো দল থাকলো। হুন সেনের নেতৃত্বে তার দল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, যেমন: নির্বাচন কমিশন, আদালত, মিডিয়ার উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করলো। কোথাও টুঁ-শব্দ করার মতো কোনো জায়গা রইলো না।

কম্বোডিয়ায় ২০১৮ সালের নির্বাচন বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, এরপর ’১৮ সালে নির্বাচন হলো। তাতে সবগুলো আসন হুন সেনের দলই পেলো। ব্যাপক সমালোচনা হলো। বাইরে থেকে চাপ থাকলো। এই চাপগুলোকে হুন সেন খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও বিরোধী দল দমে যায়নি। এত ভাঙাচোরা, দমনপীড়নের পরও নিজেদের সংগঠিত করলো ২০২২ সালে। কারণ, পরের বছরই অর্থাৎ ২০২৩ সালে নির্বাচন। তারা সংগঠিত হলো ক্যান্ডেললাইট পার্টি নামে। এই দলকে যিনি নেতৃত্ব দিতে পারতেন তাকে দণ্ড প্রদান সহ নানান নিপীড়নের কারণে তিনি আর থাকলেন না। কিন্তু, দলতো ইতিমধ্যেই সংগঠিত হয়ে গেছে। তারা যে স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ভালো করতে পারছিল, সেটা না। কিন্তু, বোঝা যাচ্ছিল যে, হুন সেনের দলকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এই ক্যান্ডেললাইট পার্টি-ই। কিন্তু, চলতি বছরের জুলাই মাসের নির্বাচনের আগে কম্বোডিয়ার নির্বাচন কমিশন ক্যান্ডেললাইট পার্টির নিবন্ধন বাতিল করে দিলো একেবারে মিথ্যা বা দুর্বল অভিযোগে যে দলটি মূল কাগজপত্র না দিয়ে ফটোকপি দিয়েছে। বিরোধীরা তখন গেলেন সাংবিধানিক আদালতে। ওই আদালত সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে বললো যে নির্বাচন কমিশন একেবারে ঠিক কাজটিই করেছে। তারপর জুলাই মাসে নির্বাচন হলো যেখানে মোট ১৭টি দল অংশ নিলো। ফলাফল তো সহজেই অনুমেয়।

২০১৮ সালের নির্বাচনে কম্বোডিয়ায় বিদেশি পর্যবেক্ষকরা যাননি উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, আনফ্রেল (এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনস) নামে যে সংস্থা আছে তারা পাঠাবার চেষ্টা করেছিল। তাদের দেয়নি যেতে। ২০১৮ সালে কিন্তু একই অবস্থা ঘটেছিল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। আনফ্রেলের লোকজনকে ভিসা দেয়া নিয়ে টালবাহানার এক পর্যায়ে তারা আর আসেন নি। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগেও (বাংলাদেশে) বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নিয়ে নানা কিছু হচ্ছে। অনেককেই পর্যবেক্ষক বানানো হচ্ছে, এটা-সেটা করছে। আর সে কারণেই আমি এটাকে বলি ‘কম্বোডিয়া মডেল’।
আলী রীয়াজের মতে, কম্বোডিয়া মডেলের মূলকথা হচ্ছে: আপনি এমন পরিস্থিতি তৈরি করুন যেগুলো দৃশ্যত আইনি। এগুলোকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলে, ‘রুল বাই ল’। যার মানে ‘রুল অফ ল’ বা ‘আইনের শাসন’ নয়, ‘আইন দিয়ে শাসন’। 

গত রোববার (৫ই নভেম্বর) ঢাকা-১০ আসনের ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে এক অবস্থান কর্মসূচিতে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস্‌ পরশ ‘বিএনপির রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়া এখন সময়ের দাবি’ বলে মন্তব্য করেছেন। এর আগে গত ১০ই আগস্ট বিএনপি’র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সমাবেশ করেছিল যুবলীগ। ওইদিন বিএনপি’র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে যুবলীগ। একইদিন ‘বিএনপির সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার দাবিতে’ যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিলের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনেও (ইসি) স্মারকলিপি দিয়েছিল। এসব ঘটনার কথা উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, লক্ষণগুলো খুব খারাপ। এগুলো কেবল যে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই ঘটছে তা কিন্তু নয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে অক্টোবর মাসের ১০ তারিখ এই যুবলীগের পক্ষ থেকেই একই দাবি করা হয়েছিল। লক্ষ্য করে দেখুন, তারা দলের নিবন্ধন বাতিল করে দেয়া বা নিষিদ্ধ করার কথা বলছে। এটা কম্বোডিয়ার ওই ক্যান্ডেললাইট পার্টির কথা মনে করিয়ে দেয়।

বাংলাদেশে কি কম্বোডিয়া মডেল বাস্তবায়ন করা সম্ভব? এমন প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ সোজাসাপ্টা বলেন, আমি মনে করি, তা হবে না। কম্বোডিয়া মডেল দিয়ে আমি এটা বোঝাতে চেয়েছি যে, এই মডেলে চেষ্টা করা হয় যাতে কার্যকর কোনো বিরোধী দল না থাকে। বাংলাদেশের ইতিহাস বলে ‘কিংস পার্টি’ তৈরি করে চাপ দিয়ে নির্বাচন করা যায় না। এমনকি নির্বাচনী বৈতরণী সামান্য পার হলেও খুব বেশিদূর যাওয়া যাবে না। তাছাড়া, বাংলাদেশের পরিস্থিতি কম্বোডিয়ার মতো নয়। কম্বোডিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের যে যোগাযোগ তা তুলনামূলকভাবে ক্ষীণ। তাদের চাপগুলোও তুলনামূলকভাবে ক্ষীণতর। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে পশ্চিমা বিশ্বের উপর যেমন ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল কম্বোডিয়ার ক্ষেত্রে তেমনটা নয়। এক্ষেত্রে তাদের বড় যোগাযোগ চীনের সঙ্গে।

আলী রীয়াজ বলেন, এই নির্ভরশীলতা প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক। বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ হচ্ছে: বাণিজ্য ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ, নিরাপত্তা সহযোগিতা, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে, আরএমজি’র কাপড় ফেরত দেয়া হয়েছে কি হয়নি- এই সামান্য খবরেই বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। কম্বোডিয়ার ক্ষেত্রে কিন্তু এরকম কিছু ছিল না। কম্বোডিয়ার বড় যোগাযোগ চীনের সঙ্গে। চীন তাকে সুরক্ষা দিয়েছে। 

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের অপ্রাতিষ্ঠানিক আরেকটি যোগাযোগ আছে জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যখন ভিসা পলিসি গ্রহণ করলো তখন এত আলোচনা হলো কেন? কারণ, সেটা অপ্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগের জায়গায় স্পর্শ করে ফেলেছে। নির্বাচনের এখন অনেকদিন বাকি আছে। চাপ আসার আশঙ্কা বাদ দেয়া যাবে না। তদুপরি নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে যা দাঁড়াবে, সেই চাপ বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে পারবে কী? বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা খুবই ভঙ্গুর।
এই সংকট একদিনে তৈরি হয়নি মন্তব্য করে আলী রীয়াজ বলেন,  আমি এবং আমার সহযোগীরা মিলে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলাম যার নাম ‘লুণ্ঠিত ভবিষ্যৎ’। সেখানে আমরা দেখিয়েছিলাম এই সংকট কীভাবে তৈরি হয়েছে। কী ধরনের অর্থনৈতিক নীতির কারণে জ্বালানি খাত বলুন, ব্যাংকিং খাত বলুন, মেগা প্রজেক্ট বলুন, অর্থ পাচার বলুন বিভিন্ন রকমের লুটপাটের ব্যবস্থা করা হয়েছে যার ফলে একটি শ্রেণি তৈরি হয়েছে। এভাবে অর্থনীতি অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে জোরেশোরে আপনি একটি নির্বাচন করে ফেলবেন, যেন তেন একটি নির্বাচন করে ফেলবেন! এটা ২০১৪ কিংবা ২০১৮ সাল নয়। চাপটা অন্য জায়গায়, অর্থনীতির উপর পড়বে। সে কারণে আমি (বাংলাদেশে) কম্বোডিয়া মডেল নিয়ে খুব আশাবাদী নই। কিন্তু, কম্বোডিয়া মডেল না হলেও যে পথে সরকার এগুচ্ছে সে পথ থেকে তাকে ফিরতে হবে।

কীভাবে ফিরবে? সে পথও বাতলে দিয়েছেন আলী রীয়াজ: ফেরার বিভিন্ন পথ রয়েছে। সে পথগুলো খোঁজা দরকার এবং খুঁজে একটা সমাধান বের করা দরকার। কারণ, সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে সাধারণ নাগরিক এবং তুলনামূলকভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। তাদের এই চাপ থেকে বাঁচাতে হবে। কেবল বাংলাদেশের সম্ভাবনার জায়গা থেকে দেখার জন্যই নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি যে অবস্থায় তাতে মানুষকে রক্ষা করার জন্য হলেও একটি সমঝোতার বন্দোবস্তে আসতে হবে। না হলে যে সংঘাত কিংবা সংঘর্ষমূলক পরিস্থিতির দিকে দেশ যাচ্ছে সেটা শুধু উদ্বেগজনকই নয়, ভয়াবহ।

https://mzamin.com/news.php?news=82652