৯ নভেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১০:২৭

শিক্ষার্থীদের জন্য ভয়ঙ্কর অনলাইন জুয়ার ফাঁদ

স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সতর্কতা জারি

 

মোবাইল স্ক্রিনে ফাঁদ পেতেছে অনলাইন জুয়া। জুয়ার এই আসরের টার্গেট স্কুল-কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ভিন্ন ভিন্ন আইডি আর চমকপ্রদ নামে নিয়মিত প্রচারণা চালাচ্ছে জুয়াড়িদের একটি চক্র। জুয়ার নেশায় আসক্ত হয়ে লেখাপড়া শিকায় তুলে সর্বস্বান্ত হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থী। সম্প্রতি ভয়াবহ এই জুয়ার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে দেশের আনাচেকানাচে। শুধু শহর নয়, গ্রামের অনেক দরিদ্র পরিবারের সন্তানও জুয়ায় জড়িয়ে পুরো পরিবারকেই পথে বসিয়েছে। জুয়াড়িদের পাতানো ফাঁদ বিষয়ে দেশের সব স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়েও সতর্কতা জারি করেছে শিক্ষা প্রশাসন। অন্য দিকে স্কুল-কলেজে সতর্কতার পাশাপাশি শিক্ষার্থী এবং পিতা-মাতাকেও সচেতন করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন অপরাধবিজ্ঞানীরা। একই সাথে আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন।

গত কয়েক মাসে এসব জুয়াড়িদের আটক করে তাদের দেয়া বক্তব্যেও উঠে এসেছে আরো ভয়ঙ্কর সব তথ্য। জুয়াড়ি চক্রের সদস্যদের দেয়া তথ্য মতে জানা যায়, এজেন্ট নিয়োগ করে রীতিমতো নিবন্ধন করে সদস্য সংগ্রহ ও সদস্যদের অধিক মাত্রায় জুয়ায় আসক্ত করতে দেয়া হচ্ছে নিত্যনতুন অফার। গেমিং, বেটিং বা বাজি খেলার সাইটে ঢুকে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট অর্থ রিচার্জে মিলছে নানা ধরনের বোনাস। ক্রেডিট কার্ড বা বিকাশের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের সুযোগ থাকায় পুরো বিষয়টিই সহজ হয়ে পড়েছে। কেউ জুয়ায় জয়ী হলে জুয়ার অর্থ চলে আসছে গ্রাহকের বিকাশ অ্যাকাউন্টে। এমন সব সহজ-সুবিধা থাকায় বড়দের পাশাপাশি জুয়া খেলায় আসক্ত হয়ে পড়ছে স্কুল-কলেজপড়–য়া শিক্ষার্থীরাও। এতে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন বাবা-মায়েরা। এমন পরিস্থিতিতে অনলাইনে জুয়া খেলা বন্ধে রাষ্ট্রীয় নজরদারির তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভার্চুয়াল জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। এতে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। অবৈধ প্রক্রিয়ায় এই ডিজিটাল মুদ্রা কেনাবেচার লেনদেনে শত শত কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের বাইরে।

আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুতই এই জুয়া বন্ধের আহ্বান জানান তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অনলাইন জুয়ার নানা কৌশল নিয়ে শিক্ষার্থীদের ফাঁদে ফেলতে মাঠে কাজ করছে একাধিক চক্র। বিশেষ করে বিট কয়েনের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সির বা ক্রিপ্টোর অবৈধ ট্রেডিং, অনলাইন জুয়া ও হুন্ডির মতো নানা অপরাধে জড়িত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। আর এসব বিষয়ে নজরে আসার পর জুয়ার ফাঁদ থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে রাখতে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা প্রশাসন। এসব কার্যক্রম থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে রাখতে সব বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজে প্রচার-প্রচারণা চালানোর নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে সব স্কুল-কলেজে ক্রিপ্টোকারেন্সির ট্রেডিং ও অনলাইন জুয়াবিরোধী প্রচারণা চালাতে অধ্যক্ষ-প্রধান শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের বলেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর। বাংলাদেশ ফাইন্যন্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) পরামর্শে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই আলোকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর থেকে জারি করা এক আদেশে সব স্কুল-কলেজে ক্রিপ্টোকারেন্সির ট্রেডিং ও অনলাইন জুয়াবিরোধী প্রচারণা চালাতে অধ্যক্ষ-প্রধান শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে।

এ দিকে বিএফআইইউ বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইন গ্যাম্বলিং, বেটিং, ফরেন এক্সচেঞ্জ, ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রেডিং এবং হুন্ডির মাধ্যমে সংঘটিত অবৈধ লেনদেন মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন পর্যালোচনায় এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার হওয়ার দৃষ্টান্ত উঠে এসেছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ। এ ছাড়াও এসব অবৈধ লেনদেনে জড়িত হয়ে জনগণ বিভিন্নভাবে প্রতারিত হচ্ছে। দেশীয় আইন অনুযায়ী ব্যক্তিপর্যায়ে ডলার কেনাবেচা করা বা বিনিয়োগ করা নিষিদ্ধ। এ ছাড়া গ্যাম্বলিং, বেটিং, ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং হুন্ডির লেনদেনও বাংলাদেশে অনুমোদিত নয়। এসব ফরেক্স ও ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগের ফাঁদে পড়ে তরুণ সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোকজন তাদের কষ্টার্জিত অর্থ হারাচ্ছে। এ বিষয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।

সূত্র মতে, গত ১১ সেপ্টেম্বর এসব তথ্য জানিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খানকে চিঠি পাঠান বিএফআইইউ পরিচালক মো: রফিকুল ইসলাম। ওই চিঠিতে তিনি অবৈধ গ্যাম্বলিং, বেটিং, ফরেন এক্সচেঞ্জ বা ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রেডিং ও হুন্ডি কার্যক্রম পরিচালনা এবং এসব লেনদেনে জড়িত না হওয়ার বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান। অবশ্য বিএফআইইউর এই পরামর্শ আমলে নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ২ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ থেকে এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজকে নির্দেশনা দিয়ে আদেশ জারি করা হয়। উপ সচিব মো: আব্দুল্লাহ আল মাসউদ স্বাক্ষরিত আদেশটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরে পাঠানো হয়েছিল।

এরপর মন্ত্রণালয়ের এ নির্দেশনা আমলে নিয়ে গত ৫ নভেম্বর আদেশ জারি করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর। উপ পরিচালক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস স্বাক্ষরিত আদেশে, অবৈধ অনলাইন গ্যাম্বলিং, বেটিং, ফরেন এক্সচেঞ্জ বা ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রেডিং ও হুন্ডি কার্যক্রম পরিচালনা এবং এসব লেনদেনে জড়িত না হওয়ার বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে সব স্কুল, কলেজে প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয় মাঠপর্যায়ের সব শিক্ষা কর্মকর্তা ও স্কুল-কলেজগুলো প্রধানদের। আদেশটি সব আঞ্চলিক পরিচালক, সরকারি-বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, আঞ্চলিক উপ পরিচালক, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, সব সরকারি-বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের পাঠিয়েছে অধিদফতর।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেট ৩৬৫ ডটকম, ৮৮ স্পোর্টস ডটকম, রেবটওয়ে ডটকম, বেটফ্রিড ডটকম, ডাফাবেট ডটকম, বেটফেয়ার ডটকম, ইউনিবেট ডটকম, বেট ভিক্টর ডটকম, নেটবেট ডটকম, টাইটানবেট ডটকম, উইনার ডটকম, পেডি পাওয়ার ডটকম, বাজিগর ডটকম, প্লেটবেট ৩৬৫ ডটকম, লগ ১০ ডট লাইভ, ৯ ক্রিকেট, বিডিটি ১০ ডটকম, বেটবি ২ ডটকম, বেটস্কোর ২৪ ডটকম, টাকা ৬৫ ডটকম, উইনস ৬৫ ডটকম, জয়টি ২০ ডটকম, ভিক্টর ২৬ ডটকম, ৬ ক্রিকেট ডটকম, ইন্ডিতা ৯৬ ডটকম, লাক বেট বিডি ডটকম, ওপেন বেট ডট লাইভ, এলবিএস ২৪ ডটকম, বেট উইন ৯৬ ডটকম, স্পোর্টস ৩৩৩ ডটকম ও বেট বাটার ফ্লাই ডটকম-সহ অর্ধশতাধিক জুয়ার অনলাইন সাইট রয়েছে। এসব বেটিং সাইটের মাধ্যমে শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, সর্বস্ব হারাচ্ছে লাখো তরুণ। সেই সাথে অল্প টাকায় অধিক লাভের নেশায় পড়ে বিপথগামীও হচ্ছে তারা।

তথ্য বলছে, এসব বেটিং সাইট বিটিআরসির নজরে এলে বন্ধ করা হয়। তবে অত্যন্ত চালাক-চতুর হওয়ায় এসব সাইট পরিচালনাকারীরা বিদেশে বসে বন্ধ হওয়া সাইটগুলো রাতারাতি ভিন্ন ডোমেইনে হুবহু চালু করে পরিচালনা করছে। আবার কেউ কেউ ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করেই এসব সাইটে খেলছে জুয়া। এ ছাড়া কিছু কিছু সাইটের অ্যাপসও রয়েছে, যা সহজে বন্ধ করা যায় না। মূলত এসব সাইটে সরাসরি কেউ অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে না। এ জন্য জুয়াড়িদের সহযোগিতায় রয়েছে ফেসবুক গ্রুপ। সাথে ইউটিউবেও দেখানো হয় জুয়া খেলার টিউটিরিয়াল। এসব গ্রুপ ও টিউটেরিয়াল দেখে বাজি খেলায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া তরুণ-তরুণীরা।

অনলাইন জুয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফারজানা রহমান বলেন, জুয়াখেলা নিয়ন্ত্রণে পারিবারিকভাবে যেমন সচেতনতা প্রয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রীয়ভাবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকেও নজরদারি আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিশেষ করে জুয়াখেলা আইনের পরিবর্তন এবং যেসব সাইটে জুয়া খেলা হয় সেগুলোর তালিকা তৈরি করে বন্ধ করা। এর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার ও স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, অনলাইন জুয়া নিয়ে বিভিন্ন চক্রকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে প্রতিনিয়ত অনেক চক্রের সৃষ্টি হচ্ছে। সেগুলোর বিষয়ে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। তবে এটার জন্য পারিবারিক সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সন্তান কোথায় কী করছে এই খোঁজ না নিলে তারা জুয়াখেলার মতো নেশায় পড়বে। তাই এটি মোকাবেলায় আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি পারিবারিক সচেতনতাও খুব জরুরি।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/790142