৯ নভেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১০:১৫

একটি রায় ও আজকের নির্বাচনী সঙ্কট

-মো: হারুন-অর-রশিদ

 

নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে। বিশ^াস-অবিশ^াসের দোলাচলে নেতাকর্মীদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় চলছে। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এর পরিণতি জনগণের জন্য সুখকর হবে না। তবে আজকের এই পরিস্থিতি সরকার নিজেই সৃষ্টি করেছে।
আজকের সরকারি দল ১৯৯৬ সালের নির্বাচন তৎকালীন সরকারের অধীনে না করার জন্য আন্দোলন করেছিল। তারা একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য ১৭৩ দিন হরতাল করেছিল। তাদের আন্দোলনের মুখেই সেদিনের সরকার পার্লামেন্টে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন পাস করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচন প্রায় বিতর্কমুক্ত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠার আন্দোলনের কারণে ২০০৬ সালে একটি বিতর্কিত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে প্রায় দুই বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিল। পরবর্তীতে সেনাসমর্থিত সরকারের সাথে আপসের মাধ্যমে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সংবিধানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইনের ওপর কুঠারাঘাত করেছে। রাষ্ট্রের সংবিধানকে কেটেকুটে আওয়ামী লীগের সংবিধানে রূপান্তরিত করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ তাদের ভবিষ্যতের নির্বাচনী পথ পরিষ্কার করতে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ এবং ‘গণভোট’-এর আইন সংবিধান থেকে বাতিল করে। যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন বাতিলের বৈধতা নিয়ে আইনগত যেমন বিতর্ক আছে তেমনি দেশের জনগণ বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। কারণ সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন পাস হলে এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করলে হাইকোর্ট বিভাগ এ রিট খারিজ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করে। এরপর ২০০৫ সালে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে আদালত এ মামলায় আটজন অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ করে তাদের মতামত শোনেন। এদের মধ্যে পাঁচজন সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে মত দিয়েছেন। এরা হলেন- ড. কামাল হোসেন, টি এইচ খান, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহামুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ও ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ। অধিকাংশ অ্যামিকাস কিউরি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ও গণতন্ত্র রক্ষা, জনগণের কল্যাণের জন্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন।

রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বিশ^াসযোগ্যতার অভাব, তাদের চরিত্র এবং বর্তমান সময়ের বাস্তবতা বিবেচনা করলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া বিকল্প নেই। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের উদাহরণ যেমন নেই তেমনি ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের দুটি নির্বাচন দেশের কোটি মানুষের বিশ^াসকে একেবারেই ধ্বংস করে দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলা হলেও এটি কিন্তু সব রাজনৈতিক দলের সমর্থনের ভিত্তিতে হয়েছিল। আর যেহেতু, সংবিধান অনুযায়ী জনগণই সব ক্ষমতার মালিক এবং জনগণের প্রতিনিধিরাই বৈধভাবেই ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করেছিলেন। সুতরাং এখানে অগণতান্ত্রিক কিছু নেই।

জাতির এক সন্ধিক্ষণে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, গণতন্ত্রকে সুসংহত করা ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যই এয়োদশ সংশোধনী আনা হয়েছিল। ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই এ ব্যবস্থা আনা হয়। ২০১৪ এবং ২০১৮ এর বাস্তবতা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। জনগণের সমর্থন নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে আইন পার্লামেন্ট পাস করেছিল, তা বাতিল করার জন্য কিন্তু পার্লামেন্টকে ব্যবহার না করে রাজনৈতিক হীনস্বার্থে আদালতকে ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আরো দুটি সংসদ নির্বাচন হতে পারে বলে সংক্ষিপ্ত রায়ে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এ বি এম খাইরুল হক অবসর গ্রহণের ১৬ মাস পর পূর্ণাঙ্গ রায়ে এই কথাটুকু বাদ দিয়ে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক আখ্যা দিয়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেছেন।

এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি জাগ্রত হয়েছে যে, একজন বিচারপতি অবসর গ্রহণের ১৬ মাস পরে সাংবিধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যেটি দেশের ১৭ কোটি মানুষের বিশ^াস-অবিশ^াসের সাথে জড়িত, এমন একটি বিষয়ে রায় দিতে পারেন কিনা, যে রায় একই বিচাপতির দেওয়া সংক্ষিপ্ত রায়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। অবসর গ্রহণের পর বিতর্কিত রায় লেখা কতটা যৌক্তিক সেই বিতর্ক যেমন রয়ে গেছে তেমনি বিচারকদের প্রতি মানুষের বিশ^াসের জায়গায় ভাঙনের সৃষ্টি করেছে। এই প্রসঙ্গে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেছেন, অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখা সংবিধান পরিপন্থী। ওই মামলায় ভিন্নমত প্রদান করে রায়দানকারী বিচারপতি মো: আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা বলেছিলেন, ‘২০১১ সালের ১০ মে প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত শর্ট অর্ডারকে প্রধান বিচারপতির বর্তমানের রায় সমর্থন করে না। তিনি (বিচারপতি খায়রুল) সংযোজন করেছেন।’

বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাও তার রায়ে শর্ট অর্ডার পরিবর্তন করার দাবিটি উল্লেখ করেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী এক সেমিনারে বলেছিলেন, ১৬ মাস পরে দেওয়া মূল রায় পাল্টানো ফৌজদারি অপরাধ।’ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া ২০০২ সালের প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগের একটি রায় আছে। শ্রী শান্তি ভূষণ দেব বনাম অন্যান্য মামলাটির রায়দানকালে প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ বলেছিলেন, ‘প্রকাশ্য আদালতে আদালতের মূল সিদ্ধান্ত ঘোষণা এবং তা সই হওয়ার পরে আর পাল্টানো যাবে না। তবে ঘোষণার পরে যদি আদালত মত পাল্টাতে চান, তাহলেও সেটা পারবেন। সেটা করতে হলে ঘোষিত রায় বা আদেশ লিখিতভাবে তলব করতে হবে। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে পুনরায় শুনতে হবে।’

১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির এক আদেশের মাধ্যমে পাকিস্তানের সব প্রচলিত আইনকে স্বাধীন বাংলাদেশে গ্রহণ করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের রায় আইন হিসেবে গণ্য হওয়ায় পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ও আইন হিসেবে বাংলাদেশে বলবৎ আছে। ১৯৬৪ সালে একজন বিচারক অবসরে গিয়ে ভাওয়ালপুর এস্টেটের মন্ত্রী হয়ে রায়ে সই করেছিলেন। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াসের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ তাকে বেআইনি বলেছিলেন। রায়ে বলা হয়েছিল, অবসরে গিয়ে যেকোনো প্রকারের বিচারিক কর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকা বৈধ নয়।’

ভারতের প্রধান বিচারপতিরা অবসরে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার পরিবর্তে বরং দ্রুততার সাথে সংক্ষেপে রায় প্রদানের শক্তিশালী রেওয়াজ গড়ে তুলেছেন। ২০১৩ সালের এক রায়ে বিচারপতি এ আর দেব বলেন, “প্রধান বিচারপতি অবসরে যাবেন, তাই ‘দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত’ রায় লিখলাম।” ১৯৮০ সালে বিখ্যাত বিচারপতি কৃষ্ণ আয়ার অবসরে যাবেন। তিনি লিখলেন, ‘আমার অবসর সন্নিকটে, তাই রায়টা দ্রুত শেষ করতে হলো।’ দেশ-বিদেশের আইন, রেওয়াজ ও নজিরের পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট যে, কোনোক্রমেই অবসরে রায় লেখা যাবে না। প্রয়োজনে রায়ের ঘোষণা সংক্ষিপ্ত হতে পারে। তার পরেও অবসরে রায় লেখার কোনো ভিত্তি নেই।

বিচারপতি এ বি এম খাইরুল হক বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের সম্মতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনের যে সঙ্কট সৃষ্টি করে গেছেন, ১৫ বছর ধরে তার খেসারত জনগণকে দিতে হচ্ছে। এই রায়কে কেন্দ্র করে তার বিচারিক স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সরকারের তরফ থেকে পরবর্তী সুবিধা লাভের আশায় সরকারের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি এই রায় দিয়েছেন। যার প্রমাণ অবসর গ্রহণের পর তিনি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। একজন বিচারকের বিবেকহীনতার কারণে গোটা রাষ্ট্রে যে সঙ্কট সৃষ্টি হয় যুগ যুগান্তর তার কুফল জনগণকে ভোগ করতে হয়। বাংলাদেশের জনগণ আজ এক নৈরাজ্যকর রাষ্ট্রের অধিবাসী। ভোটের অধিকার যেমন নেই, নেই বাকস্বাধীনতা। এই দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের লোকজনকে নিজ দেশেই পরবাসী হয়ে বসবাস করতে হচ্ছে। এই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে, শাসকবর্গের বিবেকের উদয় হতে হবে এবং সঙ্কট সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। তবে, সমাধান তখনই হবে, যখন রাষ্ট্রের জনগণ ভোট প্রদান করে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
harun_980@yahoo.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/790047