৬ নভেম্বর ২০২৩, সোমবার, ১১:০৬

কর আদায় নয় রাজস্ব আহরণ

-ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

 

শব্দের মধ্যে যে উদ্দেশ্য ও বিধেয় লুকিয়ে থাকে সেটি শব্দের প্রকৃত অর্থ নির্ধারক। শব্দের ভাবগত, ভাষাগত, ব্যুৎপত্তিগত অর্থ স্থান, কাল, পাত্রভেদে ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করতে পারে কিন্তু মূল বা ধাতুগত স্বকীয়তা তার ঠিক থাকে সর্বদা, সর্বত্র। ‘আদায়’ শব্দটি আরবি ‘আদা’ ধাতুমূল থেকে উৎপত্তি। মূল অর্থ পালন করা, সম্পাদন করা, সাধন। সংস্কৃতে আ প্রত্যয়ের সাথে দা ধাতু যোগে আদায় শব্দটি গঠিত। দা ধাতুমূল দায়বদ্ধতার প্রতীক। প্রজা মালিক বা রাজা বা রাষ্ট্রের কাছে দেয় পরিশোধে দায়বদ্ধ।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধমে স্বাধীন সার্বভৌমত্ব লাভের আগ পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় বিদেশী শাসনের অধীনে থাকা আমাদের এ দেশ ও সমাজে প্রাচীনকাল থেকে সেসব খাজনা বা নজরানা সংগ্রহ কার্যক্রমে জোর জবরদস্তি বা বাধ্য করা অর্থে, পাওনা উদ্ধার অর্থে ‘আদায়’ শব্দটি ব্যবহার হয়ে এসেছে। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিগ্রহণ করা এদেশীয় ভূমির মালিকানাসূত্রে খাজনা সংগ্রহের দায়িত্ব জমিদার শ্রেণীর কাছে অর্পিত হয়। জমিদাররা জমির প্রকৃত মালিক ছিলেন না, তারা জমির চাষবাসেও ছিলেন না, তারা কোম্পানির হয়ে খাজনা সংগ্রাহক ছিলেন মাত্র। এ সংগ্রহ কাজে কোম্পানিকে দেয় পরিশোধের পর উদ্বৃত্ত কমিশন হিসেবে প্রাপ্তির প্রত্যাশী ছিল মধ্যস্বত্বভোগী এই চক্র। ফলে রায়তের সাথে খাজনা সংগ্রহ কর্মে তাদের সম্পর্ক শেষমেশ জুলুম বা জোর-জবরদস্তির পর্যায়ে পৌঁছাত। জমিতে ফসল হলো কিনা, রায়ত চাষবাস করে টিকে থাকতে পারবে বা পারছে কিনা, এটি জমিদারদের বিবেচনার বিষয় ছিল না। আর কোম্পানি বিষয়টি দেখে বা জেনেও না জানার ভান করত, কেননা তারা তুষ্ট থাকত রাজস্ব পেয়ে, প্রজার সুযোগ-সুবিধা দেখার বিষয়টি আমলে নিতে প্রস্তুত ছিল না। খাজনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে আদায় শব্দটি সেভাবে একটি জোর জুলুম, অত্যাচার, আত্মসাতের প্রতিভূ হিসেবে বিদ্যমান হয়ে দাঁড়ায়। একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী দেশে ও পরিবেশে রাষ্ট্রকে দেয় ‘আদায়ের’ ঔপনিবেশিক আমলের এসব মানসিকতা অব্যাহত থাকা যুক্তিগ্রাহ্য হতে পারে না।

নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র কর্তৃক আইনের আওতায় করারোপ আর রাষ্ট্রকে ওই কর পরিশোধের বিষয়টি এই নিরিখে বিচার করলে দেখা যায়, আদায় শব্দটি ততটা জুতসই নয়; যতটা ভূমিকর বা খাজনার ক্ষেত্রে খাটে। আয়করের দর্শন হলো রাষ্ট্রমধ্যে বসবাস করে নির্ধারিত পরিমাণের বেশি আয় বা সম্পদ অর্জিত হলে রাষ্ট্র তার একটি নির্দিষ্ট অংশ ‘সমাজে সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা বিধান এবং আয় উপার্জনের পরিবেশ সৃজন তথা অবকাঠামো নির্মাণ বাবদ আয় উপার্জনের পরিমাণ ভেদে একটি হিস্যা’ প্রাপ্য হিসেবে চাইতে পারে। ভূমিকরের ক্ষেত্রে আগে রাষ্ট্র ভূমি বরাদ্দ দেয় এবং তার ভিত্তিতে খাজনা দাবি করে; এখানে লেনদেন প্রকাশ্য, সুতরাং দাবি বা আদায়ের যৌক্তিকতা সেভাবে আসে। কিন্তু আয়করের ক্ষেত্রে লেনদেন অপ্রকাশ্য, রাষ্ট্র সৃজিত সুযোগ-সুবিধা সবাই ভোগ করলেও সবাই আয় বা সম্পদ অর্জন করতে পারে না। নিজের মেধা, বুদ্ধি, পরিশ্রম প্রয়োগ করে সম্পদ অর্জন করতে হয়। অতএব সেই আয়ের ওপর রাষ্ট্রের যে দাবি তা নাগরিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসাবে প্রদেয়। এখানে রাষ্ট্রের পক্ষে তা ‘আদায়ের’ যৌক্তিকতা অনেকটা গৌণ।

আয়কর দেয়ার মতো আয় যে নাগরিকের আছে তিনি রাষ্ট্রকে দেয় কর পরিশোধ করবেন স্বেচ্ছায়, আইনগত বাধ্যবাধকতা পালন করে, নাগরিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে। তবে হ্যাঁ, যদি তিনি তা পরিশোধে গড়িমসি করেন, এড়িয়ে চলেন, অসাধু পন্থা অবলম্বন করেন তাহলে আইনের আওতায় রাষ্ট্রের প্রাপ্য উদ্ধারে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। কেননা কেউ কর ফাঁকি দিলে তা উদ্ধারে ব্যর্থতার দায়ভাগ আহরণকারীর এ জন্য যে, তাদের এ অপারগতায় সমাজে ন্যায়-অন্যায় বৈধ-অবৈধ অসম অবস্থানে চলে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে, রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে তো বটেই, সমাজে সম্পদের অর্জন বণ্টনে-বৈষম্য সৃজিত হতে পারে। এর ফলে সমাজ ও অর্থনীতিতে ভারসাম্য বিনষ্ট হতে পারে। এ নিরিখে সব করদাতার সাথে ‘আদায়’জনিত মনোভাব পোষণ বা ক্ষমতার প্রয়োগ বা সে ধরনের পরিবেশ সৃজন যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। সীমারেখা মেনে চলা জরুরি এ জন্য যে, তা না হলে করারোপ, আহরণ, প্রদান ও পরিশোধের ক্ষেত্রে ভিন্ন নেতিবাচক পরিস্থিতি উদ্ভব হতে পারে, করারোপ ও আহরণকারীর সাথে করদাতার সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বাস, সংশয়, সন্দেহ দানা বাঁধতে পারে, আস্থায় চিড় ধরতে পারে, পরস্পরকে এড়িয়ে চলার, জোর-জবরদস্তির, পক্ষপাতিত্বের, আঁতাতের মতো অনেক কিছু ঘটতে পারে। স্বচ্ছতার স্থলে অস্বচ্ছতার অনুপ্রবেশে কর আহরণের মতো রাজস্ব আয়ের দেহে সিস্টেম লস বা ইনফর্মাল রেভিনিউরূপী ‘সুগারের’ মাত্রা বেড়ে অর্থনীতি ‘ডায়াবেটিসে’ আক্রান্ত হতে পারে, ‘সাইলেন্ট কিলার’ নামে পরিচিত যে রোগটি দেহে বহু ব্যাধির আহ্বায়ক।

এ দেশে আয়কর আইন প্রবর্তন হওয়ার সমসাময়িক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনায় দেখা যায়, একটা ঔপনিবেশিক সরকার এর প্রবর্তক আর কর সংগ্রহ (‘কালেকশন অব ট্যাক্সেস’ আইনের ভাষ্যে শব্দটি এভাবে আছে) কার্যক্রমটি সে সময়কার ‘আদায়’ মানসিকতা দ্বারা শাসিত। শাসক আর শাসিতের মধ্যে করারোপের আর আদায়ের প্রসঙ্গটি রাষ্ট্র ও নাগরিকের পারস্পরিক দায়িত্ব পালনের দর্শনের ভিত্তি রচনার পরিবর্তে রাজা-প্রজা, প্রভু-ভৃত্য, বিদেশী বেনিয়া আর দেশীয় (নেটিভ) প্রতিপক্ষসুলভ। এ পরিবেশে কর বা রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার, সংশয়, সন্দেহের, জোর-জবরদস্তির কিংবা পাকড়াওকরণের চিন্তাচেতনায় কালেকশন অব ট্যাক্সেস অর রেভিনিউ হয়ে ওঠে আদায় করার বিষয়। রাজস্ব আহরণকারীর মনোভাবভঙ্গিতে আইনের দৃষ্টিভঙ্গিসঞ্জাত ‘আদায়কারী’ প্রতিভূ হিসেবে প্রতিভাত হয়। রাজস্ব বিভাগের কর্মীরা সামাজিকভাবে সে পরিচয় পেয়ে যান এবং তাদের এড়িয়ে চলার সুকৌশল বাতাবরণ তৈরির জন্য বিভিন্ন পেশাদারত্বের উদ্ভব ঘটে সেভাবে।

রাজস্ব প্রশাসনে কর ‘আদায়’ শব্দটিকে জোর-জবরদস্তি ও জুলুম (এক্সটোরশন), দখল, আত্মসাৎ, ফাঁকি, সংশয়, সন্দেহের পাড়া থেকে বের করে এনে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে তাকে স্বচ্ছ, সুশোভন, পারস্পরিক উপলব্ধির মাধ্যমে স্বেচ্ছা প্রণোদনের ঘাটে ভেড়ানোর জন্য ‘আদায়ের’ পরিবর্তে ‘আহরণ’ ( কালেকশন অব ট্যাক্স অর রেভিনিউ) এ আহরণের আহ্বান জানানো এবং এটি যাতে শুধু শব্দের পাড়া পরিবর্তন না হয়; এটি মনমানসিকতায়ও যাতে স্থায়ী বাসা বরাদ্দ পায় তার জন্য আইনের চোখের সংস্কার ও পদ্ধতি প্রক্রিয়ার চিকিৎসারও উদ্যোগ আরো জোরদার হওয়া প্রয়োজন।

এটি বারবার ভাবা প্রয়োজন যে সরকারের অন্যান্য খাতের বা ক্ষেত্রের চাইতে রাজস্ব, বিশেষ করে আয়কর আহরণে অগ্রগতি হতে হবে। আয়কর প্রদানে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি তথা করদাতাবান্ধব পরিবেশ সৃজনে পদ্ধতি-প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনার প্রয়াসের ফসল থেকে এ অগ্রগতি টেকসই হবে। এ অগ্রগতি ধরে রাখতে হবে অর্থনীতিতে কর জিডিপির অনুপাত ন্যায্য পর্যায়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত। বাঞ্ছিত পরিমাণ আয়কর আহরণ সরকারের রাজস্ব তহবিলের স্ফীতির জন্য নয় শুধু, সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থা সুষমকরণের দ্বারা সামাজিক সুবিচার সুনিশ্চিতকরণে, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও অঞ্চলগত উন্নয়ন বৈষম্য দূরীকরণের জন্যও জরুরি। দেশকে স্বয়ম্ভরের গৌরবে গড়তে ও পরনির্ভরতার নিগড় থেকে বের করে আনতে আয়কর অন্যতম প্রভাবক ভূমিকা পালন করবে। আয়কর বিভাগের প্রতিটি প্রয়াসে তাই থাকা চাই বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার সম্মিলনে উন্মোচিত আত্মবিশ্বাসের, সহযোগিতাসঞ্জাত মনোভঙ্গি ভজনের, পদ্ধতি সহজীকরণের, করদাতার আস্থা অর্জনের অয়োময় প্রত্যয়।

নতুন নতুন উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি পুরাতন উদ্যোগের সালতামামি ফলোআপ আবশ্যক হবে। ২০০৭-০৮ কিংবা ২০০৮-০৯-এ যারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করদাতা হয়েছিলেন তাদের খবর কী? দেশে যে প্রায় সাত লক্ষাধিক ক্রেডিট কার্ডধারী আছেন, আছেন প্রায় সমসংখ্যক গাড়ি বাড়ির মালিক তাদের কাছে যাওয়ার সর্বশেষ অবস্থা কী। কর বিভাগের সিটিজেন চার্টার তাকি গণঅবিহিতির অবয়বে আছে এখনো। আগেও যেসব কর তথ্যকেন্দ্র, সেবাকেন্দ্র খোলা হয়েছিল প্রকল্পের প্রেরণায় সেগুলোর কার্যকারিতা থেমে গেছে কিনা তা দেখার অবকাশ রয়েছে। একসময় কর মেলায় মানুষের উপচে পড়া ভিড় প্রমাণ করত করদাতাদের আগ্রহ বাড়ছে, অনেকে ঝামেলামুক্ত উপায়ে বা পরিবেশে কর দিতে চান, কর দেয়াকে দায়িত্ব মনে করছেন, তাদের এ আগ্রহকে ধরে রাখতে হবে, তাদের উদ্বোধিত দায়িত্ববোধের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে, তাদের আগ্রহ সমীহ করতে হবে। করদাতাদের উদ্বুদ্ধকরণে প্রচার-প্রচারণার কাজে আগে তেমন কোনো বরাদ্দ ছিল না, কর আহরণের ব্যাপারে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক থেকে প্রযতœ প্রদানের নজির নেই, নেই কর বিভাগে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ। তবে ১৯৯০ সাল থেকে এ যাবৎ সাত-আটটি প্রকল্প (বিদেশী সাহায্যপুষ্ট, বিদেশী বিশেষজ্ঞের ভারে ন্যুব্জ) বাস্তবায়ন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শুধু অটোমেশন, অনলাইনিং, স্ট্র্রিমলাইনিং, স্ট্রেনদেনিংয়ে। ৩০-৩২ বছরেও সেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের দ্বারা অর্জিত অগ্রগতি দৃশ্যগোচর না হোক অন্তত অনুভব সম্ভব হবে যদি দেখা যায় সবার মাইন্ডসেট ও কর্মকুশলতায় গুণগত পরিবর্তন এসেছে। তবে এটিও ঠিক, বর্তমানে যে অব্যাহত অগ্রগতি তার পেছনে সেসব প্রয়াসের প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি ও নেপথ্য প্রেরণা হিসেবে যে কাজ করছে; তা অনস্বীকার্য।
লেখক : সাবেক সচিব এবং
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/789299