৫ নভেম্বর ২০২৩, রবিবার, ১০:১৮

ঘর-বাড়ি ছাড়া বিরোধীদলের নেতা-কর্মীরা

সারদেশে ব্যাপক ধরপাকড় চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে এখন ঘর-বাড়ি ছাড়া বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপি ও জামায়াতের সমাবেশের আগে থেকেই বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে আওয়ামী লীগ, পুলিশ ও বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ চলাকালে দুই জন নিহতের ঘটনায় ডিএমপির বিভিন্ন থানায় অন্তত ৩৭টি মামলা দায়ের করা হয়। অধিকাংশ মামলার বাদী পুলিশ এবং আসামী বিএনপির কয়েক হাজার নেতা-কর্মী। সমাবেশের পর হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচির কারণে ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জেলায় বিরোধীদলের নেতা-কর্মীরা গ্রেফতার আতঙ্কে বাড়িতে থাকতে পারছেন না। স্থানীয় পুলিশ-র‌্যাব এবং গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও। 

জানা গেছে, ২৮ অক্টোবরের ঘটনায় ঢাকার মামলায় এজাহারনামীয় আসামী ১ হাজার ৫৪৪ জন। অজ্ঞাত আসামী করা হয় কয়েক হাজার। শীর্ষ নেতাদের তালিকায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ও আহমেদ আজম খান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল এবং কেন্দ্রীয় যুবদলের সুলতান সালাউদ্দিন টুকুসহ শীর্ষ নেতাদের নাম রয়েছে। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীর নামে ৪৪টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এতে আসামী হয়েছেন আড়াই হাজারেরও বেশি নেতাকর্মী। যেসব এলাকায় নাশকতা হয়েছে, সেসব এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে হামলাকারীদের শনাক্তের চেষ্টা চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গড়ে প্রতিদিন সারাদেশে অন্তত তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে বলে বিএনপি দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এসব কারণে বিরোধীদলের নেতা-কর্মীরা এখন ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি কেন্দ্রীয় নেতারাও গা ঢাকা দিয়েছেন। এর মাঝে পোশাক শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি দাওয়াকে কেন্দ্র করে তারাও মাঠে নেমেছে।

 

পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনেও বিরোধীদের ইন্ধন থাকতে পারে এ অভিযোগ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযানে নেমেছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রেফতার ছাড়াও কিছু কৌশল অবলম্বন করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আন্দোলনকারী দলগুলোর মাঠ পর্যায়ের নেতাদের ভয়ের মধ্যেও রাখা হচ্ছে। পাশাপাশি নীতিনির্ধারক ও জেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারে বেশি নজর দিচ্ছে। গত এক সপ্তাহে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের যেসব নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, মজিবর রহমান সরোয়ার, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব মো. আমিনুল হকসহ অনেকে। জেলা পর্যায়ের যেসব নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন-দিনাজপুর জেলা বিএনপির সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন দুলাল, গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুন্নবী টুটুল, রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শামসুজ্জামান সামু, নড়াইল জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম প্রমুখ। বিএনপির দাবি অনুযায়ী, গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের প্রায় পাঁচ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিশেষ করে দলটি যখন তাদের সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করছে তখন সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতার বা আত্মগোপন নতুন করে দলটির জন্য কোন সংকট তৈরি করছে কি-না সেই প্রশ্নও উঠছে। দলটির নেতারা দাবি করছেন যে গ্রেফতার বা মামলায় সাজা দিয়ে অনেক নেতাকে রাজনীতির মাঠ থেকে সরানো হলেও তাতে দলের অভ্যন্তরে কোন সংকট তৈরি হবে না। কারণ তারা মনে করেন দলটিতে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা আছে এবং কেউ গ্রেফতার হলে বিকল্প নেতারাই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিবেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, কারাগারের বাইরে থাকা বিএনপির সবশেষ ব্যক্তি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবে। শুক্রবার এক বিবৃতিতে বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরুকে গ্রেফতারের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে রিজভী এই কথা বলেন। বিবৃতিতে রিজভী বলেন, বিএনপির নেতৃত্বকেও দুর্বল করা যাবে না। আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারের পদত্যাগসহ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে জনগণ সংকল্পবদ্ধ। আর অচিরেই এ সরকারের পতন হবে। তিনি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত করার পাঁয়তারা শুরু করেছে আওয়ামী সরকার। এই হীন উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করার লক্ষ্যে বিএনপির জাতীয় নেতাদের ধারাবাহিকভাবে গ্রেফতার করা হচ্ছে।

সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ছেলে ইসরাফিল খসরু বলেছেন, বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের দিকে গুলশানে আমার এক আন্টির বাসা থেকে বাবাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। একই রাতে বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন এবং জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক, দলটির ঢাকার উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হককে গ্রেফতার করে পুলিশ। বিএনপির সর্বোচ্চ পদে থাকা অন্যতম নেতা মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আটক করার কয়েক দিন পর পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। এছাড়াও গত শুক্রবার বিএনপি নেতা আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ারকে মিরপুর থানার মধ্যপীরেরবাগ এলাকা থেকে এবং মো. শাহীনকে কলাবাগান থানা এলাকায় থেকে গ্রেফতার করা হয়। গত ২৯ অক্টোবর গোয়েন্দা বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনাল টিমের পুলিশ পরিদর্শক মোক্তারুজ্জামান হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় তাদের গ্রেফতার করা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ২৮ অক্টোবর বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের ডাকা মহাসমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালনকালে সংবাদ পান যে হাতিরঝিল থানার মগবাজার রেলগেট এলাকায় বিএনপির নেতা কর্মীরা গাড়ি ভাঙচুর করছে।

বগুড়ায় বিএনপি-জামায়াতের ৪৬ নেতাকর্মী গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বৃহস্পতিবার বগুড়ায় অবরোধের শেষ দিন সদর থানা পুলিশের দায়ের করা মামলায় ৭৪ জনকে আসামী করা হয়। এসব মামলা ও আগের মামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা বিএনপি-জামায়াতের ৪৬ জনকে গ্রেফতার করেছে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় জামায়াত-শিবিরের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। 

এদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের অন্যায়ভাবে গ্রেফতারের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘সরকার বিরোধী চলমান আন্দোলন বানচাল করার হীন উদ্দেশ্যেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সারোয়ার, মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য অধ্যাপক ফরহাদ হোসাইন, কুষ্টিয়া শহর জামায়াতের আমির অধ্যাপক রাজিউদ্দিন আহমাদ, কুষ্টিয়া শহর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি অধ্যাপক ইউনুস আলী এবং ঠাকুরগাঁও শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সেক্রেটারি বদিউল আলমকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করেছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও অধিকার আদায়ের আন্দোলনে মুক্তিকামী মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছে। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে সরকার দিশেহারা হয়ে পড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের শতাধিক নেতাকর্মীকে সরকার বেআইনিভাবে গ্রেফতার করেছে। এভাবে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে মিথ্যা মামলা দিয়ে জনগণের আন্দোলন অতীতে যেমন দমন করা যায়নি, তেমনি বর্তমানেও যাবে না। আমি সরকারের এই সব জুলুম-নির্যাতন ও অন্যায় গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। তিনি আরো বলেন, জনসমর্থনহীন জালেম সরকার জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য জামায়াতসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করছে। গোটা দেশটাকেই আজ এক বৃহৎ কারাগারে পরিণত করা হয়েছে। সারাদেশের মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে। এ অবস্থায় কোনো দেশ চলতে পারে না।

এদিকে গ্রেফতার নেতা-কর্মীদের চাপ সামলাতে পারছে না কারাগারগুলো। জানা গেছে, এরই মধ্যে দেশের ৬৮টি কারাগারে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দী রয়েছে। কারাগারগুলোতে মোট ৪২ হাজার ৮৬৬ বন্দীর ধারণ ক্ষমতা থাকলেও সংখ্যা রয়েছে ৮৫ হাজার বেশি। সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হলে বন্দীর সংখ্যাও বাড়তে পারে। এই প্রেক্ষাপটে কারাগারগুলোতে আরও অন্তত ৪০ হাজার বন্দী রাখতে ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। কারা অধিদপ্তর জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ মামলার অনেক আসামী আদালত থেকে জামিন পাচ্ছেন। জামিনের আদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কারাগার থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকেই প্রতিদিন দুই থেকে আড়াইশ সাধারণ বন্দী জামিনে মুক্ত হচ্ছেন। সারা দেশে থেকে প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজারের বেশি আসামী জামিন পাচ্ছেন। এছাড়া যেসব কারাগারে বন্দির সংখ্যা তুলনামূলক কম, অন্য কারাগার থেকে সেসব কারাগারে বন্দী স্থানান্তর করা হচ্ছে। তারপরও বন্দীর চাপ কমানো যাচ্ছে না। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক দলের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতাকর্মীকে নাশকতাসহ নানা মামলায় কারাগারে পাঠানো হচ্ছে।

 

https://www.dailysangram.info/post/539898