৫ নভেম্বর ২০২৩, রবিবার, ১০:১৫

উন্নয়নের যত বুলি-বচন

-সালাহউদ্দিন বাবর

 

ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে অনেক দিন থেকেই কিছু শব্দ ও বাক্য বারবার উচ্চারিত হয়ে আসছে। শব্দ ও বাক্যবিন্যাসে ‘উন্নয়ন’ শব্দটি সকাল-সন্ধ্যায় ঘুরে ফিরেই আসছে। এমন অতিকথনকে শব্দদূষণের পর্যায়ে না ফেললেও জনগণ এ শব্দাবলিকে শ্লেষাত্মক ও পরিহাসের মুলকের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মনে করেন। সেই উন্নয়ন ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট বাক্যবিন্যাসকালে শাসক দলে নেতৃবৃন্দের কণ্ঠে কিছু গর্ব ও অহমিকার সুরও শুনতে পাওয়া যায় বলে অনেকেই মনে করেন। আরো অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের মুখ নিঃসৃৃত উন্নয়নসংক্রান্ত বাণীতে। কেবলই থাকে কয়েকটি মাত্র ‘মেগা প্রকল্প’-এর যত কথা। আর অন্য কিছু নয়, অর্থাৎ অন্য কোনো প্রকল্পের কথা থাকে না; প্রকল্পগুলো থেকে গোটা দেশের কত সংখ্যক মানুষ উপকৃত হচ্ছে বা হবে; আর লাখ লাখ কোটি টাকার এসব প্রকল্প জাতীয় অর্থনীতিতে কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে বা ফেলতে পারে, তার কোনো সঠিক মূল্যায়ন নিয়ে কোনো পরিপত্র আছে বলে জানা নেই। তবে ঢাকা মহানগরীতে যে দু-একটি ‘মেগা প্রকল্পে’র কাজ শেষ হয়েছে, তার ইমপ্যাক্ট খুব সুখকর নয় বলে অনেকেই অনুভব করছেন। এ নিয়ে কিছু কথা পরে বলব।

 

তবে এসব প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক ঢাকঢোল পেটানো হচ্ছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকার যতটুকু করতে পারেন, তখন তাদের সক্ষমতা নিয়ে বহু গুণ বাড়িয়ে কথা বলতে তারা অভ্যস্ত। কিন্তু তারা যা পারেন না, তা নিয়ে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেন না। এ দিকে মেগা প্রকল্পগুলোর সংখ্যা প্রায় ১০টি। এসব প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল এক কোটি ৪৪ লাখ ৯২ দশমিক ৯৫ কোটি টাকা। কিছু কালের মধ্যেই ব্যয়ের সেই অঙ্ক প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায় দুই কোটি ৩৫ লাখ ৫৪৩ দশমিক ৮৫ কোটি টাকা। এই বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় নিয়ে কোনো কথাই জাতীয় সংসদে হয়নি। এ অর্থের জবাবদিহিতা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন সঙ্গতকারণেই আছে। ওই বৃহৎ ১০ মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য বিপুল অর্থ ঋণ করা হয়েছে। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, এখন কোনো নবজাত জন্ম নিলে এক লাখের অধিক ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে পৃথিবীতে আসে। প্রকৃত পক্ষে ১০ প্রকল্পের জন্য যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, তার জন্য বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ ঋণ করে আনা হয়েছে, যা সাধারণ মানুষকেই দিতে হবে। অথচ জনগণ জানতে পারবে না অর্থগুলো কিভাবে খরচ করা হচ্ছে এবং হবে। তারা এ-ও জানে না, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না।

সম্প্রতি এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু সাত বছর হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ এ দেশের মানুষকে সাত বছর আগেই সুন্দর এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে হচ্ছে। এমন দুর্ভাগ্যের কারণ কিন্তু খুব কঠিন কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে বায়ুদূষণ। অথচ এই দূষণ দূর করতে ক্ষমতাসীনরা কিছুই করছে বলে আমরা জানি না। অথচ বাংলাদেশ নানাবিধ দূষণের কবলে পড়ে আছে। এত চরম ইকোলজিক্যাল ইমব্যালেন্সের সৃষ্টি হচ্ছে।

ফলে গত ১৫ বছর এই জনপদ যেন একটা সমস্যার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। যে দিকে তাকানোই কেবলই সঙ্কট আর সমস্যা। কিন্তু শাসকবর্গের চরম নির্লিপ্ততার তুলনা করা যেতে পারে দূর অতীতের রোম নৃপতি নিরোর সাথে। রোম যখন আগুনে পুড়ছিল তখন নিরো মনের আনন্দে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। এখন তেমনি এ দেশের শাসককুল, রাষ্ট্র ক্ষমতাকে মুষ্টিবদ্ধ করার জন্য কেবলই ব্যস্ত সমস্ত। অন্য দিকে তাকানোর কোনো অবসর তাদের নেই।

উপরে বলা হয়েছে, উন্নয়নের প্রশ্নে ক্ষমতাসীনরা কেবলই মেগা প্রকল্প নিয়ে কথা বলেন। অথচ উন্নয়নের দ্যোতনায় থাকে অনেক কিছু। উন্নয়নের সমার্থক পরিভাষা হচ্ছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব দূর করা, সচল শিল্পাঞ্চল ও কৃষির উন্নয়ন, উন্নত শিক্ষা ও প্রযুক্তির বিকাশ, সবার জন্য স্বাস্থ্য-সুরক্ষা, সুপেয় পানির নিশ্চয়তা, আশ্রয়ণ প্রকল্প নয়; স্বউদ্যোগে নীড় রচনা, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধান, গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা। গত ১৫ বছর এসব এজেন্ডা নিয়ে কতটুকু অগ্রসর হওয়া গেছে? তার পরিসংখ্যান নিলে শুধু হতাশ নয়, হতবিহ্বল হতে হবে। যাক এই অধ্যায়, শোনা যাক উন্নয়নের যত গালগল্প। সীমাহীন উন্নয়নের দীর্ঘতম ফিরিস্তি দিয়ে যে তাসের ঘর রচনা করা হয়েছিল তাকে এখন বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে অনেক কিছুর সাথে দ্রব্যমূল্য, গণতন্ত্রহীন, মানবাধিকার, কর্তৃত্ববাদী শাসকদের রক্তচক্ষু। যার ফলে ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর চলছে দমন-দলন-পীড়ন আর নিপীড়ন।

দেশের যাবতীয় বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে আইন রয়েছে বটে। তবে তা কেবলি কিতাবেই। সরকার মধ্যে মধ্যে কিছু তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করে বটে। তবে সেটি যথার্থ কি না যাচাই করার কোনো পথ নেই। তথাপি আস্থা রাখছি, সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন বিভাগের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২৩) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিটা (এডিপি) বাস্তবায়িত হয়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। উল্লিখিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য এডিপিতে বরাদ্দ রয়েছে দুই লাখ ৭৪ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। এ বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৫৮ মন্ত্রণালয় ব্যয় করতে পেরেছে মাত্র ২০ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। মাসওয়ারি হিসাবেও কমেছে এডিপি বাস্তবায়নের হার। পক্ষান্তরে, গত অর্থ বছরের একই মাসে ব্যয় হয় ১২ হাজার ৫১ কোটি টাকা। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক এ সম্পর্কে বলেছেন, আসলে সরকারের হাতে কোনো টাকা নেই। সে জন্য সরকার অর্থ বরাদ্দ করতে পারছে না। তবে নির্বাচনকেন্দ্রিক কিছু ক্ষেত্রে বাজেট থেকে ছাড় দেয়া হলেও অধিকাংশ প্রকল্পের টাকা ছাড় দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ওই বিশেষজ্ঞ আরো মনে করেন, অর্থের অভাবে ও সরকারি কর্মকর্তাদের সক্ষমতার অভাবে উন্নয়ন কর্মসূচিগুলো ব্যাহত হচ্ছে, দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্যই সেটি কাম্য নয়। এই হচ্ছে আমাদের উন্নয়ন নিয়ে একটা উদাহরণ। সর্বত্র এমনটিই চলছে। তবে উন্নয়ন নিয়ে গালগল্পের শেষ নেই। দেশের বিদ্যমান সামগ্রিক পরিস্থিতির সাথে উন্নয়নের কল্পকাহিনী শুনে কেউ অট্টহাসি দিলে বলার কিছু থাকবে না।

উন্নয়নের ধারণার সাথে বেকারত্বের পারস্পরিক সম্পর্ক অবশ্যই সাংঘর্ষিক। সেই বেকারত্বই এখন একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে বেকার ২৫ লাখ ৮২ হাজার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকার দেশের গ্রামাঞ্চলে। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সত্যিকার বেকারের সংখ্যা আরো বহুগুণ বেশি। বিশেষজ্ঞ আরো মনে করেন, আমাদের বর্তমান যে শিক্ষাব্যবস্থা, এর চাহিদা শ্রমবাজারে নেই। তাই দেশের শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অনেক বেশি যাদের সংখ্যা এসব শুমারিতে স্থান পায়নি। শ্রমবাজারের চাহিদার নিরিখে দেশের বিদ্যমান শ্রমশক্তিকে সেভাবে শিক্ষিত করা, প্রশিক্ষণ দেয়ার বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। দেশের বিপুল উন্নয়নের কথা বারবার বলা হচ্ছে। এর পাশাপাশি বেকারের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়বে। সেটি কিভাবে হয়?

একই সাথে উন্নয়নের ধারণার সাথে এটি কোনোভাবেই যায় না। দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যস্ফীতি এতটাই যে, সেটি সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। বহুদিন থেকে দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে মাছ, গোশত, ডিম, দুধ, ডাল, তেল, আলু, পটোল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, মরিচ ইত্যাদি কোনো পণ্যই নেই। এটি কিভাবে উন্নয়নের চিত্র হতে পারে? যেখানে অধিকাংশ মানুষ এখন অনাহারে অর্ধাহারে দিন যাপন করছে। এ ক্ষেত্রে উন্নয়নের সংজ্ঞাটা কী!

উন্নয়নের বিশুদ্ধতার সাথে গণতন্ত্র মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতার সম্পর্ক এমনটিই যে, তারা আসলেই সমার্থক। অথচ উল্লিখিত তিন সহোদরকে ক্ষমতাসীনরা বনবাসে পাঠিয়েছে। লোকালয়ে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতাকে কারো কারো জন্য এতটা উন্মুক্ত ও অবারিত যে তারা তাদের প্রতিপক্ষকে লক্ষ করে কদাকার অসত্য অশ্লীল অবাঞ্ছনীয় অশ্রাব্য সম্মানহানিকর বক্তব্য নিরবচ্ছিন্নভাবে দিয়ে চলেছেন। আসলে এসব উন্মুক্ততা নয়, উন্মত্ততা বলাই সঠিক হবে। শাসক দলের এমন বিচার-আচার সর্বত্র সমালোচিত হচ্ছে। শুধু দেশেই নয়, সীমান্তের বাইরেও সমালোচনার ঢেউ।

উন্নয়নের ধারণার সাথে এটি সামঞ্জস্যপূর্ণ, জাতীয় জীবনে যে কোনো অপচয়। সম্প্রতি দেশবাসীর নজরে এসেছে, একাদশ জাতীয় সংসদে সরকার ও সরকারপ্রধানের প্রশংসায় সংসদের ৬১ ঘণ্টা ২৬ মিনিট ব্যয় হয়েছে। এর আর্থিক মূল্য প্রায় ১০০ কোটি ৩৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭০৪ টাকা। সংসদ ঠিক সময় বসতে না পারায় প্রতিষ্ঠানের মোট ২২টি অধিবেশন শুরু হতে বিলম্ব ঘটেছে। কোরামের অভাবে বসতে দেরি হওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানের ৮৯ কোটি ২৮ লাখ আট হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তি তথা এমপিদের একান্ত দায়িত্বহীনতার জন্য দেশের এমন ক্ষতি হয়েছে। আরো জানা গেছে, গত দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে- ঢাকায় উন্নয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট ফ্লাইওভার। এই ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয় যানজট নিরসনের লক্ষ্যে। কিন্তু তা হিতে বিপরীত হয়েছে। এই ফ্লাইওভারের নতুন যানজটের কারণে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। প্রতিদিন অতিরিক্ত জ্বালানি ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৬ হাজার কোটি টাকা। এসব কি প্রকৃতপক্ষে উন্নয়নের সাথে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ?

 

 

 

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/789035