৪ নভেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৩:১৭

৮০৮ জেলে পরিবারে জীবিকার অনিশ্চয়তা

বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের মেঘনাতীরের জেলে আবুল মৃধা। পরিবারে সদস্য সাতজন। উপার্জন করেন শুধু তিনি। ইলিশ শিকারে না যাওয়ার জন্য সরকার তাঁকে ২৫ কেজি চাল দিয়েছে।

সেই চালে ভাত রান্না হয়। পরিবারের সদস্যরা সঙ্গে একটু তরকারিও খেতে চায়। আবদার মেটাতে লুকিয়ে ইলিশ শিকারে যান তিনি। তবে ধরা পড়ে যান।

জেল হয় এক মাসের।

আবুুল মৃধার স্ত্রী আমেনা বেগম কালের কণ্ঠকে জানান, গত ১৬ অক্টোবর জেলে যাওয়ার আগে তাঁর স্বামী অনেক দেনা করে গেছেন। এখন নতুন করে ধারকর্জ করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে ১৮ হাজার টাকা দেনা হয়ে গেছে।

আগামী ১৪ নভেম্বর তাঁর স্বামীর সাজার মেয়াদ শেষ হবে। জেল থেকে বেরিয়েই তাঁকে দেনা শোধ করার জন্য নদীতে ঝাঁপ দিতে হবে।

শুধু আবুল মৃধা নন, বরিশাল বিভাগের আরো ৮০৭ জেলে পরিবার প্রায় একই রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি।

কারাগারে আছেন এমন পাঁচটি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের মুঠোফোনে কথা হয়েছে। তাঁরা প্রত্যেকেই স্বীকার করেছেন, জীবিকার তাগিদে তাঁরা নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ইলিশ শিকারে গেছেন।

আর যাঁদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি জেলে গেছেন, তাঁদের কষ্টের সীমা-পরিসীমা নেই।

বিভাগীয় মত্স্য অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞাকালীন বিভাগে দুই হাজার ৮৩৭টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে এবং এক হাজার ১৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। বিভাগের ছয় জেলার অভিযানের তথ্য অনুযায়ী, সব থেকে বেশি ৪৮৬ জনের কারাদণ্ড হয়েছে বরিশাল জেলায়। আর সব থেকে কম হয়েছে বরগুনা জেলায়।

মত্স্য বিভাগের সহকারী পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন জানান, বরিশালের ছয় জেলায় ইলিশ শিকারে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা তিন লাখ ৮২ হাজার ৭১। তাঁদের প্রত্যেকে মাথাপিছু ২৫ কেজি করে চাল পেয়েছেন।

বরিশালের জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম বলেন, নিষেধাজ্ঞাকালে জেলেদের যাতে দুর্দশায় পড়তে না হয়, সে জন্য সরকার সহায়তা দিচ্ছে। যদিও এটা অপ্রতুল, তবে প্রতিবছরই সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সহায়তার বাইরেও সরকার বিকল্প জীবিকায়নের বিষয়টি সক্রিয়ভাবে ভাবছে। এরই মধ্যে এর কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে।

জেল-জরিমানা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞার জন্যই  ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। এই সময়টায় প্রশাসন তৎপর না হলে মা ইলিশ রক্ষা করা যেত না। তারপরও যে জেলেরা ইলিশ শিকারে নেমেছেন, প্রশাসন বিধি অনুযায়ী তাঁদের শাস্তি দিয়েছে। বিষয়টি মানবিকভাবে নিলে জেলেরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠতেন।

বরাদ্দের তালিকায় মৃত ব্যক্তি, প্রবাসী

নরসিংদী প্রতিনিধি জানান, দুর্যোগ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৮ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসন থেকে নরসিংদী সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের ৪০০ জেলের প্রত্যেকের জন্য ভিজিএফের ২৫ কেজি করে মোট ১০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। চরদিঘলদীতে ২০০, আলোকবালিতে ১২৫ ও করিমপুরে ৭৫ জেলেকে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়।

তিন ইউনিয়নে বরাদ্দের তালিকায় থাকা ৪৫ জনের পরিবারে খোঁজ নিয়ে জানা যায় তাদের কেউ চাল পায়নি। তালিকায় নাম থাকা এই ৪৫ জনের মধ্যে ছয়জন মৃত ব্যক্তি, চারজন প্রবাসী, ১৭ জন অপেশাদার ও ১৮ জন জেলে। তালিকায় থাকা মৃত ব্যক্তিরা হলেন আলোকবালী ইউনিয়নের মুরাদনগর এলাকার হাসেম মিয়া, হাবিজ মিয়া, আজি মিয়া ও বাখননগর এলাকার অছেদ মিয়া এবং করিমপুর ইউনিয়নের করিমপুর এলাকার তোতা মিয়া ও মাদবর আলী। প্রবাসে আছেন আলোকবালীর মুরাদনগর এলাকার আবদুল লতিফ, বাখননগর এলাকার জামাল মিয়া, ইউসুফ মিয়া ও বিল্লাল মিয়া।

মুরাদনগর গ্রামের জিলান মিয়া (৩৫) বলেন, ‘আমি গত দুই বছরেও চাল পাইনি। শুনেছি বরাদ্দপ্রাপ্ত তালিকায় ৪১ নম্বর ক্রমে আমার নাম রয়েছে। আমার নামে বরাদ্দকৃত চাল যারা আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে সরকারের কাছে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’

করিমপুর ইউনিয়নের মো. আলমগীর বাশার (৪২) বলেন, ‘আমি গত ২০ বছর ধরে ইলিশ শিকার করি এবং সরকারের তালিকাভুক্ত জেলে। বরাদ্দপ্রাপ্ত তালিকায় আমার নাম শীর্ষে রয়েছে। কিন্তু আমার নামে বরাদ্দকৃত চাল পাইনি।’

চরদিঘলদী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আব্দুল হান্নান মিয়া বলেন, ‘আমার এলাকায় মৃত, প্রবাসী, অপেশাদার ব্যক্তিদের নামে চাল বরাদ্দ এসেছে। কারা এ তালিকা তৈরি করেছেন, তা আমার জানা নেই। আমার এলাকার তালিকায় নাম থাকা ৩৩ জনের কেউ চাল পায়নি।’

ইউপি চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন সরকার দিপু বলেন, ‘আমাদের এলাকায় জেলের সংখ্যা অনেক। কিন্তু বরাদ্দ পেয়েছি মাত্র ১২৫ জনের। তাদের সবাইকে গত অক্টোবর মাসে চাল দিয়ে দিয়েছি আমরা। আমাকে হয়রানি করতে আমার নামে মিথ্যা অপবাদ ছড়াচ্ছে কেউ কেউ।’

চরদিঘলদী ইউপির চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন শাহীন বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে চাল বিতরণে কোনো অনিয়ম হয়নি। হয়তো তালিকার ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে।’

করিমপুর ইউপির চেয়ারম্যান মুমিনুর রহমান আপেলের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি।

নরসিংদী জেলা প্রশাসক বদিউল আলম বলেন, এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/11/04/1332995