৪ নভেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৩:১১

আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ঘুমের ওষুধ বিক্রি

সমস্যায় বেশি ভুগছেন রাজধানীতে বসবাসকারী ও নারীরা

 

দেশে ঘুমের ওষুধ বিক্রি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। একাধিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী, সেবাদাতা চিকিৎসক ও ওষুধ বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে আধুনিক যান্ত্রিকজীবনের প্রভাব পড়ছে। 

এর সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়া নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য। অর্থনৈতিক সংকট ছাড়াও রয়েছে দ্রুত নগরায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংক্রামক-অসংক্রামক রোগের উপদ্রব, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক অস্থিরতা। বিভিন্ন ধরনের পারিপার্শ্বিক চাপ, শোক-তাপ মানুষের মনে বিষণ্নতা বাড়াচ্ছে। মনোদৈহিক অসুস্থতা তৈরি করছে। কেড়ে নিচ্ছে শান্তির ঘুম।

গবেষণায় দেখা গেছে, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ক্যানসার ও ওজন বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে। ডিমেনশিয়া (স্মৃতিভ্রংশতা) এবং ডিপ্রেশনে (বিষণ্নতা) ইনসোমনিয়া (অনিদ্রা) বাড়ে। এমন বাস্তবতায় ঘুমের সমাধানের জন্য চিকিৎসকের কাছে গেলেই ব্যবস্থাপত্রে লিখে দিচ্ছেন ঘুমের ওষুধ। অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ফার্মেসি থেকে মুঠো-মুঠো ওষুধ কিনে খাচ্ছেন। স্লিপিং পিল ও অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট জাতীয় ওষুধগুলো সঠিক মাত্রা ও ডোজ অনুযায়ী সেবন না করায় দীর্ঘমেয়াদি জটিল স্নায়বিক ও মানসিক রোগে আক্রান্তের ঝুঁকিতে পড়ছেন অনেকে।

বিশেষজ্ঞরা যুগান্তরকে বলেন, সাধারণত রোগীদের ঘুম ও বিষণ্নতার সমস্যা দূর করতে চিকিৎসক স্লিপিং পিল (ঘুমের ওষুধ) ও অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট মেডিসিন গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। মানসিক চাপ, অবসাদ ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে ও ভালো ঘুমের আশায় অনেকেই এসব ওষুধ সেবন করেন। কিন্তু নিয়মিত সেবনে একটা সময় শরীর ওই ওষুধটির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ঘন ঘন ঘুমের ওষুধ ও অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট সেবন শরীরে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। মানুষের হার্ট ও মস্তিষ্কের রক্তনালির রক্ত চলাচল বন্ধের শঙ্কা বাড়ে। ঘুমের ওষুধে আসক্ত হয়ে পড়লে পিপাসা কমে শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি করে কিডনি ও লিভারে প্রভাব ফেলে। 

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মুহিত কামাল বলেন, পরিমিত ঘুম হৃদরোগসহ নানা রোগের ঝুঁকি কমায়। ভালো ঘুম না হওয়ার প্রবণতা একটি গুরুতর রোগ। সুনিদ্রা মানুষের দেহ ও মন দুটিই সতেজ-সুস্থ রাখে। ভালো ঘুম হলে দেহের মেটাবলিক ও হরমোনাল অ্যাকটিভিটি এবং মানসিক প্রশান্তি নিশ্চিত হয়। কর্মক্ষেত্রে পারফরম্যান্স ভালো হয়। সঠিক মাত্রায় নিয়মিত ঘুম হলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়। সাধারণত পূর্ণবয়স্ক মানুষদের ৭-৮ ঘণ্টা, শিশুদের ৯-১৩ ঘণ্টা, নবজাতকদের ১২-১৭ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ছাড়া অন্য কেউ ঘুমের ওষুধ সেবনের ব্যবস্থাপত্র দিতে পারেন না। কিন্তু ফার্মেসি মালিকরা মানসিক রোগের সব ওষুধকে ঘুমের ওষুধ মনে করেন। ডোজ ও মাত্রাভেদে এটির ভিন্নতা বুঝতে পারেন না। ফলে সেবনে রোগীর শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। যেটি সম্পর্কে তাদের সঠিক ধারণা নেই। তাই রেজিস্টার্ড চিকিৎকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বিক্রি বন্ধে সরকারকে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। 

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর স্লিপ অ্যাপেনিয়া সোসাইটির সেক্রেটারি জেনারেল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইএনটি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু বলেন, দেশে কত মানুষ ঘুমের সমস্যায় ভুগছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে করোনা মহামারির আগে বিশ্বে ৫৫ শতাংশ এবং পরে ৭৭ শতাংশ মানুষ ঘুমের সমস্যায় ভুগছেন। দেশে অঞ্চলভিত্তিতে ঢাকায় বসবাসকারী এবং নারীদের মধ্যে ঘুমের ওষুধ সেবনের প্রবণতা তুলনামূলক বেশি দেখা যায়।

ডা. মনিলাল আইচ আরও বলেন, শারীরিক বা মানসিক যে কারণে ঘুমের সমস্যা হচ্ছে তা আগে খুঁজে বের করে সমাধান করতে হবে। ঘুমের ওষুধের বিকল্প হিসাবে প্রতিদিন সকালে সূর্যের আলোতে ২০ মিনিট হাঁটা, বিকালে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট ব্যয়াম করা, নির্ধারিত সময়ে ঘুমাতে যাওয়া, দিনে না ঘুমানো, নিয়মিত প্রার্থনা, মেডিটেশন বা ধ্যান করা। ঘুমাতে যাওয়ার ন্যূনতম দুই ঘণ্টা আগে ইলেকট্রনিক যন্ত্র থেকে দূরে থাকা, ঘুমের ১০ মিনিট আগে গোসল করা, রাতের প্রথমভাগে খাওয়া এবং মসলাযুক্ত ও ভারী খাবার পরিহার করা, ধূমপান বা অন্য যে কোনো নেশাজাতীয় খাবারসহ চা, কফি ও ক্যাফেইনসমৃদ্ধ খাবার থেকে বিরত থাকা উচিত।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, কিছু ঘুমের ওষুধের আসক্তি থেকে মুক্তির জন্য ওষুধ পাওয়া গেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা তেমন কাজ করে না। বরং মাথা ঘোরা, মাথাব্যথা, ডায়রিয়া, বমি ভাব, ঘুম ভাব, অ্যালার্জির সমস্যা, ওজন বৃদ্ধি, স্মৃতিশক্তি লোপ ও আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ফলে কিছু ওষুধ ধীরে ধীরে বন্ধ করতে হয়। হঠাৎ বন্ধ করলে মানসিক অবসাদ, জ্বর, কাশি, ঠান্ডা, শরীর ম্যাজম্যাজ করা, শরীরে চুলকানিসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। অতিরিক্তি ঘুমের ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় ব্যক্তির প্যারালাইসিস পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া লো প্রেশার বা নিম্ন-রক্তচাপের রোগী, যাদের লিভার ও কিডনির সমস্যা আছে, অনেক বয়স্ক ব্যক্তি, খিঁচুনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি, গর্ভবতী নারী ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের ঘুমের ওষুধ খাওয়া নিষেধ।

https://www.jugantor.com/todays-paper/city/736160