৪ নভেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৩:০৭

হুমকির মুখে তৈরি পোশাক খাত

বেতনকে কেন্দ্র করে গার্মেন্ট ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ ও হামলা কাম্য নয়-মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

 

কয়েকদিনে রাজধানীসহ গাজপুর, আশুলিয়া ও সাভারে আড়াইশ কারখানায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও হামলার ঘটনায় হুমকির মধ্যে পড়েছে তৈরি পোশাক খাত। ন্যূনতম মজুরিকে কেন্দ্র করে গার্মেন্ট শ্রমিকদের তাণ্ডবের মুখে তিন দিন ধরে অন্তত ৬৫০ পোশাক কারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে মিরপুরে ২৩৫টি, আশুলিয়ায় ৩৫টি এবং গাজীপুরে ৩৮৬টি। এতে স্বাভাবিক উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর-এই ৩ মাসে বিদেশি ক্রেতারা সাধারণত নতুন অর্ডার প্লেস করেন। এখন শ্রমিক আন্দোলনের নামে যেভাবে কারখানা ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও হচ্ছে, তাতে হুমকির মুখে পড়বে এ খাত।

এমনিতে গেল চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বিশ্ববাজারে রপ্তানি কমেছে তৈরি পোশাকের। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ১৪৪ কোটি মার্কিন ডলারের। এখন যুক্ত হয়েছে ন্যূনতম বেতনের দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলন। পাশাপাশি চলছে রাজনৈতিক কর্মসূচি-অবরোধ। এতে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ায় বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এ শিল্পে।

জানতে জাইলে বিজিএমইএ’র প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আন্দোলনের নামে একটি গোষ্ঠী এ খাতকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। এতে শ্রমিক, গার্মেন্ট মালিক, দেশ সব পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মনে রাখতে হবে তৈরি পোশাকই একমাত্র খাত যার ওপর ভিত্তি করে দেশের অর্থনীতি মজবুত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘চলতি মাস থেকে আগামী ডিসেম্বর মাসে বিদেশি ক্রেতারা সাধারণত নতুন অর্ডার প্লেস করেন। এখন শ্রমিক আন্দোলনের নামে যা চলছে তাতে বড় ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ আসে যে খাত থেকে, সেটি হলো তৈরি পোশাক খাত। কিন্তু বেতনকে কেন্দ্র করে গার্মেন্ট ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হামলা কাম্য নয়। পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে বড় ধাক্কা আসবে অর্থনীতিতে। এমনিতেই আমরা ডলার সংকটে আছি। গার্মেন্ট ডলার আয়ের অন্যতম একটি খাত। এ মুহূর্তে পোশাক খাত টিকিয়ে রাখতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।’

সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ, সামনে জাতীয় নির্বাচন। ইতোমধ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচি চলছে। ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার আগে শ্রমিক আন্দোলনের পেছনে কারও ইন্ধন থাকতে পারে। বিগত সময়ে মজুরি ঘোষণার পর আন্দোলন হতো। এবার মজুরি ঘোষণার আগেই কেন আন্দোলন তা খতিয়ে দেখা দরকার। দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে কোনো পক্ষ যেন নিরীহ শ্রমিকদের ব্যবহার করতে না পারে সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখা দরকার।

এমনিতেই বিশ্ব মন্দার কারণে সংকটের মধ্যে গার্মেন্টশিল্প। রপ্তানি আয় ধরে রাখা এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাহিদা কমে যাওয়ায় বিদেশি ক্রেতারা পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হলে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মৌসুমের অর্ডার কমে যেতে পারে বলে শঙ্কায় আছে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ)। এদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে নিজেদের অর্ডার বাড়াতে তৎপর ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়ার মতো প্রতিযোগী দেশগুলো। এ অবস্থায় দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ধস ঠেকাতে রাজনৈতিক দলগুলোকে সহনশীল হওয়ার আহ্বান ব্যবসায়ীদের। পরিস্থিতি নিয়ে ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ নেতারা। তারা বৈঠক করেছেন মজুরি বোর্ডের সঙ্গেও। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এমনিতে ডলারের সংকট চলছে। আর দেশের ডলার আয়ের প্রধান দুটি খাতের মধ্যে অন্যতম একটি রপ্তানি। যার বড় অংশ আসছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। চলতি অর্থবছরে এ খাতের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৫ হাজার ২২৭ কোটি মার্কিন ডলার। আর মোট রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলার। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ত্রিমুখী চাপের মুখে পড়েছে খাতটি। প্রথমত, রাজনৈতিক আন্দোলন-অবরোধ, দ্বিতীয়ত, শ্রমিকদের আন্দোলন ও শেষ হচ্ছে বৈশ্বিক সংকট।

বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান সম্প্রতি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে বর্তমানে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার ফলে পোশাকের ওপর ভোক্তারা ব্যয় হ্রাস করেছেন। ফলে পোশাকের অর্ডার কমেছে। তাই রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে। উপরন্তু, ফ্যাশন শিল্পে পণ্য সরবরাহের জন্য সম্ভাব্য স্বল্পতম লিডটাইমের চাহিদা ক্রমবর্ধমানভাবে বেড়েছে।

ঘটনার সূত্রপাত পোশাক শ্রমিকদের বেতন নিয়ে। গত ২২ অক্টোবর মজুরি বোর্ডের কাছে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা করার প্রস্তাব দেয় শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি। একই দিন শ্রমিকপক্ষের প্রস্তাবের বিপরীতে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার ৪০০ টাকার প্রস্তাব দেয়। এ খবরে রাস্তায় নেমে আসে শ্রমিকরা। শুরু হয় অবরোধ, বিক্ষোভ, কারখানায় ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও।

এ প্রসঙ্গে বিকেএমই’র নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম শুক্রবার যুগান্তরকে জানান, শ্রমিক নামধারী কিছু লোক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করছে। ওরা প্রকৃত পক্ষে পোশাকশিল্পের শ্রমিক নয়। একটি চক্র পোশাকশিল্পকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এভাবে চলতে থাকলে পোশাক রপ্তানি কমে যাবে। বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার দেবে না। যার মানে এ শিল্প ধ্বংসের দিকে যাওয়া।

শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি প্রসঙ্গে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লা বলেন, আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল বেতনের ক্ষেত্রে সাতটি গ্রেড থেকে পাঁচটিতে নিয়ে আসা। এখানে মালিক-শ্রমিক উভয়পক্ষই একমত হয়েছে। তবে ন্যূনতম মজুরি নিয়ে চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আরও একটি সভা হবে। ওই সভায় নির্ধারণ হবে ন্যূনতম মজুরি। ওই দিনের সভায় বিজিএমইএ থেকে লিখিত আকারে প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর আগে বিজিএমইএ থেকে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল সেখানে শ্রমিকদের দেওয়া প্রস্তাবের সঙ্গে অনেক ব্যবধান। আশা করছি এটা কমে আসবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/736138